উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও বৈশ্বিক সংযোগ

ড. মো. আবদুল জলিল
১৬ জুন ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও বৈশ্বিক সংযোগ

বিশ্বায়নের এই যুগে একটি দেশের সক্ষমতা নির্ধারিত হয় তার জ্ঞানসম্পদ ও বৈশ্বিক যোগাযোগের গভীরতায়। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফুল-ফান্ডেড স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমানো আমাদের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য কেবল ব্যক্তিগত উন্নয়নই নয়, বরং জাতীয় সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই সম্ভাবনার পুরোপুরি বিকাশ ঘটছে না। এর একটি বড় কারণ দেশে মানসম্পন্ন গবেষণার সুযোগ ও সংস্কৃতির অভাব।

গবেষণাবিমুখ শিক্ষাব্যবস্থা

বর্তমানে দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না বললেই চলে। গবেষণার বাজেট সীমিত, অবকাঠামো অপর্যাপ্ত, কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা শিক্ষকদের একাংশের গবেষণার প্রতি উদাসীনতা। প্রশাসনিক ও দলীয় আনুগত্য যেখানে ক্যারিয়ার অগ্রগতির প্রধান হাতিয়ার, সেখানে গবেষণায় সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করার প্রণোদনা দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটি তথ্যভিত্তিক, বিশ্লেষণধর্মী জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র না হয়ে শুধু পাঠ্যপুস্তকভিত্তিক ডিগ্রি বিতরণকারীতে পরিণত হচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে একজন মেধাবী ছাত্র গবেষণামূলক কাজ করে দুই-তিনটি ভালো মানের গবেষণাপত্র তৈরি করতে গেলে তাকে ব্যক্তিগত উৎসাহ ও নিজ উদ্যোগে লড়তে হয়। অথচ উন্নত বিশ্বের স্কলারশিপগুলো মূলত একাডেমিক সক্ষমতা ও গবেষণার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই প্রদান করা হয়। ফলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী শুধু পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাবে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে।

চীন ও ভারতের রূপরেখা : একটি প্রেরণার উৎস

চীন ও ভারতের অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। গত কয়েক দশকে এই দুটি দেশ পরিকল্পিতভাবে তাদের শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষায় পাঠানোর জন্য উৎসাহিত করেছে। তারা গবেষণাভিত্তিক প্রস্তুতির পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় নীতির মাধ্যমে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নত করেছে। ফলে আজ চীনা ও ভারতীয় নাগরিকরা পৃথিবীর প্রায় সব বড় বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক কোম্পানিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন।

এই অবস্থান তাদের দেশের জন্য অসাধারণ কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়াÑ এসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন নিয়মিত চীনা বা ভারতীয় অধ্যাপক, রিসার্চার বা প্রশাসক পাওয়া যায়। এতে একই দেশের নতুন শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সুন্দর নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে চীনা ও ভারতীয় পণ্যের বাজার সম্প্রসারণেও এই প্রবাসী উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশ : সম্ভাবনা অপার, প্রস্তুতি দুর্বল

বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে প্রতিবছর হাজার হাজার মেধাবী ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষার জন্য চেষ্টা করে। কিন্তু গবেষণার অভিজ্ঞতার অভাব এবং পর্যাপ্ত গাইডলাইনের অনুপস্থিতিতে তাদের অনেকের স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যায়। অথচ যদি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একটি মৌলিক গবেষণা সংস্কৃতি গড়ে তোলা যেত, শিক্ষকদের গবেষণায় অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক ও স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হতো, তা হলে শিক্ষার্থীরাও স্বভাবতই গবেষণায় আগ্রহী হতো।

সেই সঙ্গে সরকার বা বেসরকারি সংস্থাগুলো যদি প্রাথমিক গবেষণার জন্য ক্ষুদ্র অথচ নিয়মিত অনুদান প্রদান করত, তা হলে তরুণ শিক্ষার্থীরা অন্তত ১-২টি ভালো মানের গবেষণাপত্র তৈরি করতে পারত। এটিই হতে পারে উন্নত বিশ্বে স্কলারশিপ পাওয়ার টিকিট।

গবেষণাভিত্তিক উচ্চশিক্ষা : ভবিষ্যতের বিনিয়োগ

একটি দেশের উন্নয়ন শুধু পণ্য রপ্তানি বা প্রবাসী আয় দিয়ে টেকসই হয় না। প্রয়োজন জ্ঞাননির্ভর সমাজ গড়ে তোলা এবং বিশ্বজুড়ে নিজের দেশের প্রতিনিধিত্বকারী একটি প্রজ্ঞাসম্পন্ন জনশক্তি তৈরি করা। আমাদের ছেলেমেয়েরা যত বেশি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে, উচ্চশিক্ষিত হবে, গবেষণায় অবদান রাখবেÑ ততই আমাদের দেশের জন্য খুলবে নতুন দিগন্ত।

তাই এখনই সময় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার সংস্কৃতি গড়ে তোলা, শিক্ষকদের গবেষণায় সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক মানের রিসার্চ স্কিল অর্জনে সহায়তা করা। চীন বা ভারতের মতো হয়তো তাৎক্ষণিক ফল আসবে না, কিন্তু আগামী এক দশকের মধ্যেই এর সুফল জাতি হিসেবে আমরা পেতে শুরু করব।


প্রফেসর ড. মো. আবদুল জলিল : বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক

ডিন, ফ্যাকাল্টি অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ফ্যাকাল্টি অব সায়েন্স

বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকা