রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন সংযোজন

ড. একেএম শামছুল ইসলাম
১৫ জুন ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন সংযোজন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ, সংঘর্ষ ও অবিশ্বাসই ছিল সাধারণ চিত্র। যেখানে অধিকাংশ সময় রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সমাধান খোঁজা হয়েছে আন্দোলন ও উত্তেজনার মধ্য দিয়ে, সেখানে শান্তিপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতার প্রয়াস নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক এবং যুগান্তকারী দিক নির্দেশ করে। এ প্রেক্ষাপটে ২০২৫ সালের ১৩ জুন লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে অনুষ্ঠিত সৌহার্দপূর্ণ সাক্ষাৎ এবং সংলাপ এক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

সেই বৈঠকে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ও প্রক্রিয়া নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়। তারেক রহমান যুক্তি তুলে ধরে বলেন, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও জনগণের স্বার্থ বিবেচনায় রমজানের আগেই নির্বাচন আয়োজন করা উচিত। তার প্রস্তাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা উল্লেখ করেন যে, তিনি ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার ও বিচারপ্রক্রিয়ার অগ্রগতি নিশ্চিত হলে রমজানের আগেই ভোটগ্রহণ সম্ভব হবে।

এই গুরুত্বপূর্ণ আলাপচারিতায় দুই পক্ষের আন্তরিকতা, দায়বদ্ধতা ও পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শন ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। একজন অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকায় তারেক রহমান ছিলেন বাস্তবতানির্ভর ও কৌশলী এবং অপরদিকে প্রশাসনিক দিক থেকে প্রফেসর ড. ইউনূস ছিলেন বিচক্ষণ, উদার ও ভবিষ্যৎমুখী চিন্তাধারায় উজ্জীবিত। বৈঠকের পর প্রকাশিত যৌথ বিবৃতি থেকে একটি বিষয় সুস্পষ্ট উপলব্ধি করা যায় যে, মত ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ দুজন নেতা দেশ, জনগণ ও জাতির প্রশ্নে জাতীয় স্বার্থে শান্তিপূর্ণ উপায়ে একটি যৌক্তিক পথ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়েছেন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘আলোচনায় বসা’ কথাটি অনেক সময় দুর্বলতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। অথচ এই সংলাপ প্রমাণ করে যে, প্রকৃত দৃঢ়তা লুকিয়ে থাকে শান্তিপূর্ণ সমস্যা সমাধানের সক্ষমতায়। এক বিশ্লেষকের পর্যবেক্ষণ ‘বাংলাদেশে এই প্রথম একটা বড় রাজনৈতিক টানাপড়েন সমাধান হয়েছে সোফায়’ নিছক রসিকতা নয় বরং এটি সময়োপযোগী বাস্তবতা ও নতুন বাংলাদেশের নবতর রাজনৈতিক দর্শনকেই তুলে ধরে। এই অর্জন কেবল তাদের ব্যক্তিগত নয়, বরং জাতির সামনে আগামী দিনের রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতিতে স্থাপন করল এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

এটি ইতোমধ্যে প্রমাণিত যে, সদিচ্ছা থাকলে ও দেশপ্রেম বিবেচ্য হলে আন্তরিক সংলাপ এবং সমঝোতার মাধ্যমে একটি জাতি সংঘাত এড়িয়ে বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমত্যের পথে এগিয়ে যেতে পারে। এই সাফল্য রাজনীতিতে এক নতুন শিষ্টাচারের বার্তা বহন করে। যারা মনে করেন বাংলাদেশে আর কোনো পরিবর্তন আসবে না তারা এই দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের ভেতর দিয়ে নতুন করে আশার আলো দেখতে পারেন।

পরিশেষে বলা যায়, এই যুগান্তকারী যৌথ ঘোষণাপত্র এবং এর পেছনের সৌহার্দপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি একটি সুস্থ রাজনৈতিক ধারার ভিত্তি স্থাপন করতে পারেÑ যেখানে মতবিরোধ থাকলেও আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান খোঁজার প্রবণতা অব্যাহত থাকবে। এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে তারেক রহমান ও প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, যদি আমরা আলোচনার এই সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হই।


ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. একেএম শামছুল ইসলাম : পিএসসি, জি (অব.), সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক