বেকারত্বের অন্ধকার ও যুবসমাজের নৈরাজ্য

চিররঞ্জন সরকার
২৩ মে ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বেকারত্বের অন্ধকার ও যুবসমাজের নৈরাজ্য

গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের দীর্ঘকালীন শাসনের অবসান এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বগ্রহণ অনেকের মাঝেই এক নতুন আশার সঞ্চার করেছিল। মানুষ ভেবেছিল এবার বুঝি দেশে একটি ন্যায্য, স্বচ্ছ ও জনগণের অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থার সূচনা হবে। বিশেষ করে তরুণ সমাজ, যারা এই পরিবর্তনের অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল, তারা প্রত্যাশা করেছিল নতুন সরকার আসবে কর্মসংস্থানের বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা নিয়ে, ফিরিয়ে আনবে শিক্ষার পরিবেশ, আর গড়ে তুলবে একটি নিরাপদ, স্থিতিশীল ও স্বপ্নময় ভবিষ্যৎ।

কিন্তু বাস্তবতা ক্রমেই হতাশাজনক হয়ে উঠছে। সরকারের নানা সিদ্ধান্তে দিশাহীনতা ও দায়িত্বহীনতার ছাপ স্পষ্ট, আর কাক্সিক্ষত ইতিবাচক পরিবর্তন এখনও অধরাই থেকে গেছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক শ্রমশক্তি জরিপে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী মাত্র এক বছরে সোয়া তিন লাখ নতুন বেকারের সংযোজন একটি গুরুতর সতর্কসংকেত হয়ে দেখা দিয়েছে। এটি কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং একটি গভীর সামাজিক সংকটেরও প্রতিফলন, যার অনিবার্য ফল হতে পারে আরও অস্থিরতা, ক্ষোভ ও নৈরাজ্য।

দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বিশ্লেষণ করলে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হলোÑ যুবসমাজ একটি চরম অনিশ্চয়তা ও হতাশার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। আদর্শিক রাজনীতি হারিয়েছে তার দিশা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে উঠেছে আন্দোলনের স্থায়ী মঞ্চ আর কর্মসংস্থানÑ সে তো এখন বহু যুবকের কাছে কেবল স্বপ্ন, বাস্তবতার নয়।

সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, চলতি অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে দেশের বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশে, যা গত বছরের একই সময়ের ৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ হারের তুলনায় উদ্বেগজনকভাবে বেশি। সংখ্যাগত দিক থেকে দেখলে চিত্র আরও ভয়াবহÑ বর্তমানে দেশে বেকার যুবকের সংখ্যা ২৭ লাখ ৩০ হাজার। অর্থাৎ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাজার।

এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যা নয়, প্রতিটি সংখ্যার পেছনে আছে এক-একটি স্বপ্নভঙ্গের গল্প। বিবিএসের সংজ্ঞা অনুযায়ী, যারা গত সাত দিনে এক ঘণ্টাও কাজ করেননি, অথচ কাজ খুঁজেছেনÑ তাদেরই ‘বেকার’ হিসেবে গণ্য করা হয়। অর্থাৎ এই বেকারদের একটি বড় অংশ পরিশ্রমে অক্ষম নয়, বরং চাকরির অভাবে, সুযোগের অভাবে তারা কর্মহীন।

অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে বেকারত্বের যে ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা যাচ্ছে, তার পেছনে রয়েছে বহুমাত্রিক কাঠামোগত ও নীতিগত সমস্যা। প্রধানত তিনটি অর্থনৈতিক কারণকে তারা বিশেষভাবে চিহ্নিত করছেনÑ প্রথমত, দীর্ঘদিন ধরে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ, যা ভোক্তা ব্যয় সংকোচনের মাধ্যমে চাহিদা হ্রাস করছে; দ্বিতীয়ত, একটি কার্যকর ও টেকসই বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের অভাব, যেখানে উদ্যোক্তারা নতুন উদ্যোগ গ্রহণে পর্যাপ্ত প্রণোদনা বা নিরাপত্তা পাচ্ছেন না এবং তৃতীয়ত, ব্যাংকিং খাতে ঋণের ওপর উচ্চ সুদহার, যা যেকোনো শিল্প প্রসারণ বা নতুন উদ্যোগ শুরু করার পথে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।

এই অর্থনৈতিক বাধাগুলোর ফলে একদিকে যেমন নতুন উদ্যোক্তার সংখ্যা কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে বিদ্যমান ব্যবসায়ীরাও তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণে আগ্রহ হারাচ্ছেন। পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাচ্ছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা; যেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নেই, সেখানে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ তো দূরের কথা, স্বল্পমেয়াদি ঝুঁকি নিতেও অনেকে ভয় পান। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্বল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নীতিনির্ধারণে অনিশ্চয়তা, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মনোভাবেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অনেক বহুজাতিক কোম্পানি কিংবা সম্ভাবনাময় বৈশ্বিক অংশীদার বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, বা নতুন করে এখানে আসতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

এই বহুবিধ অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার সম্মিলিত ফলাফল হিসেবে সমাজে যে একটি গভীর সামাজিক সংকট তৈরি হচ্ছে, তা সর্বপ্রথম প্রতিফলিত হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকা, শিক্ষার গুণগত মানের চরম অবনতি এবং সামাজিক ন্যায্যতার অভাবÑ এই তিনটি উপাদান একত্রিত হয়ে তরুণদের মধ্যে এক ধরনের ভবিষ্যৎহীনতা, উদ্বেগ ও ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে। ক্রমাগত হতাশাগ্রস্ত এই তরুণরা যখন দেখতে পায়, কঠোর পরিশ্রম কিংবা শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমেও কোনো সম্মানজনক জীবিকা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, তখন তারা আশ্রয় খোঁজে বিকল্প পথেÑ হঠাৎ করে অর্থ ও ক্ষমতা অর্জনের জন্য তারা ঝুঁকে পড়ে রাজপথের অস্থির আন্দোলনের দিকে, দলীয় রাজনীতির ছত্রছায়ায় সুবিধা আদায়ের খেলায় কিংবা কখনও কখনও নেমে পড়ে সহিংসতা ও অপরাধের রাস্তায়।

বিশ্ববিদ্যালয়Ñ যেগুলো হওয়ার কথা ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, মৌলিক গবেষণা এবং প্রগতিশীল নেতৃত্ব তৈরির স্থান, সেগুলোতেও আজ এসব সংকটের ছায়া প্রকট। ছাত্ররাজনীতি এখানে প্রায়শই এক ধরনের ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের রূপ নিয়েছে, যেখানে একাডেমিক পরিবেশ ক্রমেই উপেক্ষিত হচ্ছে। দখলদারিত্ব, দাবিদাওয়া এবং একে অপরের বিরুদ্ধে সহিংস আক্রমণ এখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত চিত্র। এতে শিক্ষার মান যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি সমাজে এক ধরনের সহিংস ও ক্ষমতানির্ভর সংস্কৃতির বিস্তার ঘটছে।

অন্যদিকে দেশের আইনের শাসন ও বিচারপ্রক্রিয়ার দুর্বলতা এবং অবিচারবোধ সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি করেছে, তা ‘মব ভায়োলেন্স’ বা গণপিটুনির মতো বিকৃত সামাজিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রকাশ পাচ্ছে। একটি সংঘবদ্ধ সমাজ যেখানে আইনের ওপর আস্থা রাখতে ব্যর্থ হয়, সেখানে প্রতিটি নাগরিক নিজেই বিচারক হয়ে ওঠার প্রবণতা দেখায়। এ ধরনের সামাজিক বিচ্যুতি শুধু অপরাধ দমন নয়, সামগ্রিক সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও এক ভয়াবহ হুমকি। এর পেছনে যে বড় কারণগুলো কাজ করছে তা হলোÑ বেকারত্বজনিত হতাশা, শিক্ষা ও প্রশাসনে বৈষম্য, এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চয়তার দীর্ঘস্থায়ী চাপ।

এই প্রেক্ষাপটে বেকারত্বকে আর শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে দেখলেই চলবে না। এটি একটি বহুমাত্রিক সামাজিক সংকট, যা তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য, মূল্যবোধ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং সামগ্রিক সামাজিক স্থিতিশীলতাকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।

বেকারত্ব শুধু একটি আর্থিক পরিসংখ্যান নয়; এটি একটি সামাজিক সংকেত, একটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। এবং সবচেয়ে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, এই সংকটের সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে সেই তরুণ প্রজন্ম, যারা দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ কী? প্রথমত, নীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ব্যাংকঋণের সুদহার যৌক্তিক করতে হবে এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সহায়তা দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, কারিগরি ও ব্যবহারিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে যাতে শিক্ষিত বেকাররা কর্মক্ষম হয়ে ওঠে। তৃতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা জরুরি। চতুর্থত, স্টার্টআপ ও প্রযুক্তিনির্ভর খাতে সরকারের বিনিয়োগ ও প্রণোদনা বাড়ানো দরকারÑ কারণ সেখানেই ভবিষ্যতের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলোÑ তরুণদের মধ্যে একটি আশাবাদী ভবিষ্যতের স্বপ্ন ফের জাগিয়ে তোলা।

বেকার যুবকরা যদি নিজের দেশেই নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে না পায়, তাহলে তারা কী করবে? অন্য দেশে পাড়ি দেবে, নাকি ক্ষোভের আগুনে নেমে আসবে রাজপথে? সময় থাকতে রাষ্ট্রকে তার দায় স্বীকার করে দায়িত্ব নিতে হবে, নইলে আজকের এই পরিসংখ্যান আগামীকাল একটি জাতীয় সংকটে রূপ নেবে। তখন শুধু উন্নয়নের পরিসংখ্যান দিয়ে নয়, সামাজিক স্থিতিশীলতা হারিয়ে গিয়ে যে ক্ষতি হবেÑ তা পূরণ করা অসম্ভব হয়ে যাবে।

আজকের বেকার তরুণ মানে শুধুই একটি শূন্য চাকরি নয়Ñ সে এক ভবিষ্যৎহীন স্বপ্নের প্রতীক। তার চোখে কোনো দিকনির্দেশনা নেই, হাতে কোনো কাজ নেই, সামনে কোনো পথ নেই। এই বিশাল জনগোষ্ঠীÑ যারা দেশের সবচেয়ে উৎপাদনক্ষম শক্তিÑ তারা যদি রাষ্ট্র থেকে বারবার অবহেলা পায়, তাহলে তারা রাষ্ট্রকেই অবজ্ঞা করতে শেখে। আর এই উপেক্ষা জন্ম দেয় ক্ষোভের, হিংসার, সহিংসতারÑ যা আমরা রাস্তাঘাটে, ক্যাম্পাসে, এমনকি অনলাইনের ভাষায় প্রতিদিন দেখতে পাই।

বেকারত্ব কেবল একটি অর্থনৈতিক সূচক নয়, এটি একটি সামাজিক আগ্নেয়গিরি, যা প্রতিনিয়ত চাপ সঞ্চয় করছে। যদি এই আগ্নেয়গিরির মুখ বন্ধ রাখতে না পারি, তাহলে তা যে কোনো সময় ফেটে পড়ে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে। তখন উন্নয়নের ভাষণ, পরিসংখ্যানের সান্ত্বনা কিংবা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরিÑ কোনো কিছুই কাজে আসবে না।

সত্যি বলতে কী, তরুণদের কণ্ঠে এখন যে হতাশার ধ্বনি শোনা যাচ্ছে, তা নিছক অভিযোগ নয়Ñ এটি একটি উচ্চারিত অঘোষিত প্রতিরোধ। কাজ নেই, শিক্ষা নেই, স্বপ্ন নেইÑ এই ত্রিমুখী সংকটে আটকে থাকা একটি প্রজন্ম কোনো জাতির জন্য আশীর্বাদ নয়, বরং একসময় অভিশাপ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এখনও সময় আছে। তরুণদের শক্তিকে নৈরাজ্যের পথে ঠেলে না দিয়ে তাকে সৃজনশীলতার পথে কাজে লাগানো জরুরি। রাষ্ট্রকে বুঝতে হবেÑ এই তরুণরাই আগামী দিনের কাণ্ডারি। তাদের কর্মসংস্থান, মর্যাদাসম্পন্ন জীবনের সুযোগ, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের যথার্থ ব্যবস্থা করা কোনো রাজনৈতিক দয়া নয়, এটি একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বÑ একটি বাঁচার দায়। এই দায় পালনে ব্যর্থতা শুধু সরকার বা রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতা নয়, এটি হবে একটি জাতির চূড়ান্ত আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

তাই আসুন, সংকটের মুখোমুখি হই সাহসের সঙ্গে। আর্থিক, সামাজিক ও নীতিগত কাঠামো পুনর্বিবেচনা করে যুবসমাজের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ নির্মাণ করি। অন্যথায় আমাদের আগামী দিনের ইতিহাস রচিত হবে শুধুই বঞ্চনা, ক্ষোভ আর অপ্রত্যাশিত বিস্ফোরণের পাতায়।


চিররঞ্জন সরকার : কলাম লেখক