চার দিনে কী ঘটেছিল?
হঠাৎ উত্তেজনা, ধোঁয়াশা, নানা গুঞ্জন- সব মিলে চার দিন রাজনৈতিক অঙ্গন এক অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে আবর্তিত হয়। মানবিক করিডর, বন্দর নিয়ে বিতর্ক, সেনাপ্রধানের ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’, পরদিন প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ ভাবনার খবর, এই পরিস্থিতি তৈরি করে। সাক্ষাতের জন্য চারবার সময় চেয়েও না পাওয়া বিএনপি অবশেষে শনিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের ডাক পায়। এ বৈঠকটিও হয়েছে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঘনিষ্ঠ এবং বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত একজনের বিশেষ উদ্যোগে। প্রফেসর ইউনূস প্রথমে এ বৈঠকে রাজি ছিলেন না। বিএনপি যে ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে আসছে তাকে বৈঠকে রেখে দলটির প্রতি এক ধরনের তাচ্ছিল্য দেখানো হয়েছে। এদিন প্রধান উপদেষ্টা জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির সঙ্গেও বৈঠক করেন। একই দিন প্রধান বিচারপতি প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তবে এ বিষয়ে গণমাধ্যমে বিস্তারিত কোনো খবর প্রকাশিত হয়নি। প্রধান বিচারপতির সাক্ষাৎ নিয়েও নানা জল্পনা তৈরি হয়।
রবিবার আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে বৈঠক হয়। এদিকে শনিবার সকালেই প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ ভাবনার ইতি টেনে দেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা প্রফেসর ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। একনেকের বৈঠকের পর উপদেষ্টা পরিষদের এক অনির্ধারিত বৈঠক শেষে প্রফেসর ওয়াহিদউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা যাচ্ছেন না। অন্য কোনো উপদেষ্টাও কোথাও যাচ্ছেন না। আমরা অর্পিত দায়িত্ব ছেড়ে যেতে পারব না। এর ওপর নির্ভর করবে দেশের ভবিষ্যৎ।’ পরিকল্পনা উপদেষ্টার এ বক্তব্যের পর প্রশ্ন উঠতেই পারে, প্রধান উপদেষ্টা কি আসলেই পদত্যাগের কথা ভেবেছিলেন? যদি তা ভেবে থাকেন, তাহলে তার এই ভাবনার পেছনের কারণ কী? এ নিয়ে নানা কথা শোনা যাচ্ছে। কাজ করতে না পারার জন্য ক্ষোভ, হতাশার কথা বলা হচ্ছে। অভিমানের কথাও শোনা যাচ্ছে। এর যে কোনোটিই তার ভাবনার পেছনের কারণ হয়ে থাকতে পারে। অথচ কিছুদিন আগেও তিনি একাধিকবার দেশের ইতিহাসের ‘সেরা নির্বাচন’ উপহার দেওয়ার কথা বলেছেন। তাহলে হঠাৎ করে কেন এই উত্তেজনা তৈরি হলো? এর দায় কার? এ নিয়ে নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলছে।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্য প্রকাশ্যে আসার পরদিন উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রফেসর ইউনূস হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার পদে থাকার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করেন। ‘অফিসার্স অ্যাড্রেসে’ দেওয়া সেনাপ্রধানের বক্তব্য কি কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল? কী বলেছিলেন জেনারেল ওয়াকার? গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, সেনাপ্রধান আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত বলে মতপ্রকাশ করেন। তিনি করিডর প্রসঙ্গে বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে মানবিক করিডর বিষয়ে সিদ্ধান্ত একটি নির্বাচিত সরকার থেকে আসতে হবে। এ ব্যাপারে জাতীয় স্বার্থ দেখতে হবে। বন্দর নিয়ে সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমে নেওয়া উচিত।’ সেনাপ্রধান সেদিন আরও বলেন, ‘আগস্ট থেকে সেনাবাহিনীর ধারাবাহিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কিছু মহল তাকে এবং বাহিনীকে অন্যায়ভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে।’ সংস্কার প্রসঙ্গে জেনারেল ওয়াকার বলেন, কী সংস্কার হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছেÑ এ বিষয়ে তার জানা নেই। এ বিষয়ে তার সঙ্গে কোনো আলোচনা বা পরামর্শ করা হয়নি। এই ছিল চার দিনের ঘটনার ঘনঘটা।
রাজনীতিসংশ্লিষ্টরা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বর্তমানে রাজনীতির মাঠের প্রধান দল বিএনপি এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। আর এর কারণ হিসেবে অনেকে ‘সরকারের ভেতরের সরকার বা ডিপস্টেটে’র অত্যন্ত সক্রিয় থাকার কথা বলছেন। এই শক্তি নির্বাচন প্রলম্বিত করে ক্ষমতায় থাকতে চায়। হঠাৎ উত্তেজনা ও ধোঁয়াশা সৃষ্টির নেপথ্যে এই শক্তির ভূমিকা থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন অনেকদিন ধরেই বলে আসছে, তারা ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে প্রস্তুত। তার পরও সরকার থেকে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ স্পষ্ট করা হচ্ছে না। নির্বাচন ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যেÑ এই একই কথার পুনরাবৃত্তি চলছে। বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একে নির্বাচনী রোডম্যাপ হিসেবে মানতে নারাজ। ফলে নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা কিছুতেই কাটছে না। মাঝে প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া একটি বক্তব্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ-সংশয় তৈরি করে। গত মাসে আলজাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রফেসর ইউনূস বলেন, ‘মানুষ মনে করে অন্তর্বর্তী সরকার ভালো সমাধান।’ গত ২৭ এপ্রিল আলজাজিরার ওয়েবসাইটে এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারে প্রফেসর ইউনূস নির্বাচনের সময় নিয়ে তার পুরনো কথার পুনরাবৃত্তি করেন। তিনি বলেছিলেন, ‘সংস্কারের তালিকা ছোট হলে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন এবং তালিকা বড় হলে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনপ্রত্যাশা এখনও তুঙ্গে রয়েছে। জনগণ মনে করে অন্তর্বর্তী সরকার তাদের জন্য ভালো সমাধান। জনগণ ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলছে না।’ প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্য নিয়ে বিএনপি তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম কয়েক মাস আগে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, ‘নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যে না হলে আগামী মার্চের মধ্যে হবে। কেননা মার্চের পর পাবলিক পরীক্ষা এবং ঝড়-বৃষ্টির বিষয়ে রয়েছে।’ দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে সরকারের মধ্যে দোদুল্যমানতা বিরাজ করছে। যা পরিস্থিতিকে জটিল করতে পারে। কোনো কোনো উপদেষ্টা প্রায়ই বলে থাকেন যে, তারা শুধু নির্বাচন করার জন্য আসেননি। সংস্কার এবং গণহত্যার বিচার করা তাদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। সংস্কার প্রসঙ্গে বলতে হয়, এ ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি নেই। অন্তর্বর্তী সরকার প্রথমে ছয়টি এবং পরবর্তীকালে আরও পাঁচটি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার, নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার, পুলিশ ও দুদক সংস্কার কমিশন প্রধানরা গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন। সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দল এবং অংশীজনের সঙ্গে ঐকমত্য স্থাপনের জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে চেয়ারম্যান করে গঠন করা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এই কমিশনের কো-চেয়ারম্যান আলী রীয়াজের নেতৃত্বে কমিশন প্রধানরা রমজান মাসের শুরু থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করেন। রোববার নাগরিক সমাজের সঙ্গে বৈঠক করেছে কমিশন।
সংস্কার বিষয়ে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের পর বৈঠক করেও সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে কোনো রূপরেখা চূড়ান্ত করতে পারেনি। রোববার কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সুশীল সমাজের সঙ্গে বৈঠকে জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারার বিষয়গুলো স্বচ্ছতার স্বার্থে জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। তিনি সংস্কারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আইন করার তাগিদ দিয়েছেন। গণমাধ্যম কমিশন গত ২২ মার্চ প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। সহসা বাস্তবায়নযোগ্য, এমন একটি সংক্ষিপ্ত সুপারিশ মালা দিতে বলা হলে কমিশন ২৪ মার্চ তা তৈরি করে দেয়। গত দুই মাসেও সংক্ষিপ্ত আকারের সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেই। নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা নিয়ে ধর্মীয় দলগুলোর তীব্র সমালোচনার পর অন্তর্বর্তী সরকার এ ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করবে বলে মনে হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স প্রায় দশ মাস হতে যাচ্ছে। সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়নি। অথচ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বশর্ত হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলায় সরকারের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী তরুণদের দাবি ছিল, ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান রোধ করতে জুলাই সনদ তৈরি করা। অথচ এখনও এই সনদ চূড়ান্ত করা যায়নি। অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দল ও শক্তির অন্যতম প্রধান দাবি ছিল, গণহত্যার বিচার। বলতে হয় এই একটি ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি আছে। রোববার থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মানবতাবিরোধী অপরাধের আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সরকার এখনও নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করার দিকে মনোযোগী হতে পারেনি। নির্বাচন কমিশন থেকে একাধিকবার বলা হয়েছে, ডিসেম্বরে নির্বাচন আয়োজন করার জন্য কমিশন প্রস্তুত আছে। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করলে দেশে বিদ্যমান অনিশ্চয়তা অনেকখানি কেটে যাবে। এ ক্ষেত্রে বিলম্ব আবার উত্তেজনা ছড়াতে পারে। যা দেশকে একটি অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এমনকি সংঘাত সৃষ্টিরও আশঙ্কা রয়েছে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
খায়রুল আনোয়ার : কলাম লেখক