ভিসা জালিয়াতি : স্বপ্ন ভাঙার আগেই সাবধান হোন
ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো মহাদেশের উন্নত দেশগুলোতে যাওয়ার স্বপ্ন অনেকেরই থাকে। তাদের স্বপ্নকে পুঁজি করে কিছু অসাধু ব্যক্তি প্রতারণার আশ্রয় নেয়। ভিসা জালিয়াতির মাধ্যমে তারা সহজ-সরল মানুষকে ফাঁদে ফেলে। পরিণতিতে প্রতারিত ব্যক্তির ইউরোপ-আমেরিকায় যাওয়ার স্বপ্ন ধুলোয় মিশে যায়, বিপুল আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়ে যান।
আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন, কারা এসব দালাল-প্রতারক? এরা আপনার আমার মতোই মানুষের চেহারাধারী। কেউ কেউ সেই দেশেই থাকে যে দেশের ভিসা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। অনেকে বাংলাদেশ বা তৃতীয় কোনো দেশে অবস্থান করেই অনলাইনে প্রতারণা চালিয়ে যায়। এরা সহজ-সরল, অভিজ্ঞতাহীন বা বিদেশ যাওয়ার প্রবল আগ্রহসম্পন্ন মানুষদের টার্গেট করে।
এরা বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় গ্রুপ ও পেজ খুলে লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করে। বিভিন্ন দেশের কমিউনিটি গ্রুপ ও পেজ খুলে এ কাজ পরিচালনা করে, যেখানে মানুষ ভিসা ও বিভিন্ন তথ্যের জন্য যোগাযোগ করে। এ ছাড়া প্রতারকচক্র বিভিন্ন কমিউনিটি গ্রুপে মানুষের তথ্য জানার জন্য যেসব পোস্ট দেয় সেগুলো অনুসরণ করে ও সরাসরি সে অনুযায়ী মেসেজ দিয়ে প্রতারণার সূত্রপাত ঘটায়। প্রতারণায় জড়িতরা জানে, কাকে টার্গেট করতে হবে, কীভাবে ধীরে ধীরে বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। তারা মনস্তাত্ত্বিক কৌশলে ভিকটিমকে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে, শেষমেশ অনেকেই ফাঁদে পড়ে যান।
সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে ফেসবুক বর্তমানে ভিসা দালালদের প্রতারণার সবচেয়ে বড় মাধ্যম। ফেসবুকে শত শত গ্রুপ ও পেজ রয়েছে যেখানে ‘নিশ্চিত ভিসা’, ‘সরাসরি ওয়ার্ক পারমিট’, ‘দ্রুত ইউরোপ যাওয়ার সুযোগ’ ইত্যাদি লোভনীয় বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই ওই পেজে মেসেজ দেন, কখনও কখনও সরাসরি ফোনালাপেও যান। দালালরাও ভুয়া ভিসা, জব অফার লেটার, ইমিগ্রেশন ডকুমেন্টসের ছবি, সিটিজেনশিপ অনুষ্ঠানে শপথ গ্রহণের ভিডিও, এমনকি এয়ার টিকিট দেখিয়ে ভিকটিমকে কনভিন্স করার চেষ্টা করে। ভিকটিম কনভিন্স হলেই শুরু হয় প্রতারণার পর্ব। প্রতারকরা বলে, ‘আপনার কাগজপত্র ও পাসপোর্ট আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিন, আমরা সব করে দিচ্ছি।’ কিছুদিনের মধ্যে তারা পাসপোর্টে নকল ভিসা স্ট্যাম্প লাগিয়ে ছবি পাঠায় এবং দাবি করে যে ভিসা হয়ে গেছে, বাকি টাকা পরিশোধ করলে পাসপোর্ট ফেরত দেবে। টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর দেখা যায় প্রতারকদের সেই পেজ, ফোন নম্বর সবই উধাও। তখন আর ভিকটিমের কিছুই করার থাকে না।
এ ক্ষেত্রে নিচের পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করলে উপকার পাওয়া যেতে পারে :
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
১. কমন সেন্স : অনেকে ১০০% ভিসা গ্যারান্টির বিজ্ঞাপন দেয়। এতে প্রলুব্ধ না হয়ে একটু কমন সেন্স কাজে লাগাতে হবে।
২. ভিসা প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা : একটি দেশ কী ধরনের ভিসা দিয়ে থাকে এবং সে ভিসা পাওয়ার প্রক্রিয়া কী, এ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখতে হবে। দালালরা হয়তো আপনার ভিসা প্রসেসে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু ভিসা পাইয়ে দেওয়ার গ্যারান্টি দিতে পারে না। বিদেশের কোনো কোম্পানি থেকে জব অফার পাওয়া নির্ভর করে আপনার নিজের যোগ্যতার ওপর এবং ভিসা পাওয়া নির্ভর করে ওই দেশের ওয়ার্ক পারমিট পলিসি এবং দূতাবাসের ওপর। অনেকে ট্যুরিস্ট ভিসা করিয়ে দেওয়ার জন্য লাখ লাখ টাকা নিয়ে থাকে। ট্যুরিস্ট ভিসার আবেদন আপনি নিজেই করতে পারেন, এতে দালালের দরকারই পড়ে না।
৩. সঠিক এজেন্সি খুঁজে বের করা : সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো এজেন্সির পেজ বা গ্রুপ দেখলে আগে নিশ্চিত হবেন তারা ভ্যালিড কিনা। দেশে ও দেশের বাইরে তাদের অফিস আছে কিনা, তাদের কোম্পানি রেজিস্টার্ড কিনা এবং কারা সে এজেন্সি চালায়। প্রয়োজনে নিজে অফিস পরিদর্শন করুন, অফিস দেশের বাইরে হলে পরিচিত বা যে কোনো মাধ্যমে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করুন।
৪. ভিসার আবেদনে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত রাখা : কোনো দালাল বা এজেন্সি যদি আপনার ভিসা প্রসেস করেও দেয়, তাদের হাতেই সব দায়িত্ব দিয়ে দেবেন না। কিছু দায়িত্ব নিজের হাতেও রাখুন। ভিসার আবেদন এম্বাসিতে আপনার নিজ হাতে জমা দেবেন বা পোস্ট করবেন।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
৫. টাকা লেনদেনে সতর্কতা : কিছু মুনাফার জন্যই ব্যবসা পরিচালনা করে এজেন্সিগুলো। আপনার কাজ করার বিনিময়ে তারা ফি নেবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে ফি কত? এ বিষয়ে আপনাকে অবগত থাকতে হবে। স্টুডেন্ট ভিসার এজেন্সিগুলো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই কমিশন পেয়ে থাকে। কিছু অ্যাডমিন ফি ছাড়া শিক্ষার্থীর কাছ থেকে এখন আর কোনো এজেন্সিই টাকা নেয় না, যদি কেউ টাকা দাবি করে তাহলে আপনি অন্য এজেন্সি দেখতে পারেন। ওয়ার্ক পার্মিট বিষয়ক এজেন্সিগুলো মূলত বিশ্বের বিভিন্ন কোম্পানিতে স্কিল্ড ওয়ার্কার সরবরাহ করে। বিভিন্ন কোম্পানির অথরাইজড এজেন্সিগুলো ওই সব কোম্পানিকে কর্মী নিয়োগে সহায়তা করে, বিনিময়ে কোম্পানিগুলোই তাদের কমিশন দেয়। ঠিক স্টুডেন্ট ভিসার মতো। এ ছাড়া কিছু কনসালটেন্সি ফার্ম আছে যারা বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ, ব্যবসা পরিচালনা এবং এ সংক্রান্ত ভিসা সহায়তা করে থাকে। তবে আগে দেখে নিতে হবে ওই সব এজেন্সি ও ফার্ম কতটুকু ভ্যালিড এবং কারা তা পরিচালনা করে। মনে রাখবেন, প্রকৃত এজেন্সি ও ফার্মেরও নকল ভার্সন রয়েছে। কাজের আগে অবশ্যই যাচাই করে নেবেন আসল না নকল।
৬. ভিসা প্রতারণা এড়াতে অবশ্যই বিবেচনায় রাখবেন : অপরিচিত, অজ্ঞাত কোনো ব্যক্তিকে বা যাচাই না করে কারও হাতে ভিসার জন্য টাকা দেবেন না। কেউ কোনো দালালের সুপারিশ করলেও আগে দেখে নেবেন ব্যক্তিটি ওই দালালের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছে কিনা। সোশ্যাল মিডিয়ার পেজ ও গ্রুপের মাধ্যমে পরিচিত হয়ে কাজ করবেন না। অস্বাভাবিক পরিমাণ টাকা বিনিময় করবেন না। ‘১০০% গ্যারান্টি’ এই ধরনের কথায় সর্বোচ্চ সতর্ক থাকুন। পরিচিত ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা এবং সম্ভব হলে ভিসা আবেদনে সাহায্য প্রার্থনা করা। ভিসা আবেদন প্রক্রিয়ায় নিজেকে সংযুক্ত রাখা। নিজের বিবেচনা ও কমন সেন্স ব্যবহার করা।
একজন মানুষ যখন সর্বস্বান্ত হয়ে যায় তখন তার চেয়ে বেদনার আর কিছুই হতে পারে না। জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের স্বপ্ন সবারই থাকে, কিন্তু সে স্বপ্ন যখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয় তখন কেউ আর স্বপ্ন দেখার সাহস করতে পারে না। আসুন, নিজেরা সচেতন হই এবং অন্যদের সচেতন করি, যাতে সবার স্বপ্নই একদিন পূরণ হয়।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
ওমর এফ নিউটন : আয়ারল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ‘আইরিশ বাংলা টাইমস’ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক