জনতার হৃদয়ে আরেক জিয়া
মাত্র ৪৮ ঘণ্টার নোটিশে ১৯৮১ সালের ২৯ মে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন। ২৯ মে রাতে স্থানীয় সার্কিট হাউসে ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে উচ্চাভিলাষী সেনাবাহিনীর কয়েকজন বিপথগামী সদস্য ৩০ মে ভোররাতে ঘুমন্ত জিয়াউর রহমানকে কাপুরুষের মতো ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। যোগাযোগব্যবস্থা এখনকার মতো তখন উন্নত ছিল না। ঢাকায় আমরা যখন জিয়াউর রহমানের শহীদ হওয়ার খবর নিশ্চিত হই, তাৎক্ষণিক ঢাকায় প্রতিবাদে মিছিল বের করে বঙ্গভবনের দিকে যাই। এদিনই ঢাকায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। এ কারণে সারাদেশের ছাত্রদলের নেতারা ঢাকায় ছিলেন। তারাও ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সেদিন আমি যুবদলের পক্ষ থেকে স্লোগান ধরেছিলাম ‘জিয়া তোমায় কথা দিলাম স্বাধীনতা রাখব, জিয়া তোমায় কথা দিলাম গণতন্ত্র রাখব।’
জিয়াউর রহমানের শাহাদাত হওয়ার খবর দেশ ছাড়িয়ে বন্ধু রাষ্ট্রের কাছে পৌঁছলে সেসব দেশের জনগণও শোকাভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। বাংলাদেশের শোকাভিভূত মানুষের ঘরে চুলা জ্বলেনি।
জিয়াউর রহমানের মতো এমন একজন মানুষকে হত্যার পর তার মরদেহ গুমও করা হয়েছিল। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। পরে রাঙ্গুনিয়া পাহাড়ের পাদদেশে (পরে শোনা যায় ব্রিগেডিয়ার আসম হান্নান শাহ’র নেতৃত্বে) মাটি খুঁড়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মরদেহ পাওয়া গেলে ১ জুন প্রথমে চট্টগ্রাম সেনানিবাস, পরে হেলিকপ্টারে ঢাকায় আনা হয়। তবে তার আগেই ৩১ মে সকাল ৯টায় ঢাকা স্টেডিয়ামে গায়েবানা জানাজা হয়। মরদেহ ঢাকায় আসার পর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে অনুষ্ঠিত হলো স্মরণকালের সবচেয়ে বড় জানাজাÑ যা এখন পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারেনি।
জিয়াউর রহমানের ডাকনাম ছিল কমল। ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার বাগবাড়ীতে তার জন্ম। পিতা মুনসুর রহমান ও মাতা জাহানারা খাতুনের দ্বিতীয় সন্তান জিয়াউর রহমান মাত্র ৪৫ বছরের জীবনে রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সেনাপ্রধান, বিএনপি চেয়ারম্যান হিসেবে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন, স্বাধীনতার ঘোষক এবং রণাঙ্গনের নেতৃত্বদানকারী জিয়াউর রহমান তার কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ বীর-উত্তম, স্বাধীনতা পুরস্কার, হিলাল-ই-জুরাত, অর্ডার অব দ্য নাইল, সার্ক পুরস্কার, অর্ডার অব দ্য যুগোস্লাভ স্টার, হিরো অব দ্য রিপাবলিক ইত্যাদি পদকে তিনি ভূষিত হয়েছেন।
সাহসী সৈনিক স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান তার মেধা, শ্রম এবং সততার মাধ্যমে মানুষের মন জয় করে। রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক ও অর্থনীতিবিদ এই মানুষটি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা। এক কথায় জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক। দেশ ও জাতির সংকটে বারবারই ত্রাণকর্তা হিসেবে সৃষ্টিকর্তা দূত হিসেবে জাতির সামনে হাজির করেছেন।
নিজেকে একজন শ্রমিক পরিচয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা এই মানুষটি ছিলেন স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির ঊর্ধ্বে। তার কাছে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণই ছিল তার মূল রাজনীতি। রাষ্ট্রপতি হলেও জিয়াউর রহমান সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতেন। জিয়াউর রহমানের এই সততা নিয়ে আজ পর্যন্ত তার কট্টর সমালোচকরাও কোনো প্রশ্ন তুলতে পারেনি।
শৈশব ও কৈশোরের জিয়াউর রহমানের কিছুকাল বগুড়ায় নিজ গ্রামে কেটেছে। রসায়নবিদ বাবা মুনসুর রহমানের কর্মক্ষেত্র কলকাতার হেয়ার স্কুলে পড়াশোনা করতেন তিনি। ভারত-পাকিস্তান ভাগ হলে কলকাতার হেয়ার স্কুল ছেড়ে পিতার কর্মস্থল পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি নগরীর করাচির একাডেমি স্কুলে ভর্তি হন। তিনি ১৯৫২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে মাধ্যমিক শেষ করে, ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকুলে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে কমিশন লাভ করেন তিনি। বাংলা, ইংরেজি ও উর্দুÑ এই তিন ভাষায়ই পারদর্শী জিয়াউর রহমান।
১৯৬০ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন জিয়াউর রহমান। তার স্ত্রী গণতন্ত্রের মাতা বেগম খালেদা জিয়া, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক বিরোধীদলীয় নেতাও। তাদেরই সন্তান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে একটি কোম্পানির অধিনায়ক হিসেবে খেমকারান সেক্টরে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনাসহ তার বীরত্বের জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে হিলাল-ই-জুরাত খেতাবে ভূষিত করে। ১৯৬৯ সালে মেজর পদবিতে জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ১৯৭০ সালে চট্টগ্রামে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ডের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মারণাস্ত্র নিয়ে হঠাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ নিরস্ত্র ঘুমন্ত মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নিহত হয় হাজার হাজার মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা এবং পাক হানাদারদের অতর্কিত আক্রমণে দিশাহারা হয়ে পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ।
এই রাতেই চট্টগ্রামের ষোলোশহরে সেনাবাহিনীর অষ্টম ব্যাটালিয়নের বাংলাভাষী অফিসার ও জওয়ান নিয়ে বিদ্রোহ করেন জিয়াউর রহমান। ২৬ মার্চ তিনি চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। মেজর জিয়ার কণ্ঠস্বর শুনে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে দিশাহারা গোটা জাতি। ‘আমি মেজর জিয়া বলছি... বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি’Ñ তার এই অবিস্মরণীয় অবিনাশী ঘোষণায় আমাদের মতো পথহারা মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে মরণপণ মুক্তিযুদ্ধে।
জিয়াউর রহমান শুধু মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত হননি। স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং দুই শিশুপুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর কথা না ভেবে দেশকে স্বাধীন করতে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় জিয়া চৌকস জেড ফোর্স গঠন ও পরিচালনা করেন। এই অবস্থায় চট্টগ্রাম থেকে খালেদা জিয়া দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে রাজধানী ঢাকায় আসেন। সিদ্ধেশ্বরী এক আত্মীয়র বাসা থেকে তারা গ্রেপ্তার হন। খালেদা জিয়া প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা এবং তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো প্রথম শিশু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখান।
স্ত্রী ও পুত্রদ্বয় গ্রেপ্তার হলেও জিয়াউর রহমান যুদ্ধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশ স্বাধীন করে জিয়াউর রহমান আবার ফিরে যান ক্যান্টনমেন্টে। বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সরকার তাকে বীর-উত্তম খেতাবে ভূষিত করে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বৈষম্যের শিকার হন জিয়াউর রহমান। সেনাবাহিনীতে জিয়াউর রহমান সিনিয়র হলেও তাকে ডিঙিয়ে কেএম সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান করা হয়েছিল।
এ থেকেই শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার পরিচালনার ধরন বুঝতে পারা যায়। ’৭২-৭৫ সাল শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে ব্যাংক ডাকাতি, নারী নির্যাতন ছিল নিত্যঘটনা, আইনশৃঙ্খলা বলতে কিছু ছিল না। জাসদের ২০ হাজারের বেশি কর্মীকে হত্যা, দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির কারণে ’৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে বিপুলসংখ্যক মানুষ না খেয়ে মারা যাওয়া ইত্যাদি ছিল শেখ মুজিবের শাসন আমল। শেষ রক্ষা হিসেবে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে বাকশাল গঠনের পর কয়েক মাসের মাথায় ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যার শিকার হন শেখ মুজিব। এরপর আওয়ামী লীগ নেতা ও শেখ মুজিব সরকারের মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়ে ২০ আগস্ট সামরিক আইন জারি করে নিজে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নেন। এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীতে ক্যু-পাল্টা ক্যুÑ পুরো জাতি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ৭ নভেম্বর সৈনিক ও জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন।
জিয়াউর রহমানের সাহস এবং সেনাবাহিনীতে তার জনপ্রিয়তা সম্পর্কে সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান তার লেখা ‘কিছু স্মৃতি কিছু কথা’ বইয়ে জিয়া ও সাত নভেম্বর শিরোনামে উল্লেখ করেছেন। ৭৩ পৃষ্ঠায় তিনি উল্লেখ করেছেন, “আমার মনে পড়ে ঢাকা সেনানিবাসে তিনি (জিয়াউর রহমান) এ সময় দরবারে এসেছিলেন। মাঠে অস্ত্র উঁচিয়ে উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকের ভিড়। চতুর্দিকে মুহুর্মুহু স্লোগান ‘জিয়া ভাই, জিয়া ভাই’। ঢাকা সেনানিবাসের আকাশ-বাতাস মুখরিত। পতাকাবাহী গাড়ি রাস্তায় রেখে তিনি হেঁটে সৈনিকদের ঠিক মাঝখানে চলে আসেন। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে চিৎকার করে বলতে শুরু করেন, ঝযঁঃ-ঁঢ়. ও ধস হড়ঃ ুড়ঁৎ তরধ নযধর. ও ধস নষড়ড়ফং বিষষ ুড়ঁৎ পযরবভ. ইবযধাব ঢ়ৎড়ঢ়বৎষু, তোমরা সবাই চুপ করো। আমি তোমাদের ভাই নই। আমি তোমাদের সেনাপ্রধান। সাবধানে কথা বলো। সেনাশৃঙ্খলাভঙ্গ আমি কখনও সহ্য করব না।’ তিনি সবাইকে ব্যারাকে যাওয়ার আদেশ দেন। অস্ত্র জমা দিতে বলেন এবং চেইন অব কমান্ডে ফিরে আসতে বলেন। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করি, মুহূর্তের মধ্যে সব কোলাহল স্তব্ধ, সৈনিকরা লাইন ধরে সুড়সুড় করে আপন আপন ইউনিটের কাছে ধাবমান। আমার কাছে জিয়াকে সেদিন মনে হয়েছিল তিনি যেন সেই হ্যামিলনের বংশীবাদক, যার বাঁশির সুরে হ্যামিলন নগরীর সব শিশু-কিশোর যেখানে ছিল তার পেছনে পেছনে ছুটে চলছে।” আসলেই জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি মানুষের কাছে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালাই ছিলেন।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে জিয়াউর রহমানকে সৈনিক-জনতা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসায়। শারীরিকভাবে অসুস্থ হলে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম পদত্যাগ করেন। ফলে ৪২ বছর বয়সে জিয়াউর রহমান সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। বছরখানেক পর হ্যাঁ-না ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন তিনি। বাংলাদেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি হন জিয়াউর রহমান। এর আগে বাংলাদেশে কেউ বৈধ রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হননি। এমনকি শেখ মুজিবও নন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে সংসদে প্রবেশ করেন, এর কিছুক্ষণ পরেই রাষ্ট্রপতি হয়ে বের হয়েছিলেন। এরপর জিয়াউর রহমান একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করেন। নিবন্ধনের মাধ্যমে সবাইকে রাজনীতির সুযোগ দিলেন।
দীর্ঘ সংলাপ, অভিন্ন ধারার রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দলগুলোর সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রাথমিক জাতীয় ঐক্য সূচিত হয়। এভাবেই গড়ে ওঠে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল)। বিচারপতি আবদুস সাত্তার ছিলেন এ দলের প্রধান। পরে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠিত হয়, যার প্রধান ছিলেন জিয়াউর রহমান। ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান বীর-উত্তম।
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জাগদল বিলুপ্ত করে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের জন্য ওইদিনে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। এই দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন জিয়াউর রহমান। উন্মুক্ত আকাশের নিচে রমনার বটমূলের সামনে একটি ছোট টেবিল আর গোটাসাতেক চেয়ার ছিল, সামনে কিছু সাংবাদিক। এই সংবাদ সম্মেলন সফল করতে বরকতউল্লা বুলু (বর্তমানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান) ও আমি (গয়েশ্বর চন্দ্র রায়) দায়িত্ব পালন করেছিলাম। ১৯৭৯ সালের জাতীয় নির্বাচন জাতীয় ঐক্যের এক বিরল প্রদর্শন। এই নির্বাচনে সমাবেশ ঘটল ডান, বাম, মধ্যপন্থিÑ সব মানুষের, যা দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। এই নির্বাচনে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তনকারী এবং আধুনিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জনক জিয়াউর রহমান তার কর্ম দিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে জনগণের মনের গভীরে প্রবেশ করেন। তার উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতি খাল কাটা কর্মসূচি, কৃষি, শিক্ষা, শিল্পবিপ্লবসহ যে কোনো পদক্ষেপেই দেশের মানুষ তার পাশে দাঁড়িয়েছে। দেশের বেকার জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে পরিণত করেন; মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে শ্রমিক পাঠানো শুরু করেন তিনি। খাল কাটা কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষিবিপ্লব শুরু হয়।
জিয়াউর রহমান মহিলা পুলিশ গঠন, সেনাবাহিনীতে মেয়েদের নিয়োগের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পুলিশ বাহিনীর সদস্য দ্বিগুণ এবং অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের মান উন্নয়ন, গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করেন। সশস্ত্র বাহিনী পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। দেশের অখণ্ডতা রক্ষায় পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী মোতায়েন ছিল প্রশংসনীয় সিদ্ধান্ত। দেশে অস্ত্র উৎপাদনের ব্যবস্থা নেন। বিডিআরকে (বর্তমান বিজিবি) সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আধুনিক করে গড়ে তোলেন। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) প্রতিষ্ঠা, পল্লী উন্নয়ন বোর্ড গঠন করেন। জিয়াউর রহমান গার্মেন্টকে শিল্প হিসেবে পরিণত করে লাখ লাখ নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেন, বন্ধ কলকারখানা চালু, নতুন শিল্প-কারখানা গড়ার মধ্য দিয়ে উন্নয়নের সূচনা করেন। ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে মর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়েছেন। সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা ও ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে জিয়াউর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
আরও পড়ুন:
উন্নতমানের এসি তৈরি হচ্ছে দেশে
জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদক প্রবর্তন করেন। বিএনপি সব ধর্মের মানুষের জন্য নিরাপদ দল তা প্রমাণও করেন তিনি। দেশ যখন উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির শিখরের দিকে যাচ্ছিল, তখনই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে চট্টগ্রামে তাকে হত্যা করা হয়। তবে তার আদর্শকে হত্যা করতে পারেনি।
জিয়াউর রহমান যেখানে শেষ করেছেন, সেখান থেকে শুরু করেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তার রেখে যাওয়া বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পতাকা বহন করে তিনবার ক্ষমতায় গিয়ে দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করেন খালেদা জিয়া। এখন দেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের বড় সন্তান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি কী ভূমিকা রেখেছেন, তার সাক্ষী আমিও (গয়েশ্বরচন্দ্র রায়) একজন। আরেকজন সাক্ষী আছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তার মাঝে জিয়াউর রহমানের প্রতিচ্ছবি স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। তার কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক। তাকে ঘিরে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র চলমান, তবে তারেক রহমানকে সফল করতে এখন শুধু বিএনপি নয়; আমাদের মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোও আজ ঐক্যবদ্ধ। ’৭১-এ জিয়াউর রহমান, ’৯০-এ বেগম খালেদা জিয়ার মতো ২০২৪-এ তারেক রহমান নিজ কর্ম দিয়ে জনতার নায়ক হিসেবে তাদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। আমরা আরেকজন জিয়া পেয়েছি। গত বুধবারের তারুণ্যের সমাবেশে তারেক রহমান নিজেই স্লোগান ধরেন, প্রিয় দেশবাসী বলুন, দিল্লি নয় পিণ্ডি নয়, নয় অন্য কোনো দেশ, সবার আগে বাংলাদেশ। কথা দিলাম তারেক রহমানের নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রাখব।
লেখক : সাবেক মন্ত্রী ও সদস্য, জাতীয় স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি