স্বাস্থ্য খাত সংস্কার প্রসঙ্গে

মো. নাসির উদ্দিন
২১ জুন ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার প্রসঙ্গে

স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন ৭টি স্তম্ভের ভিত্তিতে যথাÑ ১. স্বাস্থ্যসেবা দান ও ভৌত অবকাঠামো, ২. নেতৃত্ব, সুশাসন ও কর্মসংস্কৃতি, ৩. স্বাস্থ্য জনবল ব্যবস্থাপনা, ৪. স্বাস্থ্য জনবলের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, ৫. অত্যাবশ্যকীয় ওষুধপত্র, চিকিৎসা প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম সরবরাহ, ৬. স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ন এবং ৭. স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে সুপারিশ উপস্থাপন করেছে। এই সুপারিশগুলো পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে স্বাস্থ্য খাতের সেবাকে ওষুধনির্ভর করেই উপস্থাপন করা হয়েছে। বহুকাল আগে থেকেই একটি প্রবাদ প্রচলিত যা চিকিৎসাশাস্ত্রের সঙ্গে জড়িতÑ ‘প্রতিরোধ নিরাময়ের চেয়ে উত্তম’। কিন্তু স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশে রোগ প্রতিরোধকে বাদ দিয়ে নিরাময়ের ভিত্তিতেই সব সুপারিশ প্রদান করা হয়েছে।

বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটেছে। বিশেষ করে শল্য চিকিৎসা, জেনেটিক চিকিৎসা, সংক্রামক এবং মহামারী রোগের বিরুদ্ধে টিকা উদ্ভাবন এ দুই শতাব্দীতে চিকিৎসাবিজ্ঞানকে উন্নত থেকে উন্নতর করেছে। অ্যালোপ্যাথিসহ চিকিৎসাৎবিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি হলেও অনেক ধরনের অসংক্রামক রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় বা আরোগ্য সাধন করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমান চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগীকে নয় রোগকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এবং চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ওষুধনির্ভর হয়ে পড়েছে। রোগীও যে রোগ নিরাময় এবং রোগ প্রতিরোধের কারণ হতে পারে এ বিষয়টি কখনও আমলে নেওয়া হচ্ছে না।

রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পর্কে মধ্যযুগের অন্যতম বিশিষ্ট চিকিৎসক ইবনে সিনা বলেছেন যে, এ বিষয়ে দরকারি হচ্ছে ব্যায়াম, তারপর খাদ্য। তা ছাড়া পানি, বিশ্রাম, ঘুম ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। তার মতে, নিয়মিত ব্যায়াম করলে ওষুধের দরকার হয় না। ইবনে সিনা বলেন, ‘নিয়মিত ব্যায়াম কর এবং সব সময় খুশি থাকো, তাহলে তোমার আয়ু হবে একশ বছর কিংবা তারও বেশি। মিকশ্চার অথবা অন্য কোনো ওষুধ স্বাস্থ্য দিতে পারে না, বাগান, নির্মল হাওয়াÑ প্রকৃতিই সেরা নিরাময়কারী।’ প্রকৃতি আমাদের যা দিয়েছে তা দিয়েই আমরা নিজেরা নিজেদের রোগ প্রতিহত করতে পারি। গ্রিক চিকিৎসাবিদ, চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক হিপোক্রেটিস ৪৪০ বিসিতে বলেছিলেন, ‘খাদ্য হলো ওষুধ এবং ওষুধ হলো খাদ্য।’ হাজার বছর আগের এ বাক্যগুলো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে ব্যায়াম, পানি পান, বিশ্রাম, ঘুম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যের গুরুত্ব।

অধিকাংশ নন-কমিউনিকেবল (অসংক্রামক) রোগ যথাÑ উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অনিয়ন্ত্রিত কোলেস্টেরল, হৃদরোগ, ধমনিবদ্ধতা, স্ট্রোক, ক্যানসার, আলসার, পারকিনসন, আলঝেইমার ইত্যাদির ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, ধূমপান, মানসিক চাপ, উদ্বেগ, শারীরিক পরিশ্রম না করা, মদ্যপান, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ, অতিরিক্ত দৈহিক ওজনের বিষয়গুলো জড়িত। এসব কারণ প্রতিরোধের কিন্তু কোনো ওষুধ নেই। প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিতে অধিকাংশ অসংক্রামক রোগের জন্য জীবনব্যাপী ওষুধ সেবনের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে বিষয়টি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। সুশৃঙ্খল জীবনাচার, উপযুক্ত খাদ্য নির্বাচন, মানসিক ও শারীরিক ব্যায়ামের মাধ্যমে ওষুধ ছাড়া অধিকাংশ নন-কমিউনিকেবল রোগ এবং কিছু সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময় করা সম্ভব। কিন্তু স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশে এ বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি।

শারীরিক সুস্থতা, রোগ নিরাময় ও রোগ প্রতিরোধের জন্য শারীরিক, মানসিক ব্যায়াম এবং খাবারের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্যের উপকারী ভিটামিন, খনিজ ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্টগুলো শরীরকে ফ্রি রেডিক্যালের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে অনেক ধরনের দুরারোগ্য রোগ প্রতিহত করে। তাই শরীরকে সুস্থ রাখা এবং রোগ প্রতিরোধ করার জন্য উপযুক্ত ফলমূল, শাকসবজি, পানীয় ও খাবার নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক খাবার নির্বাচন এবং পরিমিত খাবার মাংসপেশির গঠন, মস্তিষ্ক সমৃদ্ধকরণ, চামড়া কোচকানো রোধ, হৃদযন্ত্র শক্তিশালীকরণ, হাড় গঠন, ইমিউনিটি বৃদ্ধি এবং প্রদাহ রোধে কার্যকর। দেহকে দুরারোগ্য এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ ক্যানসার, আর্থ্রাইটিস, বার্ধক্য, হৃদরোগ, স্নায়ুরোগ, অ্যাজমা, ব্রংকাইটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, আলঝেইমার, পারকিনসন, স্মৃতিলোপ, স্ট্রোক, ক্যাটারাক্ট, রেটিনাল রোগ, ইসকিমিয়া, হার্টফেল থেকে রক্ষা করতে ফলমূল ও শাকসবজি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

শরীর ও মনকে উজ্জীবিত করে ইমিউনিটি বৃদ্ধিতে শারীরিক ব্যায়াম একান্ত অপরিহার্য। যে কোনো বয়সে, বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে শারীরিক সক্ষমতা বজায় রাখতে নিয়মিত শরীরচর্চা করা একান্ত আবশ্যক। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত শরীরচর্চা করে তাদের ক্ষেত্রে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি ৩৫%, টাইপ-২ ডায়াবেটিস ৫০%, কোলন ক্যানসার ৫০%, ব্রেস্ট ক্যানসার ২০%, অকালমৃত্যু ৩০%, অস্টিওআর্থ্রাইটিস ৮৩%, হিপ ভঙ্গুরতা ৬৮%, পড়ে যাওয়া ৩০%, মানসিক চাপ ৩০% এবং অনিদ্রার ঝুঁকি ৩০% হ্রাস পায়। বিশেষজ্ঞদের মতে সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট শরীরচর্চা করা উচিত। করোনা মহামারী আমাদের একটি বিষয়ে সচেতন করেছে যে শুধূু ওষুধনির্ভর চিকিৎসাব্যবস্থা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এ সময় শরীরের ইমিউনিটি বৃদ্ধি করার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে এবং ইমিউনিটি অর্থাৎ শরীরের রোগ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য কী করতে হবে, কী খেতে হবে তার কথা বলা হচ্ছে। করোনাকে প্রতিরোধ করতে বিশ্ব্য স্বাস্থ্য সংস্থা যেসব বিষয়ের কথা বলছে তাতে ওষুধের কোনো স্থান নেই, সবই প্রাকৃতিক ব্যবস্থা : শারীরিক ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম, পুষ্টিকর খাবার, ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ ফলমূল গ্রহণ, ধূমপান না করা, মদ্যপান না করা, মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা ইত্যাদি। করোনা আমাদের বুঝিয়ে দিল শুধু ওষুধনির্ভর স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতা।

বর্তমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার অপারেশনাল প্ল্যানে এএমসি (অল্টারনেটিভ মেডিক্যাল কেয়ার) হিসেবে বাংলাদেশের সব নাগরিকের জন্য আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাশাপাশি ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়নের বিষয় থাকলেও স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সুপারিশে অল্টারনেটিভ মেডিক্যাল কেয়ার সম্পর্কে কোনো সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়নি।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে নন-কমিউনিকেবল রোগে অকালমৃত্যুর হার এক-তৃতীয়াংশে হ্রাস করতে হবে। ওষুধনির্ভর স্বাস্থ্যনীতি এবং সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত মুখ্য সচিব, জ্যেষ্ঠ সচিব ও সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা সংবলিত প্রশাসনিক কাঠামোর মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জন কখনও সম্ভব হবে না। এর জন্য নজর দিতে হবে দেহের নিজস্ব শক্তিকে উজ্জীবিত করে রোগকে প্রতিরোধ করার প্রতি। আর এ জন্য অল্টারনেটিভ মেডিক্যাল কেয়ার হিসেবে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাশাপাশি ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক ব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সুশৃঙ্খল জীবনাচার, স্বাস্থ্য রক্ষায় উপযুক্ত খাবার, নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম (হাঁটা, দৌড়ানো) এবং মানসিক ব্যায়ামের (প্রাণায়াম, মেডিটেশন, হাসি, নেচার থেরাপি, আকুপ্রেশার) দিকে নজর দিতে হবে। ওষুধের যত্রতত্র ব্যবহার থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। প্রাকৃতিক বিকল্প পদ্ধতিতে রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে হাজার হাজার কোটি টাকার বাজেটের প্রয়োজন হবে না, অধিকন্তু এটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ব্যয় হ্রাস করবে। তবে এর জন্য দরকার ব্যাপক জনসচেতনতা এবং শিক্ষা কার্যক্রমে এ বিষয়গুলো সম্পৃক্ত করে স্বাস্থ্যনীতিতে ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় বিবেচনায় আনতে হবে।


ড. মো. নাসির উদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত

অতিরিক্ত সচিব