কে ধরিবে হাল
গুনে গুনে আজ থেকে ঠিক একশ বছর না হলেও নিরানব্বই বছর তো হবেই, যখন সেই ১৯২৬ সালে কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতাটি লিখেছিলেন। কবিতাও বটে, গানও বটে; আসলে গান হিসেবেই লেখা হয়েছিল; কিন্তু নজরুলের গানে কবিতা থাকত, যেমন কবিতায়ও থাকত গান। সেটি ছিল একটি কঠিন সময়, যার কথা ওই কবিতার শুরুতেই বলা হয়েছে : ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার/লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার।’ পরের পঙ্ক্তি দুটিতে দুঃসময়কে আরও স্পষ্ট করে তোলা হয়েছে : ‘দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,/ছিঁড়িয়াছে পাল কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মত?’ কবিতাটি গান হিসেবে নজরুল স্বকণ্ঠে গেয়েও ছিলেন, কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে।
সময়টা বিশেষভাবে সংকটাপন্ন ছিল এ জন্য যে ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও নিঃস্বকরণ তো সমানে চলছিলই, উপরন্তু ওই বছরই ভয়ংকর এক হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বেধেছিল। ওই বিপদের মুখে নজরুলের কথাটি ছিল : ‘আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতেরে করিবে ত্রাণ?’ তিনি হিন্দু-মুসলমান জাতের ভেদাভেদ ভুলে গোটা জাতিকে বাঁচানোর জন্য রাজনীতিসচেতন সমাজমনস্ক মানুষদের ডাক দিয়েছেন। দুটি পঙ্ক্তি তো অবিস্মরণীয় : “‘হিন্দু না ওরা মুসলিম’Ñ ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন?/কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।” এর আগের দুটি পঙ্ক্তিতে আছে : ‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ/কাণ্ডারী, আজি দেখিব তোমার মাতৃ-মুক্তি-পণ।’ নজরুল বিশেষভাবে বাঙালি জাতির কথাই ভাবছিলেন। নজরুলের ওই কবিতায়ও উল্লেখ আছে পলাশীর কথা : ‘কাণ্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,/বাঙালির খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর।’ নজরুল বাঙালি জাতির কথাই বিশেষভাবে ভাবতেন এবং দেশকে মাতা হিসেবেই দেখতেন। ঔপনিবেশিক শোষণ এবং সামাজিক ব্যবস্থা তার চোখে ছিল পিতৃতান্ত্রিক; তিনি লড়েছিলেন পিতৃতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধেও।
১৯২৬ সালে রাজনীতিতে প্রধান শক্তিটা ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের। নজরুল কিন্তু ওই দলের ওপর ভরসা করেননি। এমনকি তিনি বীরও খোঁজেননি, খুঁজেছেন সমাজবিপ্লবীদের। সমাজবিপ্লবীরা তখন প্রধান রাজনৈতিক শক্তি নয়, কিন্তু তারা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। তারা কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। সে উদ্যোগে নজরুল তার বন্ধু মুজাফ্ফর আহমদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। উদ্যোগের মুখপত্র হিসেবে লাঙল নামের সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করা হয়েছে, নজরুল যার সম্পাদক। কলকাতায় লাঙল-এর দপ্তরে সাইনবোর্ডের সঙ্গে আস্ত একটি লাঙলই টানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সমাজবিপ্লবীরা মেহনতি মানুষ এবং তরুণদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কেবল যে ব্রিটিশকে তাড়াবে তা নয়, আশা ছিলÑ সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে মানুষকে মুক্ত করবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সে আশা পূরণ হয়নি। গত একশ বছরের ইতিহাস উন্নতির ইতিহাস অবশ্যই; কিন্তু সে উন্নয়ন মানুষকে মুক্ত করবে কি, উল্টো বন্ধনে আরও জর্জর করেছে। সেটা বিশ্বজুড়েই আজ সত্য; বাংলাদেশেও। উন্নয়ন যা ঘটেছে সেটা পুঁজিবাদী ধারায় এবং সে উন্নয়ন যেমন মানুষে মানুষে বৈষম্য ও বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি করেছে, তেমনি উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে প্রকৃতিকে ধ্বংস করবার কাজটিকে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
বাংলাদেশের মানুষের জন্য দুঃখটা অধিক দুঃসহ; কারণ এখানকার মানুষ মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছে, প্রাণ দিয়েছে এবং আশা করেছে মুক্তি আসবে বলে। কিন্তু মুক্তির বদলে যন্ত্রণা ও দুঃখই প্রধান সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কারণটাও আমাদের অজানা নয়। অল্পকথায় বলতে গেলে ঘটনাটি হচ্ছে পুঁজিবাদের জাঁকিয়ে বসা। পুঁজিবাদ এখন বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদী রূপ নিয়েছে। তার গায়ে যত আবরণ ছিল শোষণের বৃদ্ধিতে এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সেসবের সবই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। নগ্ন ও লজ্জাহীনভাবে সে তার ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে না শুধু, মাত্রাও বাড়িয়ে তুলেছে।
নজরুলের ওই কবিতায় পলাশীর উল্লেখ রয়েছে; সে উল্লেখ অনিবার্যই ছিল। পলাশীর তথাকথিত যুদ্ধে বণিক ইংরেজ জয়ী হয়েছে এবং তার সঙ্গে দেশি বণিক ও রাজপ্রাসাদের আমলারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল, নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে। বাণিজ্য নিয়ে যুদ্ধ এখন সারা পৃথিবীর প্রধান ঘটনা। সমাজতান্ত্রিক চীনের নেতারা পর্যন্ত এখন বাণিজ্য ছাড়া অন্য কিছু বোঝেন না। এবং চীনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এখন যে আমেরিকা, তার রাষ্ট্রপ্রধানের আসল পরিচয়ও একজন সফল বণিকেরই। বণিক হওয়ার ফলেই তিনি রাজনীতিক হতে পেরেছেন এবং দুর্দমনীয় ক্ষমতাপ্রাপ্ত একজন রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে যত প্রকার অনাচার করা সম্ভব সেগুলোর প্রায় কোনোটিই করা থেকে বিরত না থেকে এবং অপরাধের জন্য শাস্তি পেয়েও, দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হয়েছেন। তার জোরটা ছিল টাকার এবং গণমাধ্যমের ওপর কর্তৃত্বের। জোর আরও একটা ছিল, সেটা এই আশ^াস যে ক্ষমতা পেলে তিনি ধনীদের তো অবশ্যই গরিবদেরও ধনবান করে তুলবেন। তার নিকটতম সঙ্গী ও পরামর্শদাতা ছিলেন সে ব্যক্তি, যিনি বিশ্বের শীর্ষ ধনবান হিসেবে পরিচিত। ভোটদাতারা ভেবেছেন, এরাই হচ্ছে আদর্শ, এরাই বাপের বেটা; এদের পথেই চলা ভালো, তাহলে তারাও হয়তো ছিটেফোঁটা কিছু পেয়ে যাবেন। সম্প্রতি ট্রাম্পের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় পদত্যাগ করেছে ধনবান ইলন মাস্ক।
আমাদের কৈশোরে ‘আদর্শলিপি’ নামে এক ধরনের বইয়ের খুব প্রচলন ছিল; বইয়ের উদ্দেশ্য ছিল নতুন শিক্ষার্থীদের হাতের লেখা সুন্দর করার অনুশীলনের জন্য ছোট ছোট বাক্য সরবরাহ করা; বাক্যগুলো হতো নীতিকথামূলক, যাতে হাতের লেখা সুন্দর করার সঙ্গে নিজের মনটাকেও পরিচ্ছন্ন করার উপরি প্রাপ্তি ঘটতে পারে। একটি বাক্যের কথা খুব মনে পড়ে : ‘বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে’। তখনকার দিনে ছোট হওয়ার অর্থ ছিল উদার হওয়া, এক কথায় ভালো মানুষ হতে চেষ্টা করা। ডোনাল্ড ট্রাম্পও তার সব বাণী ও কর্মের মধ্য দিয়ে তার দেশবাসীর মাঝে ‘আদর্শলিপি’র ওই নীতিবাক্যটিই প্রচার করছেন। বলছেন বড় হওয়ার জন্য ছোট হও। তবে তার কাছে বড় ও ছোটÑ উভয়ের অর্থই সম্পূর্ণ বদলে গেছে। শুধু তার কাছে নয়, বস্তুত সারাবিশে^র কাছেই। বড় হওয়া মানে এখন আর ভালো মানুষ হওয়া বোঝায় না, বোঝায় ধনী হওয়া; অর্থাৎ মানবিক হওয়া নয়, দানবীয় হওয়া। বলা হচ্ছেÑ তুমি দৈত্য হও এবং দৈত্য হওয়ার জন্য তুমি ছোট হও, সংকীর্ণ ও স্বার্থপর হও। স্বর্গলাভের সেটিই উপায়। আমেরিকাকে বড় করার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পরা তার দেশবাসীকে আক্ষরিক অর্থেই ছোট হতে শিক্ষা দিচ্ছেন। বলছেন, ‘বিদেশিদের’ তাড়ানো চাই, বিদেশি পণ্য ঠেকাতে হবে, গরিব দেশের মানুষদের সাহায্যদান থামিয়ে দাও। এ এক ভিন্ন আমেরিকা। আমেরিকা অবশ্য আদপেই স্থানীয়দের দেশ নয়, স্থানীয়দের উৎখাত করে যে বিদেশিরা দেশটিকে দখল করে নিয়েছে, তাদেরই উত্তরসূরিরা এখন বলছে এদেশ আদতে তাদেরই দেশ; এবং এও বলছে যে নিজেদের শ্রমশক্তিকে সস্তায় বিক্রি করে আমেরিকাকে ‘বড়’ হতে যারা সাহায্য করেছে সেই বহিরাগতরা হচ্ছে অবাঞ্ছিত।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
এখন অবশ্য সব কিছুই ছোট হয়ে আসছে, বলা যায় ছোট করে ফেলা হচ্ছে। অনেকের সঙ্গে বসে বড় পর্দায় সিনেমা দেখা তো ভুলেই গেছি, ছোট ছোট পর্দায়, ঘরে বসে, একাকীও কখনও কখনও দেখে থাকি। টেলিফোন তো অনেক আগেই ছোটখাটো হয়ে গেছে, এখন ছোট্ট মোবাইলে সবকিছু পাওয়া যায়। বিশ^কোষ তো বটেই, এমনকি অভিধানও এখন আর ছাপানো অবস্থায় দরকার পড়ে না, কম্পিউটারের পর্দায়, এমনকি মোবাইল ফোনেও প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব; চাপ দিলেই এসে পড়ে। ওদিকে বড়কে আরও বড় করা? বিপজ্জনক কাজটা কিন্তু দুর্দান্তভাবে চলছে। এই যে বড় এবং ছোট করা, এর একটা সামাজিক ও দার্শনিক তাৎপর্য আছে বৈকি। সেটা হলো বড়কে ছোটর মধ্যে নিয়ে আসা। সেখানে আটকে রাখা। গত শতাব্দীর শেষ দিকেই উত্তর-আধুনিকতা নামে একটি মতবাদের একটা জোয়ার এসেছিল। উত্তর-আধুনিকতা বলছিলÑ বড় বড় ঘটনা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই; কারণ আসল জিনিস হলো ক্ষমতা এবং ক্ষমতা থাকে সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র ছড়িয়ে; পরিবার, দোকান, আদালত, অফিস-কাচারি, হাসপাতাল, জেলখানাÑ ক্ষমতা কোথায় নেই? আর ওই ক্ষমতার মোকাবিলা করাটাই হলো সমস্যা; মোকাবিলার দক্ষতা অর্জন করাটাই হলো মুখ্য ব্যাপার। প্রত্যেককে সেটা করা চাই। ওই ব্যাপারে দক্ষ হয়ে ওঠা চাই। জিনিসটা আসলে পুঁজিবাদেরই মূলমন্ত্র। বলছে, বড় বড় বিষয় নিয়ে ভাবার আড়ম্বর ছাড়ো, ছোট ছোট সমস্যাগুলো সমাধানে মনোযোগ দাও। তবে বড় বড়ই থাকবে, বড় বড় ধনীরা রাজত্ব করবে, আর লড়াইটা চলবে ছোট ছোট ক্ষেত্রে এবং ছোট ছোট দলে; রাষ্ট্র, সমাজ, বিশ্বব্যবস্থা এসব নিয়ে মাথা ঘামানোটা শ্রম ও সময়ের অপচয় বৈকি। এতে করে বঞ্চিত ছোটখাটো মানুষ আরও ছোট্ট হয়ে যাবে, এটাই হলো আকাক্সক্ষা।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!