আবার করোনার অশনিসংকেত সতর্কতা জরুরি

চপল বাশার
১১ জুন ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
আবার করোনার অশনিসংকেত সতর্কতা জরুরি

ভয়াবহ করোনাকাল কি আবার ফিরে আসছে? আমরা কি আবার প্রাণঘাতী করোনা মহামারীর কবলে পড়ব? ২০২০ সালের মার্চে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস হানা দেয়। করোনার আক্রমণে বিপর্যস্ত হয় জনজীবন, স্থবির হয়ে যায় অর্থনৈতিক কর্মকা-। লাখ লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, প্রাণহানি ঘটে বিপুলসংখ্যক মানুষের।

গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের একটি নতুন ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাব ঘটেছে। ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ২২টি দেশে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি সপ্তাহে তিন শতাধিক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে নতুন করোনায়।

করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টকে চিহ্নিত করা হয়েছে এনবি. ১.৮.১ নামে। এটি আগের মতোই চীন থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। হংকং, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডে নতুন করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও এসে গেছে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ছে বলে খবর আসছে। সে দেশে সাত সহস্রাধিক মানুষ নতুন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা যায়।

পশ্চিমবঙ্গে ৭৪৭ জন করোনায় আক্রান্ত। পরিস্থিতি পর্যালোচনায় স্বাস্থ্যকর্তা ও চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিমে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। করোনা ভাইরাস দ্রুত সংক্রমিত হয়। বিগত করোনাকালে করোনা ভারতে ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হওয়ার পর বাংলাদেশেও চলে আসে এবং এখানেও রোগটির ব্যাপক সংক্রমণ হয়। দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে। দুটি দেশই জনবহুল, সীমান্তের এপারে-ওপারে মানুষ কাছাকাছি বাস করে। তাই নৈকট্যের কারণে করোনার মতো অতিক্ষুদ্র ভাইরাস ওপার থেকে এপারে সহজেই চলে আসতে পারে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে একশ জনের মতো করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং বেশ কয়েকজনের প্রাণহানিও ঘটেছে। করোনা ভাইরাসের নতুন একটি ধরন শনাক্ত হওয়ায় এবং করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার ফলে জনমনে উদ্বেগ বাড়ছে। সে অনুযায়ী কি করোনা ভাইরাস মোকাবিলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে?

আগে ধারণা করা হতো করোনা ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয় স্পর্শের কারণে। পরে দেখা যায় ভাইরাসটি বাতাসে ভাসতে পারে কিছুক্ষণ এবং এভাবেও সংক্রমণ ঘটায়। সীমান্ত এলাকায় তাই বাতাসের মাধ্যমে ভাইরাসটি এসে মানবদেহে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি স্থানে যেহেতু করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট চিহ্নিত হয়েছে, তাই আমাদের সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। এখনই যদি সংক্রমণ প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা হলে নতুন করোনা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। বিগত করোনাকালের মতো বিপর্যয় কেউ চায় না।

করোনার প্রথম প্রাদুর্ভাব

বাংলাদেশে করোনার প্রথম প্রাদুর্ভাব হয় ২০২০ সালে। সেই বছরের ৮ মার্চ এ দেশে প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। তার দশ দিন পর ১৮ মার্চ করোনায় প্রথম মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এর পরই করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে প্রাণহানি। রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য সরকার মার্চেই দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। সেই সঙ্গে সারাদেশে সাধারণ ছুটি তথা লকডাউন ঘোষণা করা হয়। সরকারি-বেসরকারি সব অফিস এবং শিল্পকারখানা বন্ধ থাকে। তবে গার্মেন্ট কারখানাগুলো খোলা রাখা হয়। ব্যাংকও খোলা থাকে সীমিত সময়ের জন্য।

সরকারের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ কঠোর স্বাস্থ্যবিধি আরোপ করেছিল। স্বাস্থ্যবিধিতে ছিল, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়া, মাস্ক পরিধান, জনসমাবেশ ও সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা, নিয়মিত হাতধোয়া ইত্যাদি। গণপরিবহন চলাচলেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। বাস-ট্রেন চলাচল বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকে।

করোনা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছিল। তাই শুরুতে লকডাউন কার্যকর হয়, সবাইকে মাস্ক পরতে দেখা যায়। রাজধানী ঢাকাসহ সব শহরের রাস্তাঘাট ফাঁকা দেখা যায়। এতে করোনার প্রকোপ কিন্তু কমেনি, বাড়তেই থাকে। এক সময় দেখা গেল মানুষ করোনার ভয়ভীতি উপেক্ষা করে রাস্তায় নামছে, স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। লকডাউনের মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ানো হয়, স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে কার্যকর করার জন্য পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, বিজিবি, আনসার মোতায়েন করা হয়। তার পরও দেখা যায় কিছু লোক স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করেই চলেছে। পক্ষান্তরে সচেতন মানুষরা স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মেনে চলেছেন, নিজেদের ঘরের মধ্যে আবদ্ধ রেখেছেন মাসের পর মাস।

করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর ২০২২ পর্যন্ত দুই বছর এই ভাইরাসের আক্রমণ ছিল প্রচ-। ২০২৩ সালে সংক্রমণের ব্যাপকতা কমে আসে। হিসাব করলে দেখা যায় করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও আগ্রাসন বাংলাদেশে পুরোদমে ছিল তিন বছর। এই তিন বছরে জনজীবন ও জাতীয় অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

করোনাকালের ক্ষয়ক্ষতি

তিন বছরে করোনায় বাংলাদেশে কত মানুষ আক্রান্ত হয়েছে? প্রাণহানির সংখ্যাই বা কত? এর সঠিক উত্তর পাওয়া কঠিন। সরকারি হিসাবে আক্রান্ত ও মৃত্যুর যে সংখ্যা দেওয়া হয় সেটা সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে। কিন্তু এর বাইরেও তো রোগাক্রান্ত বিপুলসংখ্যক মানুষ ছিলেন যারা হাসপাতালে যাওয়ার সুযোগ পাননি, বাড়িতেই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন অথবা মারা গেছেন। এসব মানুষকে সরকারি হিসাবে ধরা হয়নি।

সরকারের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টার (এনডিআরসিসি) ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয় ওইদিন অর্থাৎ ৪ এপ্রিল, ২০২৩ পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে ২০ লাখ ৩৮ হাজার ৩৮ জনকে করোনায় আক্রান্ত বলে শনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ২৯ হাজার ৪৪৬ জনের মৃত্যু হয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সরকারি রিপোর্টটির ভিত্তি সরকারি- বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে প্রাপ্ত তথ্য। এর বাইরে যারা নিজের বাড়ি বা অন্যত্র চিকিৎসা নিয়েছেন অথবা মারা গেছেন তাদের হিসাব পাওয়া না গেলেও অনুমান করা যায়। নিশ্চয়ই তা কয়েকগুণ বেশি হবে।

করোনায় আক্রান্ত অনেকেই সে সময় চেষ্টা করেও হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেননি জায়গার অভাবে। সরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তির জায়গা ছিল না। বেসরকারি হাসপাতাল ব্যয়বহুল, তার পরও সেখানে স্থানাভাব। অনেক রোগী বাড়িতে থেকে নিজেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন অথবা করতে পারেননি। রোগী নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছোটাছুটি, ভর্তি হতে পারলেও সেখানে ডাক্তারের অভাব, অক্সিজেনের অভাব, এসব ছিল নিয়মিত ঘটনা। অনেকেরই হয়তো মনে আছে, চট্টগ্রামে এক বিশিষ্ট শিল্পপতি করোনায় আক্রান্ত হয়ে একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানে তিনি ২০ জনের একটি ওয়ার্ডে বেড পেয়েছিলেন। ২০ জনের ওয়ার্ডে অক্সিজেন সিলিন্ডার ছিল ১০টি। পর্যাপ্ত অক্সিজেন না পেয়ে ধনী শিল্পপতি সেই ওয়ার্ডেই মারা যান। এ খবর গণমাধ্যমে এসেছিল।

করোনাকালে হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাব নিয়ে অনেক রিপোর্ট সে সময় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। যাদের সামর্থ্য ছিল, তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে অথবা ভাড়া করে বাড়িতে আনতেন রোগীর চিকিৎসার জন্য। এক কথায় বলা যায়, করোনা মহামারী মোকাবিলার জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা তখন দেশে ছিল না। কারণ এমন মহামারী বাংলাদেশে আগে হয়নি, সরকার ও স্বাস্থ্য বিভাগের এ সম্পর্কে অভিজ্ঞতাও ছিল না।

আগাম প্রস্তুতি চাই

তিন বছরব্যাপী মহামারীর পর এখন তো সরকার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সংশ্লিষ্ট সব বিভাগ এবং জনগণ যথেষ্ট অভিজ্ঞ- এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট যখন ঘরের পাশে এসে গেছে, তখন তা মোকাবিলার জন্য আগাম প্রস্তুতি এখনই নিতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালকে এখনই তৈরি থাকতে হবে করোনার চিকিৎসার জন্য। প্রয়োজনীয় ওষুধ, ভ্যাকসিন ও অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি তৈরি এবং প্রয়োজনে তার যথাযথ প্রয়োগের ব্যবস্থাও থাকা দরকার।

মনে রাখতে হবে নতুন করোনা ভ্যারিয়েন্ট হয়তো মারাত্মক হতে পারে। তাই আগাম সতর্কতা জরুরি।


চপল বাশার : সাংবাদিক ও লেখক