থাইরয়েড শনাক্তকরণ ও চিকিৎসায় প্রতিরোধ করা সম্ভব
প্রতিবছর ২৫ মে বিশ্ব থাইরয়েড দিবস পালিত হয়। জনগণকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে এ দিবস পালন করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য ‘Know Your Thyroid : Early Detection, Better Health’ বা ‘আপনার থাইরয়েডকে জানুন : যথাসময়ে শনাক্তকরণ, সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ’- এই স্লোগানটি আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয় : সচেতনতা, সময়ে রোগ শনাক্তকরণ ও সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে থাইরয়েডজনিত জটিলতা অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
আলোচনা করব থাইরয়েড কী, থাইরয়েডজনিত রোগসমূহ, বাংলাদেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব, কীভাবে দ্রুত শনাক্ত করা যায় এবং কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
থাইরয়েড গ্রন্থি কী?
থাইরয়েড একটি ছোট প্রজাপতি আকৃতির গ্রন্থি যা আমাদের গলার ঠিক নিচে, শ্বাসনালির সামনে অবস্থিত। এটি আমাদের শরীরের বিপাক ক্রিয়া (Metabolism), শরীরের তাপমাত্রা, হৃৎস্পন্দন এবং হরমোন উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
থাইরয়েড গ্রন্থি দুটি প্রধান হরমোন তৈরি করে :
• T3 (Triiodothyronine)
• T4 (Thyroxine)
এই হরমোনগুলো আমাদের শরীরের কোষগুলোর কার্যকারিতা বজায় রাখতে সহায়তা করে।
থাইরয়েডজনিত সাধারণ রোগসমূহ : থাইরয়েডজনিত সমস্যা দুই ধরনের হতে পারেÑ হাইপোথাইরয়েডিজম (হরমোন কম উৎপাদন) ও হাইপারথাইরয়েডিজম (হরমোন অতিরিক্ত উৎপাদন)। এ ছাড়া নডিউল, গইটার বা গলগণ্ড এবং থাইরয়েড ক্যানসারও থাইরয়েডসংক্রান্ত রোগের অন্তর্ভুক্ত।
১. হাইপোথাইরয়েডিজম (Hypothyroidism)
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
এতে শরীরে পর্যাপ্ত থাইরয়েড হরমোন তৈরি হয় না। লক্ষণসমূহ : ক. দুর্বলতা ও অলসতা খ.ওজন বৃদ্ধি গ. চুল পড়া ঘ. ঙ. ঠাণ্ডা অনুভব চ.মনোযোগে সমস্যা ছ. অনিয়ম পিরিয়ড।
২. হাইপারথাইরয়েডিজম (Hyperthyroidism).
এতে অতিরিক্ত হরমোন তৈরি হয়। লক্ষণসমূহ : ক. ওজন কমে যাওয়া খ. অস্থিরতা ও দ্রুত হৃৎস্পন্দন গ. অতিরিক্ত ঘাম ঘ. ঘুমের সমস্যা ঙ. চোখ বড় হয়ে যাওয়া (Graves disease) . ৩. গলগণ্ড (Goiter) : থাইরয়েড গ্রন্থির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। ৪. থাইরয়েড নডিউল। থাইরয়েড গ্রন্থিতে ছোট ছোট চাকা বা গাঁট। ৫. থাইরয়েড ক্যানসার : যদিও তুলনামূলকভাবে বিরল, তবে চিকিৎসাযোগ্য। অল্পসংখ্যক নডিউল ক্যানসারে রূপ নিতে পারে।
বাংলাদেশে থাইরয়েড রোগের প্রাদুর্ভাব : বাংলাদেশে থাইরয়েড রোগ একটি ক্রমবর্ধমান জনস্বাস্থ্য সমস্যা। বিশেষ করে- আইডিন ঘাটতির কারণে গলগণ্ড ও হাইপোথাইরয়েডিজম অতীতে প্রচুর দেখা যেত। এবং বর্তমানে আইডিনযুক্ত লবণের ব্যবহারে গলগণ্ড এর হার কমলেও, থাইরয়েড হরমোনজনিত রোগের হার তুলনামূলকভাবে বাড়ছে। প্রতি ১০ জনে একজন নারী থাইরয়েডজনিত রোগে ভোগেন। নারীরা পুরুষের তুলনায় ৮ গুণ বেশি আক্রান্ত হয়।
গবেষণা অনুযায়ী : থাইরয়েড সমস্যায় আক্রান্তদের একটা বড় অংশ হয় কিশোরী মেয়ে ও মধ্যবয়সী নারী।
ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী : নিম্নোক্ত ব্যক্তিরা থাইরয়েড রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন-
ক. ৩০ বছরের বেশি বয়সী নারী। খ. পরিবারে কারও থাইরয়েড রোগের ইতিহাস থাকলে।
ঘ. গর্ভবতী নারী। ঙ. পূর্বে আয়োডিন ঘাটতির অঞ্চল থেকে আগত ব্যক্তি।
কীভাবে দ্রুত শনাক্ত করবেন? : থাইরয়েড সমস্যা অনেক সময় ধীরে ধীরে লক্ষণ তৈরি করে, যেগুলো সহজেই উপেক্ষিত হতে পারে। তাই নিম্নলিখিত উপসর্গগুলো থাকলে থাইরয়েড পরীক্ষা করানো উচিত :
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
ক. হঠাৎ ওজন বৃদ্ধি বা কমে যাওয়া খ. দীর্ঘদিন ক্লান্তিভাব গ. অনিয়মিত মাসিক বা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ঘ. গলায় চাকা বা গোটা অনুভূত হওয়া ঙ. হৃৎস্পন্দনের পরিবর্তন (খুব ধীরে বা দ্রুত)
চ. বারবার গর্ভপাত ছ. গর্ভধারণ এ সমস্যা ঝ. হাড়ক্ষয় ঞ.শিশুদের বৃদ্ধি ঠিকমতো না হলে ট. বয়ঃসন্ধি বিলম্বিত হলে ঠ. অবসন্নতা দেখা।
কী কী পরীক্ষা করা হয়? : থাইরয়েড ফাংশন মূল্যায়নের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রক্ত পরীক্ষা আছে :
A. TSH (Thyroid Stimulating Hormone) B. FT? (Free Thyroxine)
কখনও অনুসন্ধানের জন্য আল্ট্রাসনোগ্রাফি, থাইরয়েড স্ক্যান ও ফাইন নিডল অ্যাসপিরেশন (FNA)) বায়োপসি করা লাগতে পারে।
চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা : থাইরয়েড সমস্যার চিকিৎসা সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি হলেও কার্যকর : ক. হাইপোথাইরয়েডিজমে প্রতিদিন সকালে লেভোথাইরক্সিন খেতে হয়। খ.হাইপারথাইরয়েডিজমে থাইরয়েড হরমোন কমানোর ওষুধ কিছু ক্ষেত্রে রেডিওআ্যাকটিভ আয়োডিন অথবা অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হয়। গ. থাইরয়েড নডিউল বা ক্যানসার হলে সার্জারি ও আয়োডিন থেরাপি প্রয়োজন হতে পারে।
সচেতনতা ও বার্তা : বিশ্ব থাইরয়েড দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ‘জ্ঞানই শক্তি’। আপনার থাইরয়েড সম্পর্কে সচেতন থাকুন। আপনার নিজের শরীরের সংকেতকে গুরুত্ব দিন। আগেভাগে সমস্যা চিহ্নিত করুন এবং চিকিৎসা গ্রহণ করুন। মনে রাখা দরকার থাইরয়েড সমস্যা নীরব ঘাতক হতে পারে। এবং নিয়মিত পরীক্ষা ও সচেতনতা জীবন রক্ষা করতে পারে। থাইরয়েডজনিত অসুস্থতা থাকলেও আপনি একটি স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবনযাপন করতে পারেন- শুধু সঠিক চিকিৎসা এবং যত্ন প্রয়োজন।
থাইরয়েডজনিত রোগগুলোর সচেতনতা, স্ক্রিনিং ও আগেভাগে শনাক্তকরণ নিশ্চিত করতে সরকার, সামাজিককর্মী, নীতিনির্ধারক এবং চিকিৎসকদের সমন্বিতভাবে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। নিচে প্রতিটি শ্রেণির জন্য করণীয় কিছু প্রস্তাব তুলে ধরা হলো :
১. সরকার বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে করণীয় : জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে থাইরয়েড রোগকে অগ্রাধিকার দেওয়া থাইরয়েডজনিত সমস্যাগুলোকে অন্যান্য অসংক্রামক রোগের (NCDs) মতো গুরুত্ব দিয়ে সরকারি কর্মপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা। এবং স্কুল ও কমিউনিটিভিত্তিক স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম : প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ইউনিয়ন পর্যায়ে থাইরয়েড স্ক্রিনিং চালু করা, বিশেষ করে কিশোরী ও প্রজনন বয়সের নারীদের মধ্যে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
জনসচেতনতামূলক প্রচারাভিযান ক্ষেত্রে জাতীয়ভাবে টেলিভিশন, রেডিও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, মোবাইল এসএমএস ও পোস্টার/ফেস্টুনের মাধ্যমে থাইরয়েড বিষয়ে নিয়মিত সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো দরকার।
থাইরয়েড পরীক্ষা সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করা উচিত যেমন- সরকারি হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিকে TSH I FT4 পরীক্ষার সুবিধা কম খরচে নিশ্চিত করা। আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহারের মনিটরিং জোরদার করা এবং ঘাটতি আছে এমন এলাকায় সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো।
২. সমাজকর্মীদের করণীয় : গ্রামে-গঞ্জে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা : স্থানীয় ভাষায় সভা, মঞ্চনাটক, গ্রুপ ডিসকাশন ইত্যাদির মাধ্যমে থাইরয়েড রোগ ও লক্ষণ সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে জানানো। নারীদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ : গর্ভবতী, কিশোরী ও প্রজনন বয়সী নারীদের থাইরয়েড ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করা এবং স্ক্রিনিংয়ে উদ্বুদ্ধ করা। স্থানীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষক বা জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বদের মাধ্যমে সচেতনতা বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া।
৩. নীতিনির্ধারকদের করণীয় : স্বাস্থ্য বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি : থাইরয়েড পরীক্ষা ও চিকিৎসার জন্য সরকারি বাজেটে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা। এবং গবেষণা উৎসাহিত করা : বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বাস্থ্য গবেষণা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে থাইরয়েডসংক্রান্ত গবেষণায় অনুদান ও প্রণোদনা প্রদান।
৪. চিকিৎসকদের করণীয় : ক. উপসর্গ অনুযায়ী দ্রুত পরীক্ষা পরামর্শ : যারা ক্লান্তি, ওজন পরিবর্তন, মাসিক অনিয়ম, গলায় চাকা ইত্যাদি সমস্যায় ভোগেন, তাদের দ্রুত থাইরয়েড পরীক্ষা করতে উৎসাহিত করা। খ. গর্ভবতী নারীদের রুটিন স্ক্রিনিং : প্রসবপূর্ব চেকআপের সময় নিয়মিত TSH পরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা। ঘ. রোগীদের সহজ ভাষায় বোঝানো : থাইরয়েড রোগের প্রকৃতি, চিকিৎসা ও প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে রোগীদের সচেতন করা এবং ভুল ধারণা দূর করা। গ. গবেষণায় অংশগ্রহণ : নতুন থেরাপি, লোকাল ডেটা বিশ্লেষণ ও ডিজিজ প্যাটার্ন বুঝতে গবেষণায় অংশ নেওয়া।
থাইরয়েড রোগ একটি নীরব ঘাতক হতে পারে, তবে এটি সঠিক সময়ে শনাক্ত ও চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। সরকারের সুদূরপ্রসারী নীতি, সামাজিককর্মীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি ও চিকিৎসকদের পেশাগত দায়িত্বÑ এসব মিলেই তৈরি করতে পারে একটি সচেতন, সুস্থ সমাজ। সব পক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে থাইরয়েডজনিত রোগের প্রকোপ কমাতে এবং জনগণকে একটি সুস্থ, কর্মক্ষম জীবন উপহার দিতে।
ডা. মারুফা মোস্তারী : সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়, সমন্বয়কারী, পিসিওএস টাস্কফোর্স যৌথ সাংগঠনিক সম্পাদক বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি।