ফুটবলে মোহামেডানের আনন্দময় প্রত্যাবর্তন

জাহিদ রহমান
১৯ মে ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ফুটবলে মোহামেডানের আনন্দময় প্রত্যাবর্তন

এ দেশের কোটি কোটি ফুটবলামোদীর প্রিয় ফুটবল দল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। ফুটবলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে এ এক স্বর্ণালি নাম। ফুটবলের সোনালি দিনে মোহামেডান সমর্থকদের উপস্থিতিতে স্টেডিয়ামের গ্যালারি পূর্ণ হয়ে যেত। দেশের ফুটবলে ঐতিহ্যবাহী এই দল ঘিরে উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ত সারাদেশে। ফুটবল আভিজাত্য আর অহংকারে এই ক্লাব দেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে লেখা এক নাম।

জন্মলগ্ন থেকেই ফুটবলে অপ্রতিরোধ্য এক শক্তি হিসেবে খ্যাত ছিল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। অসংখ্য তারকা ফুটবলার জন্ম নেন এ ক্লাব থেকেই। আবার আশি ও নব্বই দশকে সবাইকে বারবার টপকে নতুন নতুন ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। এ উপমহাদেশে ফুটবলের কোনো ইতিহাসই তাই মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ছাড়া একেবারেই অসম্পূর্ণ। সেই মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ফুটবলে অনেক দিন ধরে ছিল শিরোপাহীন। মোহামেডান যেন সব লড়াই থেকেই ছিটকে পড়েছিল। আর তাই মোহামেডানের জৌলুষ আর কৃতিত্ব যেন ইতিহাসের পাতা থেকে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছিল।

মোহামেডানের সর্বশেষ ঢাকা লীগ জয় ছিল ২০০২ সালে। এরপর আর সিংহাসনে ফিরতে পারেনি। প্রায় দুই যুগের কাছাকাছি সময় কেটে গেলেও তাদের শিরোপা বঞ্চনা নিয়ে থাকতে হয়। এর মধ্যে ঢাকার ফুটবলে নানা পরিবর্তন ঘটে। ২০০৭ সালে দেশে পেশাদার ফুটবল লীগ চালু হয়। নতুন নতুন শক্তির আবির্ভাব ঘটে। নতুন ফরম্যাটে ফুটবল শুরু হয়। বসুন্ধরা আর অন্যান্য দলের কারণে মোহামেডানকে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যেতে হয়। কিন্তু সংগঠকরা হাল ছাড়েননি। বিজয়ের স্বাদ নিতে ঐক্যবদ্ধ থেকেছেন। অবশেষে ২৩ বছর পর মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে ফের নতুন করে যেন ফুল ফুটেছে। ১৭ মে পেশাদার লীগ প্রথমবারের মতো জয় করেছে এই ক্লাব। আর ২৩ বছর ধরে যে শিরোপার বাইরে ছিল সেই দুঃসহ যন্ত্রণাও তারা ঘোচাতে সক্ষম হয়েছে। এদিন মোহামেডানের কোনো খেলা ছিল না। কিন্তু পয়েন্ট তালিকায় ভালো অবস্থানে থাকার কারণে আগেই চ্যাম্পিয়নের সুবাস তাদের নাকে আসছিল। এদিন মোহামেডানের চ্যাম্পিয়ন নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবাহনী ও ফর্টিস ক্লাবের মধ্যকার ম্যাচটি আবাহনীর বিপক্ষে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। শেষ পর্যন্ত ঘটেও তাই। কুমিল্লার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে ফর্টিস এফসি আবাহনী লিমিটেডকে ২-১ গোলে পরাজিত করে। আর এই সংবাদেই মোহামেডান ক্লাবে আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে থাকে। দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন কর্মকর্তা, সমর্থকরা। কোচ, ম্যানেজাররা আগেই ক্লাবে অপেক্ষা করছিলেন। শুরু হয় উৎসব আর উৎসব।

সে কথাই বলছিলেন সাবেক তারকা ফুটবলার, মোহামেডান ক্লাবের সাবেক কোচ-ম্যানেজার ইমতিয়াজ সুলতান জনি। তার মতে. মোহামেডান অনেক দিন ধরেই এমন এক মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য মুখিয়ে ছিল। গত কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করছিল। অবশেষে কর্মকর্তা, কোচ, খেলোয়াড়, সমর্থকÑ সবার সম্মিলিতি প্রচেষ্টায় বিজয়ের আলো জ্বলে উঠেছে মোহামেডান ক্লাবে। জনির মতে, মোহামেডানের এই বিজয় খুব প্রয়োাজন ছিল। একটি ঐতিহ্যবাহী ক্লাব অনেক দিন ধরে শিরোপাবঞ্চিত ছিলÑ এটি সবার মনঃকষ্টের কারণ ছিল। চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জনের মধ্য দিয়ে এখন শুরু হলো নতুন এক পথচলা।

মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের জন্ম ১৯৩৬ সালে ঢাকার হাজারীবাগে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব প্রথমবারের মতো ঢাকা লীগ চ্যাম্পিয়ন হয় ১৯৫৭ সালে। এরপর মোহামেডানকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একাত্তরের যুদ্ধের আগ পর্যন্ত বেশ কয়েক বছর (১৯৫৯, ১৯৬১, ১৯৬৩, ১৯৬৫, ১৯৬৬, ১৯৬৯) এই দলটি ওয়ান্ডারার্সের মতো দাপুটে দলকে পেছনে ফেলে লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে ফের ফুটবল লীগ শুরু হয়। সে বছরের ১১ জুলাই অনুষ্ঠিত প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব আবাহনী ক্রীড়া চক্রের কাছে ২-০ গোলে হেরে রানার্স আপ হয়। কিন্তু এরপর চ্যাম্পিয়নের আসনে ফিরে আসতে সময় লাগেনি। ১৯৭৫ ও ১৯৭৬ সালে টানা দুবার এই জনপ্রিয় দল চ্যাম্পিয়ন হয়।

আশির দশকে মোহামেডান আরও নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। তখন ফুটবলে তারকার ছড়াছড়ি। মোহামেডানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী ক্রীড়া চক্র (বর্তমানে আবাহনী লি.)। সাদা-কালো জার্সির লড়াই উপভোগ করতে স্টেডিয়ামে দর্শকের ঢল নামে। মোহামেডানের চ্যাম্পিয়নশিপের তালিকা অনেক দীর্ঘ। ঢাকা লীগে স্বাধীনতার আগে ও পরে মিলিয়ে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মোট ১৯ বার। এ ছাড়া ২০০২, ২০০৫-২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত নিটল-টাটা জাতীয় লীগে চ্যাম্পিয়ন হয় ঐতিহ্যবাহী এই দল। এ ছাড়াও এই দলটির মোট ১১ বার ফেডারেশন কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অনন্য রেকর্ড রয়েছে। আবার স্বাধীনতা দিবস কাপে এই দলটি তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয় (১৯৭২, ১৯৯১ ও ২০১৪)। এ ছাড়াও পাকিস্তান আমলেও মোট পাঁচবার স্বাধীনতা দিবস কাপ জয় করে। ১৯৬৬ সালে অল পাকিস্তান মোহাম্মদ আলী বোগড়া শিল্ড জয়ের কৃতিত্বও রয়েছে। আবার ২০০৯ ও ২০১৩ সালে সুপার কাপ জয় করে। ১৯৯০ সালে মা মনি কাপ জয়ের কৃতিত্বও এই ক্লাবটির। ডামফা কাপ জয়লাভ করে ১৯৮৪, ১৯৯৩ ও ১৯৯৫ সালে। আগা খান গোল্ডকাপ জয়েও রয়েছে মোহামেডানের অনন্য কৃতিত্ব। ১৯৫৯, ১৯৬৪ ও ১৯৬৮ সালে এই দলটি আগা খান গোল্ড কাপ নিজেদের ঘরে তোলে। বিদেশের মাটিতেও শিরোপা জয়ের কৃতিত্ব রয়েছে মোহামেডানের। ১৯৮২ সালে ক্লাবটি ভারতের মাটিতে আশীষ-জব্বার শিল্ড টুর্নামেন্ট জয়লাভ করে। ১৯৮৮ সালে জেসি গুহ মেমোরিয়াল ট্রফিতে রানার্স আপ হয়। ১৯৮৯ সালে বরদুলাই ট্রফির লড়াইয়ে রানার্স আপ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। ১৯৯৫ সালে অনুষ্ঠিত আইএফএ শিল্ড কাপেও রানার্স আপ হয়। সর্বশেষ ১৯৯৯ সালে অল এয়ারলাইন্স গোল্ডকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে।

এই ক্লাবের সঙ্গে জড়িত রয়েছে অসংখ্য তারকা ফুটবলারের নাম, যে নামগুলো এখনও জীবন্ত। তাদের অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন, কিন্তু নামগুলো ইতিহাসে চাপা পড়েনি। প্রয়াত ননী, পিন্টু, মঈন, কায়কোবাদ, শরীফ, প্রতাপ, মেজর হাফিজ, নওশের, ওয়াজেদ, গাজী, মঞ্জু, আইনুল, জিল্লুরÑ সত্তর দশকের সর্বভাগে এ সবই সুবাসিত নাম। এরপর গোলাম সারোয়ার টিপু, সান্টু, মালা, বাটু, রকিব, ভানু, তোতা, কালা গফুর, রামা, ফজলু, ইউসুফ, বাদল, ছোট বাদল, মজিদ, আবুল, কোহিনুরÑ এসব নাম এখনও দ্যুতিময়। আশির দশকে আরও এক-এক করে এই ক্লাবে যুক্ত হয়ে যারা দ্যুতি ছড়ান তারা হলেন মোসাব্বের, সালাম, গাফফার, স্বপন, বেলাল, মনি, হাসানুজ্জামান বাবলু, আসলাম, আজমত, বাবুল, জোসী, কাজী কামাল, রণজিত, মহসীন (গোলরক্ষক), কায়সার হামিদ, ইলিয়াস, মনু, গিয়াস। এর পরে এসে যুক্ত হন অলক, মন্টু, এমিলি, সাব্বির, কানন, জলি, আলফাজ, আরমানরা। অনেক বিদেশিও খেলেছেন এই দলে। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে রয়েছেন গণেশ থাপা, ইব্রাহিম, মর্তুজা ইয়াক্কি, এমেকা, বোরহানজাদেহ, নালজেগার, ভিজেন তাহিরি, রান্নাচাইওয়াথ, চিমা, জিবতনিকভ, রহিমভ, কাজাকভ, ভিতালি, লাডি বাবা লোলা, বোডে বাবা লোলা, সানডে।

দেশের ফুটবল ঘিরে সেই আগের মতো উত্তাপ আর উন্মাদনা নেই। সত্তর, আশি, নব্বই দশকে ফুটবল ছিল এ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় খেলা। ফুটবলের যে কোনো লড়াইকে কেন্দ্র করে তাই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ত মহা-উন্মাদনার ঢেউ। আর সেই উন্মাদনার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ত মূলত দেশের দুই শীর্ষ ক্লাব মোহামেডান ও আবাহনীÑ এই দুই ক্লাবের চিরায়ত লড়াইকে কেন্দ্র করে। ফুটবলের ময়দানি লড়াইয়ে মোহামেডান আর আবাহনীর গল্প শেষ করার নয়। রূপকথার সেই ফুটবল হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। সবই এখন তাই অতীত সোনালি স্মৃতি। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব নিঃসন্দেহে এ দেশের বড় অংশের ফুটবল অনুরাগীদের কাছে এক আবেগের নাম। মোহামেডান বছরের পর বছর চ্যাম্পিয়ন না হওয়ার কারণে তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণের শেষ ছিল না। অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষার পর এক নতুন যুগের সূচনা করেছে তারা। ফুটবলে মোহামেডানের এই আনন্দময় প্রত্যাবর্তন এবং নতুন পথচলা দেশের ফুটবলকে আবার বিকশিত করতে সাহায্য করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।


জাহিদ রহমান : ক্রীড়া লেখক ও গবেষক