দুর্যোগকালীন নেটওয়ার্ক সচল রাখার প্রযুক্তি উদ্ভাবন
ভূমিকম্প, বন্যা বা এ ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। কোনো কারণে নেটওয়ার্ক টাওয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হলে মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করে না। যোগাযোগের অভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে যোগাযোগ বা উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করা দুরূহ হয়ে পড়ে। তুরস্কের একদল গবেষককে সঙ্গে নিয়ে এ সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করেছেন বাংলাদেশি গবেষক ড. এএফএম শাহেন শাহ। তিনি কাজ করছেন ইলদিজ টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রনিকস ও যোগাযোগ প্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে। এ কৃতী গবেষককে নিয়ে লিখেছেন নোমান বিন হারুন
গবেষক শাহেন শাহের শিক্ষাজীবন
২০০৫ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন শাহেন শাহ। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে প্রবল আগ্রহের জায়গা থেকে ভর্তি হন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন প্রকৌশল বিভাগে। একাডেমিক ফলের সুবাদে সেখানে তাকে শতভাগ বৃত্তি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সে আস্থার শতভাগ প্রতিদান দিয়েছেন তিনি দারুণভাবে। শুরু থেকেই বিভাগে প্রথম স্থান ধরে রাখেন তিনি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেন। এরই মধ্যে দুটি ব্যাংকের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে চাকরির অভিজ্ঞতাও তার হয়েছিল। ২০১৫ সালে তুরস্ক সরকারের বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার লক্ষ্যে পাড়ি জমান ইস্তাম্বুলের ইলদিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
গবেষণা ও অর্জন
পিএইচডিতে চালকবিহীন গাড়ি নিয়ে গবেষণা করেন শাহেন শাহ। চালকবিহীন গাড়ির ক্ষেত্রে যোগাযোগের বিলম্বের শর্ত পূরণ করতে পারা ও সময়টা কমিয়ে নিয়ে আসাই ছিল তার গবেষণার বিষয়। তিনি সফলভবে এই বিলম্বটা ১০০ মিলি সেকেন্ডে নামিয়ে আনতে সক্ষম হন। পরবর্তী সময়ে এ আবিষ্কারের জন্য ২০২১ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ইনভেনশন, ইনোভেশন অ্যান্ড টেকনোলজি এক্সিবিশনে (আইটেক্স) স্বর্ণপদক লাভ করেন তিনি। গবেষণার সাইটেশন সংখ্যার কারণে ২০২৩ সালে বিশ্বের শীর্ষ ২ শতাংশ গবেষকের তালিকায় স্থান পান তিনি। বর্তমানে তিনি আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ার্সের (আইইইই) জ্যেষ্ঠ সদস্য। পাশাপাশি তিনি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) আজীবন সদস্য।
আরও পড়ুন:
বৈষম্য ঘোচানোই সত্যিকার মানবিক অর্জন
ইলদিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান
ইলদিজ তুরস্কের সবচেয়ে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি। প্রকৌশল শিক্ষা ও গবেষণায় স্বনামধন্য এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১১ সালে। শাহেন শাহ শুধু যে শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন, তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এআই অ্যান্ড নেক্সট জেনারেশন ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন ল্যাবের (এএনডব্লিউসিএল) পরিচালকের দায়িত্বও তার কাঁধে। ছোট-বড় মিলিয়ে ছয়টি গবেষণা প্রকল্পের তত্ত্বাবধান করছেন তিনি। ১২ জন স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী ছাড়াও বেশ কয়েকজন স্নাতক শিক্ষার্থী শাহেন শাহের অধীনে গবেষণা করছেন।
গবেষণার আদ্যোপান্ত
২০২৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের কাহরামানমারাসের পাজারসিক জেলায় একটি ৭.৭ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটেছিল। এ ভূমিকম্পে তুরস্কের ১০টি প্রদেশে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে। প্রায় ৫০ হাজার মানুষ মারা যায়। দুর্যোগকবলিত এসব অঞ্চলের বেইস স্টেশনগুলোর প্রায় ৩০ শতাংশ প্রাথমিকভাবে সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়ে। বিদ্যুৎবিভ্রাট এবং ফাইবার লাইন কেটে যাওয়ায় এসব অঞ্চলের ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ বেশ কিছুদিনের জন্য বিচ্ছিন্ন ছিল। সড়কপথ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দুর্যোগকবলিত এলাকায় জনগণের অবস্থান জানা ও ত্রাণ পৌঁছাতে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। বাংলাদেশেও গত বছর ফেনীসহ বিভিন্ন অঞ্চলে যোগাযোগের সমস্যার কারণে উদ্ধারকাজ কঠিন হয়ে পড়েছিল। ইলদিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষককে সঙ্গে নিয়ে এ সমস্যার সমাধান খুঁজতে নেমে পড়েন শাহেন শাহ।
আরও পড়ুন:
ইবিতে শীতের আগমনী বার্তা
মূলত একাধিক ড্রোনের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক সচল রাখার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন শাহেন শাহ। এই প্রযুক্তিতে পাঁচটি ড্রোন একটি বেইস স্টেশনের কাজ করবে। তার এ আবিষ্কার ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বিখ্যাত ‘ড্রোন’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তুরস্কের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত গবেষণা পরিষদ এবং ইলদিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় পরিচালিত এই প্রকল্পে প্রাথমিক সফলতা পাওয়া গেছে। এখন এটি বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে।
শাহেন শাহের উদ্ভাবিত এ পদ্ধতিতে ড্রোনগুলো মোবাইল বেইস স্টেশন হিসেবে কাজ করে। এই সিস্টেমে ৫জি এবং এর বাইরের অন্য প্রযুক্তিগুলোর সঙ্গে একত্রিত হয়ে ধসে পড়া যোগাযোগ পরিকাঠামো প্রতিস্থাপন করতে পারে। এর ফলে তাৎক্ষণিক অবস্থান ট্র্যাক করে অনুসন্ধান এবং উদ্ধারকারী দলের গাইড হিসেবে কাজ করে সময় বাঁচানো সম্ভব। এর মাধ্যমে দুর্যোগের শিকার ব্যক্তিরা পরিবার-পরিজনের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ করে তাদের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাতে পারবে। এই পদ্ধতি উচ্চগতির ডাটা রেট এবং কম লেটেন্সি কমিউনিকেশনের কারণে তাৎক্ষণিক ডাটা বিনিময় সুরক্ষিত করে সমন্বয়ের সুবিধা দেয়।
প্রস্তাবিত এই সিস্টেম একটি জরুরি যোগাযোগব্যবস্থা প্রদান করতে পারে, যা উদ্ধার অভিযানে সাহায্য করবে। এর ফলে ধ্বংসস্তূপের নিচে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা যাবে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে উদ্ধারকারীরা প্রয়োজনীয় উপকরণসহ দ্রুত উদ্ধারকাজ চালাতে পারেন। দ্রুত উদ্ধার অভিযানের ফলে মানুষের জীবন রক্ষা করা আরও সহজ হবে।
এ অভাবনীয় উদ্ভাবনের পর শাহেন শাহ বলেন, ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য জরুরি যোগাযোগের যে পদ্ধতিটি তৈরি করতে পেরেছি, এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় অর্জন। আমি মনে করি, এটা অনেক মানুষের জীবন বাঁচাবে।’ বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘যারা যে বিষয়ে কাজ করে মজা পায়, যার যে বিষয়ে আগ্রহ, সেটা নিয়েই পড়া উচিত। তাহলেই একজন শিক্ষার্থী তার সেরাটা দিতে পারবে।’
আরও পড়ুন:
আগামীর পৃথিবী হবে নিপীড়িত মানুষের
বর্তমানে যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোন প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। ইসরায়েল ড্রোন ব্যবহার করে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর মানবিক বিপর্যয় চালাচ্ছে। কিন্তু ড্রোন ব্যবহার করে মানবিক বিপর্যয়ে পড়া মানুষের জীবন রক্ষার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করলেন এ এফ এম শাহেন শাহ। জরুরি এ যোগাযোগব্যবস্থার কল্যাণে দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট যোগাযোগবিচ্ছিন্নতার সমাধান করা যাবে। ড্রোন প্রযুক্তির এ অভাবনীয় অগ্রগতি ভবিষ্যতে দুর্যোগসহ যে কোনো মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।