জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন: বাংলাদেশের অর্থনীতি ও মর্যাদায় অবদান
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন আধুনিক বৈশ্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই মিশনের প্রধান লক্ষ্য হলো যুদ্ধবিধ্বস্ত বা সংঘাতপূর্ণ রাষ্ট্রে শান্তি স্থাপন, মানবাধিকার সুরক্ষা এবং টেকসই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।
জাতিসংঘের প্রথম শান্তি মিশনের সূত্রপাত হয় ১৯৪৮ সালে, যখন মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল। এই মিশনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধবিরতির শর্তাবলি পর্যবেক্ষণ এবং সংঘর্ষে লিপ্ত পক্ষগুলোর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা।
এর পর ১৯৫৬ সালে সুয়েজ সংকটের সময় জাতিসংঘ প্রথম ‘আর্মড পিস কিপিং ফোর্স’ গঠন করে, যার নাম ছিল ইউএন ইমার্জেন্সি ফোর্স (ইউএনইএফ)। এটি ছিল প্রথম সত্যিকারের সশস্ত্র শান্তিরক্ষী বাহিনী। এরপর রুয়ান্ডা, বসনিয়া, লাইবেরিয়া, হাইতি, কঙ্গো প্রভৃতি দেশে শান্তিরক্ষী মিশন পাঠানো হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মিশনের পরিধি ও কাঠামো আরো জটিল ও বিস্তৃত হয়, যাতে অন্তর্ভুক্ত হয় নির্বাচনী সহায়তা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, যুদ্ধাপরাধ তদন্ত, শিশু ও নারীর সুরক্ষা এবং মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ।
বাংলাদেশ ১৯৮৮ সাল থেকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে আসছে। এই অতি অল্প সময়েই একটি অন্যতম বৃহৎ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বমঞ্চে পরিচিতি লাভ করেছে। এই অংশগ্রহণ কেবল আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার ও মানবিক সহমর্মিতার প্রতিফলন নয়, বরং শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত সদস্যরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেন, যা বাংলাদেশের রেমিটেন্স প্রবাহে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এছাড়াও, আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ দেশকে একটি শান্তিপ্রিয়, মানবিক ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দেশের কূটনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় হয়েছে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন সাপেক্ষে সদস্য রাষ্ট্র স্বেচ্ছায় শান্তিরক্ষী পাঠায় এবং জাতিসংঘ তাদের লজিস্টিক, প্রশিক্ষণ ও সামরিক সমন্বয় প্রদান করে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৮ সালে মিশনের সূচনা থেকে ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত মোট ৩০টি দেশে ৭২টি শান্তিরক্ষা মিশন পরিচালনা করেছে। এই মিশনগুলোতে ১২৫টি দেশের ২০ লাখ শান্তিরক্ষী অংশগ্রহণ করেছে, যার মধ্যে নারী সদস্য ছিল ৮ দশমিক ৬ শতাংশ।
জাতিসংঘ ২০২৮ সালের মধ্যে সামরিক কন্টিনজেন্টে নারীর অংশগ্রহণ ১৫ শতাংশ এবং পুলিশ ইউনিটে ২০ শতাংশ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এই দীর্ঘ সময়কালে ৪ হাজার ৩০০- এরও বেশি শান্তিরক্ষী তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন।
বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা মিশনে ভূমিকা এবং অর্থনৈতিক অবদান (১৯৮৮–২০২৫)
বাংলাদেশ এই মিশনে ১৯৮৮ সালে সর্বপ্রথম ১৫ জন সেনা সদস্য ইরান-ইরাকে সামরিক পর্যবেক্ষণ গ্রুপ (ইউএনআইআইএমওজি)-এ পাঠানোর মধ্যে দিয়ে অংশগ্রহণ শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতা মে ২০২৫ পর্যন্ত মোট ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৫৬ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বিভিন্ন মিশনে অংশগ্রহণ করেছেন, যার মধ্যে ৩ হাজার ৩৮ জন নারী।
শান্তিরক্ষীদের মধ্যে সামরিক ছাড়াও বেসামরিক প্রশাসনিক ও অন্যান্য মোট প্রায় ১ হাজার ৮৫০ জন অংশগ্রহণ করে। এককথায়, বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে পদাতিক, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিট, মেডিকেল ইউনিট, মিলিটারি অবজারভার ইত্যাদি সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। নারী শান্তিরক্ষীদের অংশগ্রহণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অবদান আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। এই সংখ্যা অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের পরে তৃতীয় সর্বাধিক। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের মধ্যে এযাবৎ ১৬৮ জন মিশনে শহীদ হয়েছে এবং আহত হয়েছে ২৬৬ জন।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী ২০০০-০১ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করে মোট ২৭ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা আয় করেছে। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী ১৯৮৯ সাল থেকে ২০২৫ পর্যন্ত আয় করেছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে মোট আয় আনুমানিক প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা। জাতিসংঘ প্রতিটি শান্তিরক্ষী সদস্যের জন্য গড়ে মাসিক প্রায় ১ হাজার মার্কিন ডলার প্রদান করে। বাংলাদেশ সরকার এই অর্থের একটি অংশ সদস্যদের প্রদান করে, যা সদস্যের পদমর্যাদা ও জাতীয় বেতন কাঠামোর উপর নির্ভর করে। বাকি অর্থ সরকার তার কোষাগারে জমা রাখে। পুলিশ বাহিনীর ক্ষেত্রে, জাতিসংঘ প্রদত্ত মোট অর্থের প্রায় ১০ শতাংশ সরকার পায়।
শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশি সেনা, পুলিশ এবং সিভিল সদস্যরা উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে একত্রে কাজ করার সুযোগ পান। এর ফলে তারা আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তি, অস্ত্র পরিচালনা, সামরিক যান ও সরঞ্জাম ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করেন। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রশিক্ষণ মানোন্নয়ন যেমন ইউএন-এর মিলিটারি অবজারভারস কোর্স ও সিভিল-মিলিটারি কো-অর্ডিনেশন (সিআইএমআইসি) প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া সদস্যদের দ্বারা দেশীয় প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় উন্নতি সাধিত হয়েছে (বিআইপিএসওটি, ২০২২)।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ বহু দেশের সঙ্গে সামরিক ও নিরাপত্তা-ভিত্তিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, যা পরবর্তীতে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক কূটনীতিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ৪২টি দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে, যার অনেকগুলোই পিস কিপিংয়ের সময়কার যৌথ কার্যক্রমের ফল (এমএফএ, জিওবি)।
পিস কিপিং মিশনে অংশগ্রহণকারীরা বহু-সাংস্কৃতিক পরিবেশে কাজ করার মাধ্যমে নেতৃত্ব, আন্তঃসংস্কৃতি বোঝাপড়া, সংঘর্ষ নিরসন এবং মানবিক সহানুভূতি শিখেন। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন থেকে ফিরে আসা ৭৮ শতাংশ সেনা সদস্য দেশের ভেতরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন (বিআইডিএস, ২০২১)।
বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা তাদের কর্মদক্ষতার জন্য জাতিসংঘের বিভিন্ন পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হন। মে ২০২৫ পর্যন্ত বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের মধ্যে ২৮ জন সেনা কর্মকর্তা উচ্চপর্যায়ের আন্তর্জাতিক দায়িত্বে নিযুক্ত হয়েছেন (এএফডি, বাংলাদেশ, ২০২৫)। বর্তমানে শান্তিরক্ষী সরবরাহকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এক নম্বরে, যা বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে এবং এর ফলে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে সামরিক ও অসামরিক খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সফলতা ও স্বীকৃতি
জাতিসংঘের বিভিন্ন মূল্যায়নে (২০২০-২০২৩) দেখা গেছে, বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা শৃঙ্খলা, নৈতিকতা এবং মানবিক আচরণে অত্যন্ত প্রশংসিত। ডিআর কঙ্গো, মালি, দক্ষিণ সুদান–এর মতো সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের ভূমিকা আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত। বাংলাদেশ ২০১১ সালে প্রথম নারী পুলিশ ইউনিট পাঠায় হাইতিতে। বর্তমানে ২০০+ নারী শান্তিরক্ষী কাজ করছেন, যা বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে বেশি। ইউএন ওমেন- এর মতে, নারীর অংশগ্রহণে বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম।
বাংলাদেশ সেনা, পুলিশ ও চিকিৎসকসহ বহু-পেশাজীবী শান্তিরক্ষী পাঠায়। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের পিসকিপারদের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিকেল ইউনিট বেশি সক্রিয়। বাংলাদেশ মিশন থেকে প্রাপ্ত অর্থের একটি বড় অংশ সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের ট্রেনিং ও কল্যাণে ব্যয় করে। অন্যদিকে, বিদেশি মিশনে অংশগ্রহণকারী সদস্যরা অভিজ্ঞতা, ভাষাজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেন, যা দেশে ফিরে নেতৃত্বগুণে পরিণত হয়।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
বাংলাদেশের সফল মিশনের সংখ্যা ৫৪টির বেশি যা সমমর্যাদার ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও বেশি। এ যাবত বাংলাদেশ সম্মাননা পেয়েছে ৩০০০ যা ভারতের ২২০০টি এবং পাকিস্তানের ২০০০টির চেয়ে বেশি। (ইউএন ডিপিকেও, বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন)। জাতিসংঘ মহাসচিব ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিরা একাধিকবার বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ২০২২ সালে ডিআর কঙ্গোতে বাংলাদেশের নারী চিকিৎসক দলকে ‘মোস্ট ভ্যালুয়েবল কন্টিনজেন্ট’ হিসেবে পুরস্কৃত করে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও দ্রুত মোতায়েনযোগ্য বাহিনী হিসেবে বিবেচিত।
শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশি সদস্যদের সম্ভাবনা
বর্তমানে বাংলাদেশের ১৫টি কন্টিনজেন্ট ইউএনপিসিআরএস-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে দুটি র্যাপিডলি ডিপ্লয়েবল লেভেল হিসেবে যোগ্যতা অর্জন করেছে। এটি ভবিষ্যতে নতুন মিশনে দ্রুত মোতায়েনের সুযোগ সৃষ্টি করে। জাতিসংঘ ২০২৮ সালের মধ্যে মিশনে নারী সদস্যদের অংশগ্রহণ ১৫ শতাংশ এ উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ৭ দশমিক ৭ শতাংশ শান্তিরক্ষী নারী, যা ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। এই সম্ভাবনা বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন দেশে মোতায়েনকালে ভাষাগত সমস্যা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশের উচিত শান্তিরক্ষীদের জন্য ভাষা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা। যদিও বাংলাদেশ শান্তিরক্ষা মিশনে বৃহৎ অবদান রাখে, তবে জাতিসংঘের কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ সীমিত। উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের নিয়োগের মাধ্যমে এই অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনগুলোকে আরও পরিবেশবান্ধব করার আহ্বান জানিয়েছে, যা ভবিষ্যতে মিশনের টেকসয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিং শান্তিরক্ষীদের জন্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রদান করে, যা ভবিষ্যতে আরও উন্নত করা যেতে পারে। শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করে।
শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়
জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের মধ্যে প্রায় ১৬০ জন শহীদ হন বিভিন্ন দুর্ঘটনা, হামলা ও রোগে আক্রান্ত হয়ে। নিহতদের মধ্যে অনেকেই সন্ত্রাসী হামলা বা আইইডি বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছেন, বিশেষ করে কঙ্গো, মালি এবং দক্ষিণ সুদান মিশনে। আহতদের সংখ্যা এর চেয়ে অন্তত তিনগুণ বেশি, যাদের অনেকে স্থায়ী শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে দেশে ফেরেন।
যুদ্ধক্ষেত্র সদৃশ পরিবেশে কর্মরত থাকায় মানসিক চাপ, এবং ক্রনিক উদ্বেগের মতো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। অনেক সময় যথাযথ অস্ত্র, যানবাহন বা সুরক্ষা গিয়ারের অভাব থাকায় জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি বাড়ে। পরিবার থেকে দীর্ঘ সময় বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে মিশনে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের মধ্যে ২৫-৩০ শতাংশের বেশি দাম্পত্য কলহ এবং ১৫ শতাংশের বেশি বিচ্ছেদ বা ডিভোর্স এর ঘটনা ঘটেছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক সমীক্ষা)। শিশুদের বড় হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বাবা বা মায়ের অনুপস্থিতি পারিবারিক বন্ধন দুর্বল করে। বিদেশে দীর্ঘকাল অবস্থানের কারণে অনেক সময় আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যু, সন্তানদের বড় কোনো সাফল্য বা দুঃখের খবরেও অংশগ্রহণ করতে পারে না।
জাতিসংঘ স্বীকার করেছে যে শান্তিরক্ষীদের মধ্যে সেক্সুয়াল এক্সপ্লয়টেশন অ্যান্ড এবিউজ (এসইএ) সংক্রান্ত ১৭০০+ অভিযোগ জমা পড়েছে গত এক দশকে। বাংলাদেশি সদস্যদের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগও ওঠেছে, যদিও তা গড়ের চেয়ে কম। বিদেশি সংস্কৃতি, ধর্মীয় পরিবেশ ও মূল্যবোধের দ্বন্দ্বের কারণে অনেক সদস্য নৈতিক সংকটে পড়েন। আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় অনৈতিক প্রলোভনে পড়ে শান্তিরক্ষা নীতির পরিপন্থী আচরণ ঘটে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন অঘোষিত ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বৈষম্য
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন সাধারণত তখনই প্রেরণ করা হয় যখন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের (ইউএনএসসি) সদস্য রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে স্থায়ী পাঁচ সদস্য সম্মত হয়। এ কারণে রাজনৈতিক স্বার্থ, ভেটো ক্ষমতা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভারসাম্য অনেক সময় একটি দেশের পিস মিশন পাওয়াকে নির্ধারণ করে। তবে বাস্তবতা বৈষম্যের ইঙ্গিত দেয়, যেমন কাশ্মীর, এটি একটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধপূর্ণ এলাকা। ইউএনএসসি একাধিকবার আলোচনায় আনলেও ভারতের বিরোধিতার কারণে পিস মিশন সম্ভব হয়নি। প্যালেস্টাইন দীর্ঘকাল ধরে ইসরায়েলের দখলদারিত্ব চলছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বারবার ভেটো দেওয়ার কারণে এখানে জাতিসংঘের পূর্ণাঙ্গ শান্তিরক্ষা মিশন স্থাপিত হয়নি। সিরিয়া ও ইয়েমেন এই দুটি দেশেই গৃহযুদ্ধ চলছে, কিন্তু সেখানে পিস মিশনের জন্য চীন ও রাশিয়ার ভেটোসহ ভিন্নমতের কারণে পূর্ণাঙ্গ মিশন অনুমোদন হয়নি।
যদিও জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মীয় বিভাজন করে না বলে কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থ ও ক্ষমতাধর দেশের ভেটো নীতি অনেক সময় মুসলিম দেশগুলোতে শান্তিরক্ষা মিশনকে বাধাগ্রস্ত করেছে। যার ফলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর বহু জনগণ এই ঘটনাগুলোকে অঘোষিত ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বৈষম্য হিসেবে দেখে থাকেন। তবে এ কথা সত্যি যে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন অনেক ক্ষেত্রে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভূখণ্ডে ভুক্তভোগীদের রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে, যার প্রধান কারণ রাজনৈতিক স্বার্থ, ভেটো ক্ষমতার অপব্যবহার ও আন্তর্জাতিক পক্ষপাতিত্ব। এটি সরাসরি ধর্মীয় গোষ্ঠীভিত্তিক বৈষম্যের মতো প্রতীয়মান হয়।
সর্বশেষ, ১৯৮৮ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ শুধু আর্থিক অর্জনের দিক থেকেই নয়, জাতীয় মর্যাদা ও গৌরবের ক্ষেত্রেও এক অনন্য মাইলফলক স্থাপন করেছে। মিশন থেকে প্রায় ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি বৈদেশিক আয় দেশে এসেছে, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। পাশাপাশি, পেশাদারিত্ব, শৃঙ্খলা ও মানবিকতার জন্য বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উচ্চ প্রশংসা কুড়িয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ আজ শান্তি, ন্যায় ও সহমর্মিতার প্রতীক হিসেবে বিশ্বমঞ্চে একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান দখল করেছে। অতএব, জাতিসংঘ পিস কিপিং মিশনে অংশগ্রহণ বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্য ও বৈদেশিক নীতির এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত।
ড. মো. মিজানুর রহমান: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট