চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁয় আমের দরপতন

ডাবলু কুমার ঘোষ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও আসাদুর রহমান জয়, নওগাঁ
১২ জুন ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁয় আমের দরপতন

ঈদের ১০ দিনের টানা ছুটিতে ক্রেতার অভাবে আম বিক্রি না থাকায় কোটি কোটি টাকার লোকসানের মুখে পড়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর আম ব্যবসায়ী ও আম চাষিরা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ইয়াছিন আলী বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম অন্য জেলার তুলনায় কিছুটা দেরিতে পাকে। সাধারণত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্ষীরসাপাত আম বাজারে উঠেছে এবং দ্বিতীয় সপ্তাহে ল্যাংড়া আসবে। ঈদুল আজহার ছুটি শুরু হয়েছে গত ৫ জুন থেকে চলবে ১৪ জুন পর্যন্ত। আর ছুটির কারণে এবার ভরা মৌসুমে ঢাকা, চট্টগ্রাম কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় আমের চাহিদা তেমন নেই, তারপর প্রচণ্ড গরমে একসাথে আম পেকে যাওয়ায় আম চাষিরা বিপাকে পড়েছেন। সাথে আড়তদারদের পক্ষ থেকে আম আড়তে বিক্রির সময় কেজি প্রতি ৩ টাকা কমিশন নিয়ে নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় স্থানীয় বাজারে আমের দরে পতন ঘটেছে।

জেলার প্রধান আমবাজার শিবগঞ্জের কানসাট, গোমস্তাপুরের রহনপুর এবং ভোলাহাটে আমবাজারগুলোতে আমের ভরা মৌসুমেও আড়তদারের কমিশন নিয়ে জটিলতা দেখা গেছে। কিছু আড়তদার আগের নিয়মে ৫৪ কেজিতে মণ ধরে, কেউ কেউ আবার আড়তদারদের নতুন নিয়ম কেজিতে ৩ টাকা কমিশন নিয়ে আম কেনাবেচা করছেন।

গোমস্তাপুর উপজেলা আমচাষি সমিতির সভাপতি মাইনুল বিশ্বাস জানান, গত ৫ জুন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের সর্বসম্মতিক্রমে কেজি দরে আম কেনাবেচার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সোমবার (৯ জুন) থেকে আড়তদারদের নতুন নিয়ম কেজিতে ৩ টাকা কমিশন নিয়ে জঠিলতা দেখা দেওয়ায় জেলায় আম বেচাকেনায় বাধাগ্রস্ত হয়।

তবে, গতকাল বুধবার আবারও রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে এক সভায় কেজি দরে আম বেচাকেনা এবং কেজিপ্রতি দেড় টাকা আড়তদার কমিশন নেবে বলে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ইয়াছিন আলী বলেন, এবার চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৭ হাজার ৫০৪ হেক্টর জমির আমবাগানে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পৌনে ৪ লাখ টন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা কৃষি বিভাগের।

কানসাটের আমচাষি মো. রবিউল ইসলাম বলেন, বরাবরই এ জেলার আম দেরিতে পাকে। ঈদের আগে থেকে তাপদাহ এবং প্রচণ্ড গরম অব্যাহত থাকায় গাছে এবার ক্ষীরসাপাত আম একটু বেশি পাকা দেখা যাচ্ছে। তবে, আজ-কাল বৃষ্টি হলেই এটা স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

শিবগঞ্জ আমবাজার আড়তদার রুহুল আমিন জানান, কোরবানি ঈদের ছুটি শেষে আগামী সপ্তাহে কানসাটসহ প্রতিটি আমবাজারে বেপারিদের আগমনের মধ্য দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের বাজার দারুণভাবে জমে উঠবে।

আর কানসাটে ক্ষীরসাপাত আম ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার টাকা (৪০ কেজিতে মন) দরে বেচাকেনা হচ্ছে।

এদিকে টানা ১০ দিন ব্যাংক বন্ধ, কুরিয়ার সার্ভিস ও পরিবহন বন্ধ থাকার কারণে চলতি মৌসুমে আমের রাজধানী খ্যাত নওগাঁর সাপাহার উপজেলার আম ব্যবসায়ী ও আম চাষিদের ব্যাপক লোকসানের আশঙ্কা করা হচ্ছে। সাপাহার উপজেলার আম ব্যবসায়ী ও আম চাষিরা জানান, ঈদের টানা ১০ দিনের ছুটিতে হঠাৎ করেই অতিরিক্ত গরমের কারণে আম্রপালি জাতের আম একযোগে পাকতে শুরু করেছে।

নওগাঁ জেলা প্রশাসন ও কৃষি অফিসের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আম্রপালি জাতের আম আগামী ১৮ জুন থেকে বাজারে আসার কথা। কিন্তু অতিরিক্ত গরম, বৈরী আবহাওয়া, গাছে আগাম মুকুল আসাসহ নানাবিধ কারণে এ বছর আম্রপালি জাতের আম ৮ থেকে ১০ দিন আগে পাকতে শুরু করেছে।

সাপাহারের সিমু শিপলা বাণিজ্যালয়ের স্বত্বাধিকারী আম ব্যবসায়ী ও আমচাষি সাখাওয়াত হোসেন জানান, কোটি কোটি টাকা খরচ করে লাভের আশায় তিনি ৪০০ বিঘা জমিতে বিভিন্ন জাতের আমগাছ লাগিয়েছিলাম। এ বছর গাছে আম ধরেছে ভালো। কিন্তু সরকারি আমের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আম নামাতে গিয়ে তারা পড়েছেন বিপাকে। এ বছর সরকারি আমের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আমন নামাতে গিয়ে আমরা ব্যবসায়ীরা ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছি। ঈদের টানা ১০ দিন ছুটি থাকায় ব্যাংক বন্ধ, কুরিয়ার সার্ভিস ও পরিবহন বন্ধ থাকায় স্থানীয় বাজারে আমের তেমন কোনো বেচাকেনা নেই। তিনি বলেন, প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ মণ আম পচে যাওয়ার কারণে ফেলে দিতে হচ্ছে।

সাখাওয়াত হোসেন অভিযোগ করে বলেন, আমের ক্যালেন্ডার প্রকাশের দিনে বলা হয়েছিলÑ যদি কারও আম অগ্রিম পেকে যায়, তাহলে উপজেলা কৃষি অফিস ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অনুমতি সাপেক্ষে গাছ থেকে আম পাড়া এবং বিক্রি করার অনুমতি দেওয়া হবে। কিন্তু গত কয়েক দিন ঈদের ছুটিতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা কৃষি অফিসারের কাছে আবেদন করে আম পাড়ার কোনো অনুমতি তিনি পাননি। এতে সাখাওয়াত হোসেনের প্রতিদিন প্রায়ই লক্ষাধিক টাকার আম অবিক্রিত থাকছে এবং তা ফেলে দিতে হচ্ছে।

সাপাহার উপজেলার বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্কের স্বত্বাধিকারী সোহেল রানা জানান, জেলা প্রশাসন ও জেলা কৃষি অফিসের বেঁধে দেওয়া আমের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এ বছর আম পাড়া সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, বৈরী আবহাওয়া, আর অতিরিক্ত গরমের কারণে ক্যালেন্ডারের ঘোষিত তারিখের ১০ থেকে ১২ দিন আগেই আম পেকে গেছে। বিপুল পরিমাণ পাকা আম নিয়ে আমরা পড়েছি ভীষণ বিপদে। প্রতিদিন প্রত্যেকটা আম চাষির ও ব্যবসায়ীদের লাখ লাখ টাকা লোকসান হচ্ছে। ক্রেতার অভাবে আম বিক্রি না হয় অবিক্রিত আম ফেলে দিতে বাধ্য হচ্ছি আমরা।

সোহেল রানা আরও বলেন, আম একটি পচনশীল খাদ্য সামগ্রী। এটা সংরক্ষণ করার কোনো পদ্ধতি এখনও আমাদের কাছে আসেনি। তাই প্রতিদিনের আম প্রতিদিনই বিক্রি করতে হয়। কিন্তু ১০ দিন ঈদের ছুটি থাকার কারণে ব্যাংক বন্ধ, কুরিয়ার সার্ভিস পরিবহন বন্ধ সর্বোপরি প্রকৃত ব্যবসায়ীদের হাতে নগদ টাকা না থাকায় ব্যবসায়ীরা আম কেনাবেচা নিয়ে ভীষণ বিপদে পড়েছে। আমের রাজধানী খ্যাত সাপাহার উপজেলায় আম চাষিদের কথা বিবেচনা করে ব্যাংক খোলা রাখলে কুরিয়ার সার্ভিস এবং পরিবহন ব্যবস্থা সচল রাখলে এ ক্ষতি উত্তরণ করা সম্ভব হতো। তিনি বলেন, নওগাঁর আম্রপালি ও নাক ফজলি আমের চাহিদা দেশজুড়ে রয়েছে। কিন্তু সংরক্ষণের অভাব এবং কেনা-বেচার সমস্যার কারণে আম সারাদেশে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। আর এ কারণে ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, গত ২০২৪ সালের আমের ক্যালেন্ডারে আম পাড়ার যে তারিখ নির্ধারণ করা ছিল চলতি ২০২৫ সালে তার থেকে আম পাড়ার তারিখ তিন দিন এগিয়ে আনা হয়েছে।