বাংলাদেশ রেলওয়ে সেবা ও মুনাফা সম্ভাব্যতা
বাংলাদেশে দূরপাল্লার পরিবহন সেবাগুলোর ভেতর রেলওয়ে অদ্যাবধি সর্বাধিক নিরাপদ ও আকর্ষণীয় মাধ্যম হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত। সম্প্রতি পত্রিকান্তরে রেলের আয়-ব্যয় সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন পড়ে বেশ হতাশ হয়েছি। রেলে নাকি এক টাকা আয় করার জন্য আড়াই টাকার বেশি খরচ করতে হয়। অর্থাৎ রেল কর্তৃপক্ষ নিত্যদিনই লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছেন। দিনে দিনে এরূপ লোকসানের পরিমাণ বাড়ছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে কিন্তু রেলওয়ে থেকে তারা লাভ করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে এই সেবা খাতে লোকসান হয় কেন?
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আমরা প্রায় সবাই যাতায়াত ও দূরপাল্লায় পণ্য পরিবহনের জন্য কেবল রেলের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। তখনকার দিনে দেশে রাস্তাঘাটের তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। আমাদের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া যেতে সড়কপথের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। এ ক্ষেত্রে ঢাকা থেকে প্রথমে ভৈরব গিয়ে সেখান থেকে ময়মনসিংহগামী ট্রেনে যেতে হতো। অন্যদিকে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহগামী সরাসরি ট্রেনেও গফরগাঁও স্টেশনে নেমে যাওয়া যেত। দুটো পথেই মোটামুটি সারাদিন লেগে যেত এই ১০০ কিমি. রাস্তা পাড়ি দিতে। সময়ের আবর্তে বাংলাদেশের সর্বত্র জালের মতো বিস্তৃত হয়েছে সড়কপথ। ফলে রেলপথের গুরুত্ব কমেছে। বিকল্প হিসেবে যাত্রীরা এখন সড়কপথ ব্যবহার করেন। কিন্তু জনমনে এখনও রেলপথের প্রতি আনুকূল্য প্রবল।
ইতোমধ্যে রেলসেবারও অনেক উন্নতি হয়েছে। বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে সকালে ঢাকায় আসা ফোরটি ফোর ডাউন ট্রেনের জন্য আমরা যখন মশাখালী স্টেশনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে অপেক্ষা করতাম তখন গাড়ির চারদিকে লাকড়ির বোঝা, সাইকেল, কাঁথা-বালিশের পোঁটলা ঝুলিয়ে ইঞ্জিনের পাশে এবং ছাদে অফুরন্ত যাত্রী নিয়ে এক সময় ট্রেন এসে ঢুকত স্টেশনে। এমন ট্রেনে উঠতে পারা তো একান্তই দুঃসাধ্য। আমরা স্টেশনের কুলিদের আগে থেকেই আট আনা দিয়ে রেডি করে রাখতাম পশ্চাৎদেশে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির জানালাপথে উঠিয়ে দেওয়ার জন্য। গাড়িতে উঠতে পারাটাই ছিল শান্তির। সেই তুলনায় এখন আন্তঃনগর ট্রেন হয়েছে, ঘরে বসে অনলাইনে টিকিট কেনা ও ফেরত দেওয়ার সুযোগ হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঠিক সময়ে গাড়িতে চড়তে পারার নিশ্চয়তা হয়েছে, যাত্রাকালে ঠাণ্ডা বাতাস পাওয়ার নিশ্চয়তা হয়েছে, গাড়ির ভেতরে প্রায়ই অ্যাটেন্ডেন্টের সাক্ষাৎও পাওয়া যাচ্ছে। গাড়ির একটি সিটও খালি থাকছে না (অবশ্য তাদের অনেকের কাছে টিকিট থাকে না; সিটের টিকিটধারী যাত্রী চলে এলে তারা মুখটা বেজার করে অন্য সিটে চলে যান)। তার পরও রেল কর্তৃপক্ষকে লোকসান গুনতে হচ্ছে ব্যাপকভাবে। প্রতিবছর গড়পড়তা ২ হাজার কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে রেলওয়ে।
সারাদেশে বাংলাদেশ রেলওয়ের মালিকানাধীন জমির পরিমাণ ৬২ হাজার একর। তবে জানা যায়, এর মধ্যে সাড়ে তিন হাজার একরেরও অধিক পরিমাণ জমি বিভিন্ন সময়ে স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা দখল করে রেখেছেন, কেউ কেউ বাড়ি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও বানিয়ে ফেলেছেন।
রেলওয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে অনেক বড় অঙ্কের একটা স্থায়ী খরচ থাকে। জমি ক্রয়, রেললাইন বানানো, স্টেশন বানানো, রেলের ইঞ্জিন ও বগি ক্রয় এসব অনেক ব্যয়বহুল। এ ছাড়া এতগুলো সম্পদের বার্ষিক অবচয়ও (উবঢ়ৎবপরধঃরড়হ) কম হওয়ার কথা নয়। এ ছাড়া আছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও মজুরি। লাইনের ওপর দিয়ে যদি মাসে একটি গাড়িও না চলে তা হলেও এই ব্যয়গুলো হবে। আর ট্রেন চললে প্রতিটি ট্রেন চালানোর জন্য জ¦ালানি বা অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় ব্যয়গুলো হবে। এর বিপরীতে রেল কর্তৃপক্ষ পাবে যাত্রীভাড়া ও পণ্য পরিবহনের ভাড়া। সুতরাং যত বেশি যাত্রী ও পণ্য পরিবহন সম্ভব হবে তত বেশি আয় হবে। এভাবেই এক সময় ব্রেক-ইভেন পয়েন্ট ক্রস করে লাভের মুখ দেখতে হবে রেল কর্তৃপক্ষকে। অন্যদিকে আপাতত অপ্রয়োজনীয় জমি ভাড়া দিয়ে যে আয় পাওয়া যাবে সেটা তাদের মুখ্য আয় নয়। তবে সে ধরনের আয় মুনাফা অর্জনের বেলায় কিছুটা সাহায্য করবে বটে।
রেলের সার্ভিস আগের তুলনায় অনেকটাই ভালো হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে এই ভালোকে পুরো ভালো বলা যায় না। রেল কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলে রেলের সেবাকে আরও বহুমুখী ও উন্নত করে রেলের মুনাফা অনেক গুণ বাড়িয়ে দিতে পারেন। আমি এখানে কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
১. গাড়ি চলাচলের সংখ্যা বাড়িয়ে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ঢাকা থেকে কক্সবাজার রুটের কথা। রেল কর্তৃপক্ষ যাত্রার ১০ দিন আগে সকাল ৮টায় অনলাইনে টিকিট বিক্রি শুরু করেন। সকাল ৮টা ৫ মিনিটের ভেতরই কক্সবাজারগামী ট্রেনের প্রায় সব টিকিট বিক্রি হয়ে যায়। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, কক্সবাজার রুটে ট্রেনের চাহিদা ব্যাপক। এই রুটে এবং অন্যান্য জনপ্রিয় চাহিদাসম্পন্ন রুটে গাড়ির সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে।
২. নতুন নতুন রুট চিহ্নিত করে। বাংলাদেশের অনেকগুলো স্থান পর্যটনের জন্য আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষ অনেকটাই পর্যটনমুখী। তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে যান। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে শ্রীমঙ্গল, কিশোরগঞ্জ, মোহনগঞ্জ ইত্যাদি স্থানের কথা বলা যেতে পারে। এসব স্থানে সরাসরি পর্যটন এক্সপ্রেস চালু করা যেতে পারে। ঢাকা থেকে বনলতা এক্সপ্রেস সরাসরি রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ যায়। আমপ্রেমী অনেকেই আমের মৌসুমে সেখানে যান। তাদের জন্য অতিসহজে আম নিয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। আবার কুরিয়ার সার্ভিসের বদলে আম ব্যবসায়ীরা যাতে রেলের সেবা গ্রহণ করে লাভবান ও ঝামেলামুক্ত থাকতে পারেন সে ব্যবস্থা করা যেতে পারে। একইভাবে কিশোরগঞ্জ যাত্রী পর্যটক সরাসরি কিশোরগঞ্জ যাবেন, সারাদিন হাওরে ঘুরে বেড়াবেন এবং দিনশেষে ট্রেনে চড়ে ঢাকা ফিরে আসবেন।
৩. বিলাসবহুল ট্রেন বা কামরা সংযোজন করে। বিশে^র কোনো কোনো দেশে অত্যন্ত আরামদায়ক বিলাসবহুল ট্রেন সার্ভিস রয়েছে। মানুষ পাঁচ-সাত দিনের জন্য এসব ট্রেনে টিকিট কেটে উঠে পড়েন। ট্রেনের ভেতরে খাওয়া-দাওয়া ও ঘুমসহ সব চলছে। একই সঙ্গে ট্রেনও চলছে। কারও ইচ্ছে হলে জানালার পাশে বসে থাকবেন, কারও ইচ্ছে হলে ঘুমাবেন। চলার পথে বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর স্থানে গাড়ি নির্দিষ্ট সময়ের বিরতি দেবে।
আবার শ্রীলংকায় দেখেছি, প্রায় প্রতিটি ট্রেনের সঙ্গেই অন্তত একটি কামরা থাকে বিলাসবহুল। এটি সাধারণত বিদেশিদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়। তবে স্থানীয়রাও এর টিকিট কিনতে পারেন। এসব কামরার সিটগুলো আরামদায়ক। যাত্রাকালে স্থানীয় ও ইংরেজি ভাষায় এলাকার পরিচিতি দেওয়া হয়। প্রতিটি কামরায় একজন সুসজ্জিত অ্যাটেন্ডেন্ট থাকেন, তারা যাত্রীসেবায় নিয়োজিত থাকেন। যাত্রাকালে খাবার, নাশতা ও চা পরিবেশন করা হয়। এ বিষয়টিও ভাবা যেতে পারে।
৪. পণ্য পরিবহনের পরিমাণ বাড়িয়ে। দেশের অভ্যন্তরে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে রেলের চাহিদা বর্তমানে অনেকটাই কমে গেছে। সেবার মান উন্নত করা হলে এবং সড়কপথে পরিবহনের সঙ্গে তুলনায় সাশ্রয়ীভাবে পণ্য পরিবহন সম্ভব হলে এ খাত থেকেও প্রচুর আয় হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
বিদেশে পণ্য রপ্তানি ও বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির বেলায় বৃহদাকার কনটেইনার পরিবহনে এক সময় রেল ছাড়া চিন্তাও করা যেত না। বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠানই নিজস্ব কনটেইনারি পরিবাহী যানবাহন ব্যবহার করছে। তবে এভাবে পরিবহন ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিসম্পন্ন। রেলে পণ্য পরিবহন সাশ্রয়ী ও নিরাপদ বিবেচিত হলে অনেকেই এ সুবিধাটি গ্রহণ করবেন।
৫. অনেকগুলো রুটে কমিউটার সার্ভিস চালু করে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর বর্তমানে জনসংখ্যার ভারে বিপর্যস্ত। এখানে আর ঠাঁই নেই। ভারতে যেমন কাছাকাছি অন্যান্য শহরের আবাস স্থাপন করা লোকরা ট্রেনে চড়ে প্রতিদিন মূল শহরে অফিস করতে আসেন এবং দিনের শেষে ট্রেনে চড়েই নিজ ঘরে ফিরে যান তেমন উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। আমি কলকাতা ও মুম্বাই শহরে এমনটি দেখেছি। আবার সিঙ্গাপুরে কর্মরত হাজার হাজার মালয়েশীয় নাগরিক প্রতিদিন সকালে সিঙ্গাপুর আসেন এবং সন্ধ্যের পর মালয়েশিয়া ফিরে যান। বাংলাদেশেও ঢাকার চারপাশে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, জয়দেবপুর, ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে সকালে এবং বিকালে যথেষ্টসংখ্যক কমিউটার ট্রেনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হলে যাত্রীরা মাসিক টিকিট কেটে সার্ভিস গ্রহণ করবেন বলেই আমার বিশ^াস। ফলে রেল কর্তৃপক্ষ অগ্রিম টাকা পেয়ে যাবে।
৬. রেলের অন্যান্য সম্পদ কাজে লাগিয়ে। দেশব্যাপী রেলের বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে। এগুলোতে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা তৈরি করে ভাড়া দেওয়া যেতে পারে। আধুনিক মার্কেট, পার্কিং স্পেস, হাসপাতাল ইত্যাদি ধরনের প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যেতে পারে।
এ ছাড়া জনগণের কাছ থেকে প্রস্তাব বা পরামর্শ আহ্বান করে সেভাবে রেল কর্তৃপক্ষ নিজেদের বিবেচনায় আয়বর্ধক উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। এতে রেলের প্রতি মানুষের সম্পৃক্ততা ও আন্তরিকতা বাড়বে। তা ছাড়া ভালো পরামর্শ পাওয়ার সুযোগও সৃষ্টি হবে। তবে যেমন করেই হোক, লোকসানের থাবা থেকে রেলওয়েকে বেরিয়ে আসতে হবে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
মাহফুজুর রহমান : লেখক ও সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক