রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের হতাশার দায়িত্ব নেবে কে?

রহমান মৃধা
১০ জুন ২০২৫, ১৫:১২
শেয়ার :
রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের হতাশার দায়িত্ব নেবে কে?

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং বর্তমান শাসনব্যবস্থার উচ্চপর্যায়ের নেতারা বারবার দেশের তরুণদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন—চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠো। এ বক্তব্য নিঃসন্দেহে ইতিবাচক, প্রগতিশীল এবং যুগোপযোগী। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এই উদ্যোগগুলো কোথায় গিয়ে থেমে যাচ্ছে? কেন থেমে যাচ্ছে?

দেশের বাস্তবতায় আজ অনেক তরুণ-তরুণী, প্রবাসীর স্বজন, এমনকি পঞ্চাশোর্ধ বয়সের মানুষও নিজেদের ক্ষুদ্র সঞ্চয় আর সীমিত মূলধন নিয়ে হাঁস-মুরগি পালন, মাছ চাষ, সবজি উৎপাদনের মতো ক্ষুদ্র উদ্যোগে এগিয়ে আসছেন। লক্ষ্য একটাই—নিজেদের পায়ে দাঁড়ানো এবং দেশের উৎপাদনে অংশ নেওয়া।

বিশেষ করে প্রবাসে কর্মরত লাখ লাখ রেমিট্যান্স যোদ্ধা—যাঁরা দিনের পর দিন বিদেশের মাটিতে কঠিন শ্রমে উপার্জিত অর্থ পাঠাচ্ছেন—তাঁরা পরিবারকে শুধু ভরণপোষণই নয়, স্বপ্ন গড়ার সামর্থ্য দিচ্ছেন। এমন অনেক পরিবারেই বিদেশফেরত স্বজনদের অর্থে গড়ে উঠেছে কৃষি খামার, হাঁস-মুরগির ফার্ম, পুকুরভিত্তিক মাছ চাষ প্রকল্প, নারকেল-খেজুর বাগান ইত্যাদি। আমরাও এই ধারার অংশ। আমাদের পরিবারের সদস্যরাও বছর বছর ধরে দেশ থেকে দূরে থেকে এভাবেই গ্রামের মাটিতে স্বপ্ন বুনেছেন।

কিন্তু এসব স্বপ্ন ধ্বংস হচ্ছে একেবারে মৌলিক জবাবদিহিতার অভাবে।

সম্প্রতি মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার নহাটা ইউনিয়নের নহাটা-শালধা গ্রামে আমাদের পরিবারের মালিকানাধীন একটি বহুমুখী কৃষি খামারে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। রাতারাতি শতাধিক হাঁস হঠাৎ মারা যায় (সংযুক্ত ছবিতে দেখা যাবে)। পাশাপাশি, পুকুরে চাষ করা শতাধিক মনের বেশি মাছ একযোগে মারা যায়। আতঙ্কিত হয়ে আমরা বারবার ফোন করেছি উপজেলার কৃষি ও প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের—কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি। কেউ ফোন ধরেনি, কেউ খোঁজ নিতে আসেনি।

পরে আমরা নিজেরাই গিয়ে দেখি খামারের ভেতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মরা হাঁসের দেহ আর পচে যাওয়া মাছের দগ্ধ গন্ধ। দৃশ্যটা ছিল গা শিউরে ওঠার মতো।

শুধু একটা পরিবারের ক্ষতি নয়—এ এক বৃহৎ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি।

একটি খামারের মৃত্যু আর প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা আমাদের উন্নয়নের মুখোশ খুলে দেয়।

প্রশ্ন উঠতে বাধ্য—এই ক্ষতির দায় কে নেবে?

উপজেলা পর্যায়ে দেশের সর্বত্র আছে কৃষি অফিস, মৎস্য অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ দপ্তর, যুব উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ অফিস। সবখানে আছে বেতনভুক্ত কর্মকর্তা, মাসিক সম্মানী, যানবাহন, ফোন সংযোগ, এমনকি প্রশিক্ষণ বাজেট। কিন্তু তারা কি আদৌ মাঠে কাজ করেন? বহু উদ্যোক্তা বলছেন—বছরে একবারও তাদের দেখা মেলে না। কেউ গ্রামে যান না, কেউ ফোন ধরেন না, কেউ সমস্যার সমাধান করতে আগ্রহী নন।

দেশজুড়ে নারকেল গাছের চাষ বেড়েছে—এ কথা আমরা বহু বছর ধরেই শুনে আসছি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে: রাজধানী থেকে মফস্বল পর্যন্ত ভালো মানের একটি ডাব পাওয়া এতটা কঠিন কেন? আমার নিজের পরিবারের জমিতে শতাধিক নারকেল গাছ থাকা সত্ত্বেও একটি ভালো ডাব পাওয়া মুশকিল। আবার শত শত খেজুর গাছ অযত্নে পড়ে আছে—কারণ নেই পরিচর্যা, নেই বিপণনব্যবস্থা, নেই নির্দেশনা। সরকারি লোকজন আছে, অফিস আছে, বরাদ্দ আছে—কিন্তু নেই কার্যকারিতা।

সবচেয়ে দুঃখজনক দিক হলো, যাঁরা সারা জীবন প্রবাসে কষ্ট করে অর্থ পাঠান, তাঁদের যখন সর্বাধিক প্রয়োজন রাষ্ট্রের সেবা ও সহায়তা, তখন প্রশাসনের এই বিশাল কাঠামো নিস্পৃহ ও নিশ্চুপ।

এ কী রাষ্ট্র? এ কি উন্নয়ন?

উন্নয়নের জোয়ার যদি শুধু মেগা প্রকল্পে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তা এক অর্ধসত্য।

প্রকৃত উন্নয়ন হলো—মাঠপর্যায়ে জনগণের পাশে দাঁড়ানো, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাকে বাঁচিয়ে রাখা, প্রবাসীর পাঠানো অর্থকে পুঞ্জিভূত সম্ভাবনায় রূপান্তর করা।

সেই ক্ষমতা যদি রাষ্ট্র না রাখে, তাহলে তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার আহ্বান নিছক এক রাজনৈতিক বাণীতে পরিণত হয়।

আমরা যারা প্রবাসে থেকে দেশের কথা ভাবি, যাঁরা পরিবারকে সহায়তা করি, যাঁরা রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড শক্ত রাখি রেমিট্যান্স দিয়ে—আমরা কী পাচ্ছি বিনিময়ে?

প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তরগুলো কঠিন:

  •  এই অযোগ্যতা, দুর্নীতি আর অকার্যকারিতার দায় কে নেবে?

  •  উন্নয়নের নামে প্রশাসনিক ব্যর্থতা আর কতদিন চলবে?

  •  নির্বাচনের পরেই কি এসব সমস্যার সমাধান হবে?

  •  রাষ্ট্র কি এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নেবে?

নাকি এই প্রশ্নগুলোর জবাব পেতে আমাদের যেতে হবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে? তাঁর মতো একজন নাগরিক-অভিভাবকের কাছে? কারণ যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়ে আছেন, তাঁরা তো আজকাল অনেক ব্যস্ত—রাজনীতি আর মিডিয়া-শোডাউনে।

সবশেষে বলতে চাই:

উন্নয়ন কেবল ব্রিজ, ফ্লাইওভার আর টানেলের গল্প নয়।

উন্নয়ন হলো—একটি হাঁস-মুরগির খামারকে রক্ষা করা, একটি ক্ষুদ্র পুকুরের মাছকে মরতে না দেওয়া, একটি স্বপ্নবান উদ্যোক্তার পাশে দাঁড়ানো।

উন্নয়ন মানে মাঠপর্যায়ে দায়িত্বশীল প্রশাসন, জনসংযোগ, জবাবদিহিতা, এবং সক্রিয় সহায়তা।

এই জাতীয় অব্যবস্থার অবসান চাই। অবিলম্বে।

আমরা অপেক্ষা করছি—একটি জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রের, কার্যকর পরিবর্তনের, এবং সত্যিকারের নাগরিক বন্ধুত্বের।

লেখক: গবেষক ও লেখক (সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)