জলবায়ু পরিবর্তন ও নারীর স্বাস্থ্য

মৌলি আজাদ
০৪ জুন ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
জলবায়ু পরিবর্তন ও নারীর স্বাস্থ্য

আমাদের জেনারেশন আজ থেকে ৩০ বছর আগে বাংলা পরীক্ষায় নিয়মিত ‘জলবায়ুর পরিবর্তনের বিপর্যয় এবং বাস্তব জীবনে এর প্রভাব’ সম্পর্কে রচনা লিখত। বলতে গেলে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সবার পড়া এ রচনা। তখন শুধু রচনা লেখার জন্যই বোধ হয় জলবায়ু পরিবর্তনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়া হতো। বাস্তব জীবনে এর প্রভাব কতটা ভয়াবহ বা মারাত্মক তা হয়তো ভেবে দেখা হয়নি তখন। আজ ৩০ বছর পর আমরা যেন এর বাস্তব প্রভাব রীতিমতো উপলব্ধি করছি। আজ গরমে তাপপ্রবাহের মাত্রা এমন যে এসি রুমে থাকলেই কেবল সামান্য আরাম মেলে, কিন্তু এসি রুমে কতক্ষণ? এসি ঘর থেকে বের হলেই অসহ্য তাতানো গরম। মনে হয়, শরীরে কেউ যেন গরম সিসা ঢেলে দিচ্ছে। এই জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় ভিকটিম হচ্ছি আমরা নারীরা। তাপপ্রবাহ আমাদের নারীদের ওপর ভয়ংকর যে প্রভাব ফেলছে বা কোন পর্যায়ে সে প্রভাব পৌঁছেছে তা জানতে হলে সম্প্রতি প্রকাশিত পত্রিকার রিপোর্ট পড়া যেতে পারে।

একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশে তীব্র তাপপ্রবাহ বাড়ছে। এর প্রভাবে দেশের অন্তঃসত্ত্বা নারীরা বড় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন। এর অন্যতম হলো- সময়ের আগে সন্তান প্রসবের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে তাপপ্রবাহের দিন আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে ৩৪ দিন অন্তঃসত্ত্বা নারীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ তাপপ্রবাহ ছিল।

বাংলাদেশে বছরে গড়ে ৬০ দিনের মতো তাপপ্রবাহ থাকে। ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর তাপমাত্রাকে মৃদু তাপপ্রবাহ হিসেবে গণ্য করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ৪০ ডিগ্রির ওপর হলে তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়।

ক্লাইমেট সেন্ট্রাল বলছে, বাংলাদেশের শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিপদাপন্ন চট্টগ্রাম। ২০২০ থেকে ২০২৪ সময়ে শহরটিতে গড়ে ৩০টি অতিরিক্ত প্রসবকালীন ঝুঁকিপূর্ণ তাপমাত্রার দিন দেখা গেছে, যা দেশের মোট ঝুঁকিপূর্ণ দিনের ৬১ শতাংশ, ঢাকায় যা ৮ শতাংশ। চট্টগ্রামকে তাপমাত্রার ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ক্লাইমেট সেন্ট্রাল।

গত বছরের এপ্রিলে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাপপ্রবাহের ফলে বিশ্বে প্রতি ১৬ সেকেন্ডে একটি মৃত সন্তানের জন্ম হয়। আর প্রতিবছর দেড় লাখ অপুষ্ট শিশু (গর্ভাবস্থায় ৩৭ সপ্তাহের আগেই জন্ম) পৃথিবীতে আসে। ২৭ দেশের তথ্য পর্যালোচনা করে ওই গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মাত্র ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়ার কারণে অকালে সন্তান প্রসব এবং মৃত শিশুর জন্মের হার ৫ শতাংশ বেড়েছে। এই ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে।

তাপপ্রবাহের কারণ : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অতিরিক্ত গরমের জন্য মূলত দায়ী তেল-গ্যাস-কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার।

নারীর ওপর প্রভাব : ১. অন্তঃসত্ত্বা নারীর শরীরের তাপের চেয়ে বেশি অথবা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে তাপমাত্রা গেলে রক্তের প্রবাহ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। এটি গর্ভের শিশুর পুষ্টি ও অক্সিজেনে ঘাটতি সৃষ্টি করতে পারে। এতে পানিশূন্যতা, হরমোনে পরিবর্তনজনিত ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়, ফলে প্রসবের সূত্রপাত ঘটায়। অন্তঃসত্ত্বা নারী ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা শরীরে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

২. ৭৫ বছরের বেশি বয়সী নারী, শিশু, শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি তাপপ্রবাহে অত্যন্ত উচ্চঝুঁকিতে থাকেন।

নেদারল্যান্ডসে করা একটি গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, তাপমাত্রা বাড়ার কারণে পুরুষদের তুলনায় নারীরা বেশি উচ্চঝুঁকিতে থাকেন। বিভিন্ন তাপপ্রবাহ-পরবর্তী সময়ে মারা যাওয়া মানুষের তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ওই গবেষণা করা হয়।

৩. মেনোপজের পর তাপপ্রবাহে নারীর কষ্ট দ্বিগুণ বাড়ে।

৪. তাপপ্রবাহের ফলে অন্তঃসত্ত্বা নারীর হরমোনাল ইমব্যালেন্স থাকে। অতিরিক্ত তাপমাত্রার ফলে মাথা ঘোরা, দুর্বলতা, বমি ভাবের সৃৃষ্টি হয়।

প্রতিকার : ১. অন্তঃসত্ত্বা নারীর জন্য চরম গরমে বিশেষ চিকিৎসাসেবা, তাপ সহনশীল হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ দরকার।

২. জলবায়ুবান্ধব স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করা দরকার।

৩. যেকোনো মৌসুমেই মাসিকের সময় পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার গ্রহণ করা আবশ্যক। নইলে রক্তক্ষরণের কারণে একজন নারী পানিশূন্যতায় ভুগতে পারেন।

৪. এ সময়ে আরামদায়ক পোশাক পরতে হবে।

৫. এ সময়ে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে।

৬. এ বিষয়ে টিভি ও পত্রিকায় প্রচারণা চালাতে হবে। প্রয়োজনে বছরের তাপপ্রবাহের সময় শহরে/গ্রামের গলিতে মাইকিং করা যেতে পারে।

আমাদের দেশে শহুরে সচেতন নারীরা তাপপ্রবাহে কষ্ট পেলে হয়তো তা থেকে প্রতিকারের নানা পথ বেছে নিতে পারেন কিন্তু গ্রামীণ নারীদের এ ক্ষেত্রে অবস্থা কী? গ্রামীণ নারীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের নিয়ে সচেতন নন। তারা ডাক্তারের পরামর্শ তো দূর নিজের ঘনিষ্ঠ লোকদেরও নিজের কষ্টের কথা বলতে চান না। ফলে গ্রামীণ অন্তঃসত্ত্বা নারীরা বারবার গর্ভপাতের সম্মুখীন হন। প্রচ- গরমে যে কোনো বয়সের গ্রামীণ নারীরা কষ্টকর কাজ করেন, ফলাফল অসুস্থতা। আমাদের সমাজে নারীরা তাদের কষ্টের কথা বলেন না বলেই তাদের অসুবিধার কথা কেউ জানতে পারেন না। তাপপ্রবাহের কষ্টের কথা হয়তো তারা ধর্তব্যেই আনেন না। এর ফলে নারী অজ্ঞান পর্যন্ত হয়ে যেতে পারেন, তা তারা বেমালুম ভুলে যান।

শহর, গ্রাম যেখানেই নারীর বসবাস হোক, নারীর উচিত বর্তমান প্রচ- গরমে নিজেকে নিয়ে সচেতন হওয়া। ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া, ভালো খাদ্যগ্রহণ, প্রচ- গরমে ভারী কাজ কমিয়ে দেওয়া। সেই সঙ্গে সব নারীর তথা আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে- এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে। বড় পরিসরে না পারি, ছোট পরিসরে তো আমরা প্রচ- গরম থেকে মুক্তি পেতে গাছ লাগাতে পারি, রাস্তায় পানি ছিটিয়ে দিতে পারি, বৈদ্যুতিক জিনিসের অতিরিক্ত ব্যবহার কমাতে পারি।

পৃথিবীর উষ্ণতা কমলে আমরাই ভালো থাকব। তাই পরিবেশের বিষয়ে সচেতন হওয়া ছাড়া আমাদের উপায় নেই।


মৌলি আজাদ : লেখক ও প্রাবন্ধিক