জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্তি : সমস্যা ও বাস্তবতা

রুমানা হক
২০ মে ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্তি : সমস্যা ও বাস্তবতা

সরকার সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে রাজস্বনীতি ও ব্যবস্থাপনার জন্য দুটি আলাদা বিভাগ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা নানা বিতর্ক ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। মূলত কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানো এবং কর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকে আলাদা করার জন্য এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে মর্মে সরকারের তরফে দাবি করা হয়েছে। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত বর্তমানে প্রায় ৭.৪ শতাংশ, যা এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। তবে বিগত সরকারের আমলে ২০১৫-১৬ সালে জিডিপি হিসাবের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার কারণে জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বেশ কমে আসে। অন্যদিকে বিশ্বে গড় কর-জিডিপি অনুপাত ১৬.৬ শতাংশ, আর মালয়েশিয়ায় এই হার ১১.৬ শতাংশ। সরকারের মতে, দেশের প্রত্যাশিত উন্নয়ন অর্জনের জন্য কর-জিডিপি অনুপাত অন্তত ১০ শতাংশে উন্নীত করা প্রয়োজন, যার পরিপ্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা হয়েছে। এই সংস্কারের মাধ্যমে প্রতিটি বিভাগ তাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণে বেশি মনোযোগ দিতে সক্ষম হবে, বিশেষায়িত দক্ষতা উন্নত হবে, স্বার্থের সংঘাত কমে আসবে এবং প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে বলে সরকার আশা করছে। সরকার বলছে, এই পুনর্গঠন একটি উন্নত ও স্বচ্ছ করব্যবস্থা গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, যা নাগরিকদের চাহিদা ও প্রত্যাশা পূরণে সহায়ক হবে। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও অংশীজনদের অংশগ্রহণের ঘাটতি নিয়ে সমালোচনা উঠেছে। সংশ্লিষ্টদের মতামত ও সুপারিশ উপেক্ষা করে নেওয়া এই সিদ্ধান্তকে অনেকেই রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ জোরদারের প্রয়াস হিসেবে দেখছেন।

সরকার গঠিত রাজস্ব বোর্ড সংস্কারসংক্রান্ত পরামর্শক কমিটির পক্ষ থেকে বিদ্যমান রাজস্ব কাঠামোকে সংস্কারপূর্বক রাজস্বনীতি প্রণয়নের জন্য একটি পলিসি কমিশন গঠন ও বর্তমান রাজস্ব বোর্ডকে অধিকতর শক্তিশালী করে একে নীতি বাস্তবায়নের দায়িত্ব প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু জারিকৃত অধ্যাদেশের মাধ্যমে নতুন দুটি বিভাগ তৈরি করা হয়েছে। রাজস্ব সংস্কার কমিটির যুক্তি ছিল করনীতি তৈরি ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব একক কোনো প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকা উচিত নয়, কারণ এতে স্বার্থের সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে রাজস্ব সংস্কার কমিটি সংস্কারের প্রস্তাবনাটি দিয়েছিল। এই প্রস্তাবনাটি বিভিন্ন অংশীজনের, যেমন- এনবিআরের কর্মকর্তা, অর্থনীতিবিদ, রাজস্ব বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীদের মতামত এবং আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার ভিত্তিতে নেওয়া হয়েছিল। রাজস্ব সংস্কার কমিটি রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত করার কোনো পরামর্শ দেয়নি। কমিটির একাধিক সদস্য গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের মতামত জারিকৃত অধ্যাদেশে প্রতিফলিত হয়নি। তারা আরও বলেছেন, নবসৃষ্ট বিভাগ দুটি সরকারের উদ্দেশ্য সাধনে সহায়ক হবে না, যদি সঠিক জ্ঞানসম্পন্ন এবং সঠিক নেতৃত্ব প্রদানকারী ব্যক্তি বাছাই না করা হয়ে থাকে। তাই বিভিন্ন অংশীজনের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে রাজস্বনীতি ও ব্যবস্থাপনা- এই দুটি আলাদা বিভাগের কার্যকর পরিচালনার জন্য দক্ষ নেতৃত্ব প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে এনবিআরে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন এমন কাস্টমস ও ভ্যাট এবং আয়কর ক্যাডারের যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া উচিত। তবে বর্তমান অধ্যাদেশ অনুযায়ী যে কোনো যোগ্য কর্মকর্তাকে রাজস্বনীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এতে করে ভ্যাট, ট্যাক্স ও কাস্টমসে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনা আরও কমে আসবে ও অভ্যন্তরীণ রাজস্ব ক্যাডারের বদলে বাইরের প্রশাসনিক ক্যাডারের কর্মকর্তারা নেতৃত্বে আসবেন এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতাহীন নেতৃত্ব রাজস্ব প্রশাসনকে আরও পিছিয়ে দিতে পারে।

সম্পূর্ণ রাজস্ব সংস্কারের জন্য শুধু নীতি প্রণয়নকারী ও প্রয়োগকারী সংস্থাকে আলাদা করা যথেষ্ট নয়; বরং আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করা প্রয়োজন। বিগত বছরগুলোতে কাস্টমস ও ভ্যাট এবং আয়কর- এ তিনটি সেক্টরেই কমবেশি অটোমেশন হয়েছে। কাস্টমস শুল্কায়নের জন্য UNCTAD কর্তৃক ডেভেলপকৃত ASYCUDA ব্যবহার করে, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন অনলাইনে পাওয়া যায়, ভ্যাট রিটার্ন অনলাইনে দাখিল করা যায়, অনলাইনে টিন নেওয়া যায় এবং অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা শুরু হয়েছে। এখন এই সিস্টেমগুলোকে আরও উন্নত করার পাশাপাশি সিস্টেমগুলোর মধ্যে অধিকমাত্রায় আন্তঃসংযোগ স্থাপন করা প্রয়োজন। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রের সব রকম লেনদেন ব্যাংকিং চ্যানেলে সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা প্রয়োজন। এভাবে সামগ্রিক অটোমেশন করা হলে কর ফাঁকির সুযোগ কমে যাবে, করদাতা ও কর আদায়কারীর মধ্যে সরাসরি দেখা হওয়ার সুযোগ থাকবে না, ফলে দুর্নীতি কমে যাবে। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় জনবল, সরঞ্জামাদিসহ আয়কর ও ভ্যাট অফিসের সম্প্রসারণ করতে হবে প্রান্তিক পর্যায়ে, যাতে করজাল আরও বিস্তৃত হয়। এ ছাড়া কাস্টমস আধুনিকায়নের চলমান কর্মসূচিগুলোকে (ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো, অথোরাইজড ইকোনমিক অপারেটর ইত্যাদি) বেগবান করা প্রযোজন। এভাবে সামগ্রিক সংস্কার ছাড়া কেবল নীতি আর বাস্তবায়ন পৃথক করলেই দেশের কর-জিডিপির অনুপাত বেড়ে যাবে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে, রাজস্ব আয় বেড়ে যাবে- এমন মনে করার কোনো সুযোগ নেই।

অনেকেই মতামত দিচ্ছেন যে, বিশ্বব্যাংকের শর্ত পূরণ ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণের কিস্তি ছাড় পেতে সরকার এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছে। আইএমএফের ঋণের কিস্তির শর্ত ছিল ‘রাজস্বনীতি ও প্রশাসনকে পৃথক করে দক্ষতা বাড়ানো এবং কর আদায়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।’ যদিও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ দাবি করেছে যে, আইএমএফ সরাসরি এ ধরনের কোনো শর্ত প্রদান করেনি। তবে আইএমএফ যদিও এই ধরনের দাবি তুলে ধরে থাকে, সরকারের জন্য ভালো হতো, এই ধরনের দাবির প্রাসঙ্গিকতা ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে বিচার-বিশ্লেষণ করে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এরপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। সরকারের পক্ষ থেকে তড়িঘড়ি করে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ অর্থনৈতিক অচলাবস্থা ও অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে। বর্তমানে ভ্যাট, রাজস্ব ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের কলমবিরতির কারণে সরকারের দৈনিক প্রায় ১২০০ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরে দেশের রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এমন অবস্থায় এনবিআর বিভাজনজনিত অস্থিরতা রাজস্ব সংগ্রহে আরও সংকট সৃষ্টি করতে পারে। কলমবিরতি পালনের ফলে দেশের প্রধান কর, ভ্যাট ও কাস্টম অফিসগুলো কার্যত অচল হয়ে পড়েছে এবং রাজস্ব আদায়ে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এতে আগামী বাজেট বাস্তবায়নসহ উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বড় ধরনের অর্থনৈতিক চাপে পড়তে পারে।

এ ছাড়া সরকারি বিভাগ ও কর্মকর্তাদের মধ্যে এই নবসৃষ্ট বিভাজন ভবিষ্যতে কর্মকর্তাদের মধ্যে সুহৃদ আচরণ ও সহযোগিতার মনোভাবও ক্ষুণ্ন করতে পারে। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি ও এর প্রভাব রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদে বড় ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসে কিনা, সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন।

সরকারের সর্বদা প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত দেশের জিডিপির তুলনায় রাজস্ব সংগ্রহের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করা। সেই লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে কার্যকরী যে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন সে পদক্ষেপ সরকার নেবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। তবে সরকারের নবগঠিত দুই বিভাগ অধ্যাদেশের কারণে মাঠপর্যায়ে রাজস্ব আহরণে ক্ষতি হওয়া, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির প্রয়োজনে গবেষণা ও প্রয়োজনীয় নীতি-রীতি প্রণয়ন বাস্তবায়নে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে বিলম্ব হওয়া কারও কাম্য নয়।

একই সঙ্গে রাজস্ব সংস্কারের জন্য পরামর্শক কমিটি যেসব সুপারিশ প্রদান করেছে, তা জনসম্মুখে প্রকাশ করে রাজস্ব বিভাগকে আরও গতিশীল ও কার্যকরী করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারলে ভালো। পরামর্শক কমিটি যেসব পরামর্শ প্রদান করেছে, তা পাশ কাটিয়ে ফাঁকফোকরে ভরা অধ্যাদেশ রাতের আঁধারে জারি করে সংস্কারের পরিবর্তে জটিল ও ত্রুটিপূর্ণ কাঠামো প্রণয়নের মাধ্যমে দেশের রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও আহরণের শক্তিশালী মেরুদণ্ডকে বিকল করারই নামান্তর। বর্তমান যে অধ্যাদেশ দেওয়া হয়েছে, এর উদ্দেশ্য যদি সংস্কার আনয়ন হয়, তবে তা যেন বর্তমান ব্যবস্থা ভেঙে আগের চর্চার পুনরাবৃত্তি না হয়।

নতুন অধ্যাদেশ আপাতত স্থগিত করে দুটো নতুন বিভাগের প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে পর্যালোচনা করা উচিত এবং পাশাপাশি দেশের রাজস্ব ব্যবস্থাকে স্বাধীন ও প্রশাসনিক প্রভাবমুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। যাতে রাজস্ব বিভাগ যথাযথ স্বায়ত্তশাসন ও আইনি সুরক্ষা পায়। সত্যিকার সংস্কারের জন্য কাঠামোগত পরিবর্তনের পাশাপাশি পর্যাপ্ত স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

এমন একটি মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তনের আগে পর্যাপ্ত গবেষণা, অংশীজনের অংশগ্রহণ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হলে ভালো হতো। তাড়াহুড়ো করে জারি করা অধ্যাদেশ কোনো পক্ষের জন্য ফলপ্রসূ কিছু বয়ে আনবে না বরং স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে দেশের রাজস্ব আহরণে বড় বাধার সৃষ্টি করতে পারে। এনবিআরের অভ্যন্তরে বর্তমান অসন্তোষ, বিভ্রান্তি এবং প্রশাসনিক অচলাবস্থা তৈরি হওয়া ও আয়কর, ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক- তিনটি প্রধান খাতেই লক্ষণীয় ঘাটতি তারই প্রতিফলন মাত্র।

রাজস্ব খাতে কাঠামোগত সংস্কার অবশ্যই প্রয়োজন, তবে তা পরিকল্পিত, স্বচ্ছ এবং আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করে হলে সব পক্ষের জন্য ফলপ্রসূ হবে। অন্যথায় এটি রাজস্ব সংগ্রহ, বাজেট বাস্তবায়ন ও সামগ্রিক অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। একই সঙ্গে নতুন পদে যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচনের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে পারলে ভালো হবে।


রুমানা হক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়