ইতিহাসের চাকাকে এগোতে হবে সমষ্টিগত মালিকানার পথে
আমাদের সমাজ ও রাজনীতির মূল ব্যাধিটা কী? সেটা এতই সরল যে সহজে চোখে পড়ে না। পড়লেও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। মূল ব্যাধির নাম পুঁজিবাদ, বর্তমানে যা ফ্যাসিবাদের রূপ নিয়েছে।
পুঁজিবাদ ছাড় দিতে, প্রতারণা করতে, ভয় ও লোভ দেখাতে, নিজেকে লুকিয়ে রাখতে এবং প্রচারমাধ্যমকে ব্যবহার করতে এতটাই দক্ষ যে, তাকে চেনা ভারি মুশকিল; সব শয়তানের সেরা সে, তার চেয়ে চতুর আর কেউ নেই। তাই ধরা পড়ে না।
একটি আলোচনা সভায় সভ্যতার অগ্রগতির বিষয়ে কথা হচ্ছিল। প্রাজ্ঞ এক অধ্যাপক বললেন, ইতিহাসের চাকা কখনও থামবে না। ওই চাকা ঘুরতেই থাকবে। খুবই ভালো কথা; থমকে দাঁড়িয়ে পড়ার পাত্র অন্য যে-ই হোক, ইতিহাস অবশ্যই নয়। অধ্যাপক সাহেব বেশ সুন্দরভাবে বললেন, যদি দেখা যায় ইতিহাস পর্বতের শিখরে গিয়ে পৌঁছে গেছে, তবুও তার চাকা কিন্তু ঘুরতেই থাকবে। এরপর যদি ইতিহাস পাহাড়ের অপর দিকে বেয়ে নামতেও থাকে তবেও কিন্তু দেখা যাবে তার চাকা থেমে যায়নি। ঘুরছেই, ঘুরছেই। আমরাও কিন্তু সে সত্য অমান্য করি না। ইতিহাসের চাকা এখন পর্বতশীর্ষে পৌঁছে গেছে ঠিকই, কিন্তু তার তো এগোনোর আর পথ নেই, এবার তো তাকে নামতে হবে নিচের দিকেই। সেটা চলমানতা ঠিকই, কিন্তু অগ্রগমন নয়, অধঃপতন বটে। অধ্যাপক সাহেব বলতে ভুলে গেলেন যে, সভ্যতা বলি কী পুঁজিবাদই বলি কারও জন্যই ওপরে ওঠার আর কোনো উপায় নেই; পাহাড়ের ওপরে উঠে স্থির হয়ে যে দাঁড়িয়ে থাকবে সেটাও সম্ভব নয়, চাকা এখন তাকে নিচের দিকে নিয়ে যাবে এবং সেটা ঘটবে এমন দুর্বার গতিতে যে, যাত্রীরা হয়তো ছিটকে পড়ে মারাই যাবে।
ওই আলোচনা সভাতেই অপর একজন প্রাজ্ঞ অধ্যাপক বললেন, ভরসা এখন রাষ্ট্রের ওপরই। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রগুলোর সংঘ, যাকে তিনি জাতিসংঘ না বলে রাষ্ট্রসংঘ বলার পক্ষপাতী, ভরসা নাকি ওই রাষ্ট্রসংঘই। অথচ বাস্তব সত্য হলো এই যে, রাষ্ট্র হচ্ছে রাষ্ট্রের যারা কর্তা তাদের হাতে বাদবাকিদের শোষণ করার শক্তিশালী যন্ত্র ছাড়া অন্য কিছু নয়। ওই কাজের বাইরে রাষ্ট্র যা করে তা হলো মূল কাজকে অক্ষুণ্ন রেখেই শুধু নয়, অক্ষুণ্ন রাখার প্রয়োজনেই। রাষ্ট্র নয়, নির্ভর করতে হবে সমাজের ওপর। এবং সেই সমাজ যদি পিতৃতান্ত্রিক হয় তাহলেও কুলাবে না, তাকে হতে হবে গণতান্ত্রিক এবং এগিয়ে যেতে হবে সমাজতান্ত্রিকতার অভিমুখে। উন্নতিটা পর্বতের মতো হবে না, হবে নদীর মতো। রাষ্ট্রের চরিত্রকে না বুঝলে, তাকে ভুলভাবে তুলে ধরলে এবং অধঃপতনকে উন্নতির প্রমাণ বলে প্রচার করলে, মানুষকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামীই করা হবে। জলবায়ু বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী মানুষ আন্তর্জাতিক সম্মেলনস্থলে সমবেত হয়ে যেভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে, তা আশাবাদী অবশ্যই। ব্যবস্থাটা যে পুঁজিবাদ তা-ও তারা বলেন, কিন্তু পুঁজিবাদের বিকল্প যে সমাজতন্ত্র সেটা বলেন না। গ্রিন পার্টি ধরিত্রীকে সবুজ রাখতে চায়, কিন্তু রাখতে হলে পুঁজিবাদের অগ্নি-উদ্গীরণ থামিয়ে সমাজতন্ত্রের মুক্ত প্রবাহ সম্ভব করে তোলা যে আবশ্যক সেই উপলব্ধি পর্যন্ত অগ্রসর হয় না। ফলে পথজ্ঞানটা পরিষ্কার থাকে না।
সমাজে প্রতিরোধ যে ঘটছে না তা নয়। গণপিটুনির কথা শুনি। তাতে কথিত অপরাধীর (সব সময় যে খাঁটি অপরাধী তা অবশ্য নয়) মৃত্যু ঘটে, কিন্তু অপরাধ বিদায় হয় না। মুন্সীগঞ্জের যে ছেলেরা বখাটেদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল তাদের একজনকে তো প্রাণই দিতে হলো, বখাটেদের ছুরিকাঘাতে। শুনলাম ঢাকার মিরপুর এলাকায় (যেখানে কিশোর গ্যাং খুবই তৎপর) একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন ছাত্রী উত্ত্যক্তকারী এক সহপাঠীকে ধাওয়া করেছে এবং ধরে ফেলে পিটিয়ে দিয়েছে। সাহসী কর্মের দৃষ্টান্ত বটে। তবে সমাধান তো নয়। প্রয়োজন সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
সেটাও অবশ্য ঘটছে। গাজায় ফিলিস্তিনিরা লড়ছে। জায়নবাদী ইসরায়েল ইরান আক্রমণ করে যে অনভিপ্রেত যুদ্ধ শুরু করেছে, এই যুদ্ধে পরাশক্তিগুলো যুক্ত হওয়ার সমূহ সম্ভবনা দেখা দিয়েছে, যেটি তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের আশঙ্কা বৈকি। ইউক্রেনের মানুষ রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিন বছর ধরে প্রতিরোধ-সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। ইউরোপে আধুনিককালে যা কখনও ঘটেনি তা-ও ঘটেছে। কৃষকরা চলে এসেছেন রাজধানীতে, নিজেদের দাবি আদায় করার লক্ষ্যে। এর আগে শ্রমিকরা এসেছেন, ছাত্ররা এসেছে, নারীবাদীরা এসেছেন; কিন্তু কৃষক আসেননি। তবে এ সবই হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ। প্রয়োজন হলো সুসংগঠিত, ধারাবাহিক সংগ্রাম; এবং তার জন্য আবশ্যক যেমন ঐক্য তেমনি শত্রুকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিতকরণ। মূল শত্রু কিন্তু পুঁজিবাদ; তাকে পাশ কাটিয়ে গেলে প্রতিরোধের সংগ্রাম তার লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হবে। এবং লক্ষ্য যে সামাজিক বিপ্লব সেটাও সঠিকভাবে জানা চাই। এমনকি অভ্যুত্থানও কাজ দেবে না, লক্ষ্য স্থির না থাকলে।
বিশ^জুড়ে নৈরাজ্যকারী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পবিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে আমেরিকাজুড়ে। কঠোর ও নৃশংস উপায়ে জনবিক্ষোভ দমন চলছে। কিন্তু বিক্ষুব্ধ মানুষকে দমন করা যাচ্ছে না। ইতিহাসের এই ঘৃণ্য বর্বর শাসক নিজ দেশ এবং বিশে^র সব দেশকে এক ভয়ানক অনিশ্চয়তার অভিমুখে ঠেলে দিয়েছেন।
অভ্যুত্থান তো আমরাও ঘটিয়েছি। নব্বই সালে অভ্যুত্থান ছিল স্বৈরাচারের পতন এবং গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য। একজন স্বৈরাচারীর পতন ঘটল ঠিকই কিন্তু সত্যিকারের গণতন্ত্র তো প্রতিষ্ঠিত হলো না, বরং দেখা গেল কয়েক বছর জেলে কাটিয়ে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কেবল যে রাজনীতিতেই ফেরত চলে এলেন তা নয়, রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদারও হতে পারলেন। এর আগে খুব বড় এক অভ্যুত্থান ঘটেছে ঊনসত্তরে। প্রায়-বৈপ্লবিক ঘটনা। আর একাত্তরে তো আমরা অবিশ্বাস্য এক জয়ের মধ্য দিয়ে নতুন একটি রাষ্ট্রই প্রতিষ্ঠা করে ফেললাম। কিন্তু কই কোনো অভ্যুত্থানেই তো জনগণের মুক্তি এলো না।
কেন যে এলো না তার ব্যাপারটা মোটেই জটিল বা অস্পষ্ট নয়। এলো না এই জন্য যে রাষ্ট্র রয়ে গেল ঠিক সেই আগের মতোই আমলাতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী। শাসক বদলাল কিন্তু শাসন (অর্থাৎ শোষণ) বদলাল না। দেশের সম্পদ বিদেশে পাচারও আগের মতোই চলছে, দেশের ভূমি, বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার এখতিয়ারবহির্ভূত সিদ্ধান্ত নিতেও সরকার কসুর করছে না। সেই ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় থেকে যে সামাজিক বিপ্লবের জন্য প্রতীক্ষা চলছিল তার অবসান ঘটল না।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
সামাজিক বিপ্লবের জন্য কী প্রয়োজন ছিল সেটা লেনিন বুঝেছিলেন এবং জানিয়েও গেছেন। সে তো একশ বছরেরও আগের ঘটনা। লেনিনের শিক্ষাটা ছিল এই যে, বিপ্লবের জন্য স্বতঃস্ফূর্ততার ওপর নির্ভর করলে চলবে না। স্বতঃস্ফূর্ততা প্রয়োজন হবে, কিন্তু তাকে থাকতে হবে সংগঠনের পরিচালনার ভেতরে। এক কথায়, বিপ্লবের জন্য বিপ্লবী পার্টি চাই, যেটা আমাদের কোনো অভ্যুত্থানেই ছিল না। ছিল না একাত্তরেও। যে জন্য বিপ্লবের সম্ভাবনা ছিনতাই হয়ে গেল, রাষ্ট্র চলে গেল বুর্জোয়াদের দখলে। পাকিস্তানি বুর্জোয়াদের সরিয়ে দিয়ে তাদের খালি জায়গাটাতে বসে গেল বাংলাদেশের উঠতি বুর্জোয়ারা।
সামাজিক বিপ্লবের জন্য বিপ্লবী পার্টি তো থাকতেই হবে, দরকার হবে বিপ্লবী তত্ত্বেরও। বিপ্লবী তত্ত্ব ব্যাখ্যা করবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে। চিহ্নিত করবে দ্বন্দ্বগুলোকে; এবং তাদের মধ্য থেকে বিশেষভাবে চিনে নেবে প্রধান দ্বন্দ্বটিকে। পৃথিবীটাকে বোঝা চাই, তাকে বদলানোর জন্য।
এই বুঝটা কারা দেবেন? দেবেন বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীরা। গভীর পণ্ডিত বা প্রাজ্ঞ অধ্যাপকরা পারবেন না দিতে, যদি তারা বিপ্লবী না হন, এবং বিপ্লবের প্রয়োজনে বিদ্যমান রাষ্ট্র ও সমাজকে ব্যাখ্যা করতে অসমর্থ হন। সামাজিক বিপ্লব অবশ্যই পুরাতন বুর্জোয়া রাষ্ট্রকে রক্ষা করবে না; তাকে ভেঙে ফেলে ক্ষমতার পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ ঘটাবে।
মূল কাজটা তাই রাজনৈতিক, কিন্তু রাজনৈতিক কাজটা করা সম্ভব হবে না সাংস্কৃতিক কাজ না থাকলে। আজ তাই প্রয়োজন একটি সাংস্কৃতিক জাগরণের। সে জাগরণ লক্ষ্যবিহীন হবে না; লক্ষ্য হবে সামাজিক বিপ্লবকে সম্ভব করে তোলা। সামাজিক বিপ্লবের মূল শর্তটা হলো সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা। পুঁজিবাদ তার শীর্ষে পৌঁছে গেছে, এখন সে যদি আরও এগোতে চায় তবে নিচে নামা ছাড়া উপায় নেই। পতনের পথ বিপজ্জনক; বলা যায় ধ্বংসাত্মক। ইতিহাসের চাকাকে এখন পরিচালনা করা চাই সমষ্টিগত মালিকানার নতুন পথেÑ কোনো এক দেশে নয়, সব দেশে, সারা পৃথিবীতে। নইলে ভয়ানক বিপদ অপেক্ষা করছে সামনে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়