বিদেশ ভ্রমণে গন্তব্য সংকুচিত হওয়া কাম্য নয়

চপল বাশার
১৮ মে ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বিদেশ ভ্রমণে গন্তব্য সংকুচিত হওয়া কাম্য নয়

খবরটা পড়ে মোটেই ভালো লাগেনি। বাংলাদেশের কোনো নাগরিকেরই ভালো লাগার কথা নয়। গত রবিবার ঢাকার একটি বাংলা দৈনিকের প্রথম পাতায় বিশেষ প্রতিবেদন হিসেবে খবরটি ছাপা হয়েছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা ইস্যু বন্ধ করেছে ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া। আগে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে কেউ ভিয়েতনাম বা ইন্দোনেশিয়া গেলে ‘অন অ্যারাইভাল ভিসা’ নিয়ে সেদেশে প্রবেশ করতে পারতেন। এখন আর সে সুযোগ নেই। এই দুই দেশে যেতে হলে আগেই ভিসা নিতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের পর্যটকদের জন্য সেই সুবিধাও কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।

বিশেষ প্রতিবেদনটিতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে বলা হয়, ‘বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা অনুমোদনে নানা শর্ত ও জটিলতা বাড়িয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াও। এ তিন দেশের জন্য অনেক ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। যারা বেশ কয়েকবার এসব দেশ ভ্রমণ করেছেন তাদের ভিসা আবেদনও অনুমোদন হচ্ছে না। বাংলাদেশিদের ভিসা ইস্যুর জন্য নতুন অনেক শর্তও জুড়ে দেওয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।’

এক সময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং প্রতিবেশী ভারত ছিল বাংলাদেশের মানুষের বিদেশ গমনের প্রধান গন্তব্য। অনেকেই পর্যটনের মাধ্যমে ভ্রমণ শুরু করে পরে উন্নত জীবন বা কাজের খোঁজে থেকে যেতেন। কিন্তু আজ ছবিটা একেবারে ভিন্ন। একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে গন্তব্যের দরজা।

আগে ভিয়েতনাম বাংলাদেশের পর্যটকদের জন্য ‘অন অ্যারাইভাল ভিসা’ সুবিধা দিয়ে আসছিল। এই সুবিধার কারণে বাংলাদেশের বহু মানুষ বেশ কয়েক বছর ধরে ভিয়েতনাম যাচ্ছিলেন। পর্যটকদের অনেকেই ভিয়েতনাম থেকে পার্শ্ববর্তী লাওস ও কম্পোডিয়ায় বেড়াতে যেতেন, আবার ফিরে আসতেন। এক সময় দেখা গেল ভিয়েতনামে যারা ‘অন অ্যারাইভাল ভিসা’ নিয়ে গিয়েছেন, তাদের অনেকেই আর দেশে ফিরে আসছেন না। অনেকে সেখান থেকে অন্য দেশে অবৈধ পথে চলে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কেউ কেউ ভিয়েতনামেই কাজের ব্যবস্থা করে থেকে যাচ্ছেন। এমনই পরিস্থিতিতেই ভিয়েতনাম বাংলাদেশিদের জন্য ‘অন অ্যারাইভাল ভিসা’ এবং পরে ট্যুরিস্ট ভিসাও বন্ধ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়াও একই কারণে বাংলাদেশিদের জন্য দরজা বন্ধ করেছে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডও বাংলাদেশিদের ভিসা দিতে কড়াকড়ি বাড়িয়েছে। এসব ব্যবস্থা বাংলাদেশের জন্য মোটেই সম্মানজনক নয়, এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

কেবল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশগুলো নয়। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশও বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীদের ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে অথবা কড়াকড়ি আরোপ করেছে। গত বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা ইস্যু বন্ধ করে দেয় মধ্যপ্রাচ্যের সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও অভিবাসী শ্রমিকের পাশাপাশি পর্যটন ভিসাও বন্ধ করে দেয় দেশটি। সম্প্রতি বাংলাদেশিদের জন্য সীমিত পরিসরে ভিসা চালুর ঘোষণা দিয়েছে ইউএই।

আগে স্বল্পবিত্ত বা মধ্যবিত্ত বাংলাদেশিদের ভ্রমণের সবচেয়ে বড় গন্তব্য ছিল ভারত। ভারত ভ্রমণে গিয়ে অনেক বাংলাদেশি নাগরিক স্থলপথে নেপাল ও ভুটানেও যেতেন। এ দুটি দেশ ভ্রমণে বাংলাদেশিদের আগাম ভিসার প্রয়োজন হয় না। ‘অন অ্যারাইভাল ভিসা’ নিয়েই বাংলাদেশের পর্যটকরা এই দুই দেশে যেতে পারেন। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্টের পর ভারত বাংলাদেশি নাগরিকদের ভিসা দেওয়া কার্যত বন্ধ রেখেছে। ফলে জরুরি চিকিৎসা ছাড়া পর্যটনের জন্য বাংলাদেশিদের ভারত যাওয়া এখন বন্ধ। এ কারণে নেপাল ও ভুটান যাওয়াও সীমিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশের নাগরিকদের বিদেশ ভ্রমণের গন্তব্য সংকুচিত হয়েছে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন এমনটা হলো? সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ মহল মনে করেন বহু বাংলাদেশি ভিসার নিয়ম না মেনে বিদেশে গিয়ে সেখানেই থেকে যাচ্ছেন বা সেখান থেকে অবৈধ পথে অন্য দেশে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের পাসপোর্ট দিয়ে ভিয়েতনামে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ফিরে আসেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। কেউ স্থানীয় ছোটখাটো কাজে জড়িয়ে পড়ছেন। কেউ আবার সেখান থেকে অবৈধভাবে ইউরোপ বা অন্য দেশে পাড়ি দিচ্ছেন।

এর ফলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে, বাংলাদেশিরা ভিসা ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে অবৈধ অভিবাসনের পথ নিচ্ছেন। এসব ঘটনা বাংলাদেশের ভিসা আবেদনকারীদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিচ্ছে এবং সে কারণেই ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি।

ভিসা প্রদানে কড়াকড়ির ফলে বেশি ভুগছে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে স্বল্পবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষ যারা ভ্রমণপ্রেমী ও চাকরিপ্রত্যাশী। যারা আগে ভারত, নেপাল, ভুটান ঘুরে পর্যটনের অভিজ্ঞতা অর্জন করতেন, পরে বড় গন্তব্যে যেতেন তাদের সে সুযোগ এখন বন্ধ। এখন অনেকেই থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরের মতো দেশে যেতে ভিসার আবেদন করছেন। কিন্তু বেশির ভাগ আবেদনই ফেরত দেওয়া হচ্ছে। এতে আবেদনকারীদের সময় ও অর্থের অপচয় হয়। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

এই পরিস্থিতি কাম্য নয়। এই সমস্যা মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। সেটা কীভাবে সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব, সেজন্য একাধিক ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এবং প্রশাসনিক সব ক্ষেত্রেই কার্যকর উদ্যোগ ও ব্যবস্থা প্রয়োজন।

প্রথমত, দেশের ভেতরে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। যতদিন না দেশের তরুণদের জন্য সম্মানজনক চাকরি, উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়, ততদিন বিদেশ যাওয়ার ঝোঁক থেকেই যাবে। তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি, ক্ষুদ্রশিল্প ও পরিষেবা খাতে নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে জোর দিতে হবে। এজন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের উদ্যোগও জরুরি।

দ্বিতীয়ত, দক্ষ অভিবাসন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। বিদেশে যেতে আগ্রহীদের জন্য প্রশিক্ষণ, ভাষা শিক্ষা ও আইনগত পরামর্শ থাকা প্রয়োজন। সরকার ও এনজিওগুলো মিলে একটি টেকসই ‘প্রি-ডিপারচার ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম’ চালু করলে বিদেশে যেতে আগ্রহীরা উপকৃত হবেন। এতে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি বা দালালের খপ্পরে পড়ার আশঙ্কা কমে যাবে।

তৃতীয়ত, পাসপোর্ট ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে হবে। যারা প্রকৃতভাবে ভ্রমণে যেতে চান, তাদের জন্য একটি পরিষ্কার ও সহজ পদ্ধতি থাকা দরকার। ডিজিটাল পাসপোর্টে বায়োমেট্রিক তথ্যের সঠিক ব্যবহার ও যাচাই-বাছাইয়ের ব্যবস্থা জোরদার করা উচিত।

চতুর্থত, কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরও বাড়াতে হবে। যেসব দেশে বাংলাদেশিদের ভিসা জটিল হয়েছে বা বন্ধ হয়েছে, সেসব দেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। ইতোমধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে আংশিক সাফল্য এসেছে, সীমিতসংখ্যক ভিসা দেওয়া শুরু হয়েছে। এ ধরনের সাফল্য বড় আস্থা অর্জনের পথ প্রশস্ত করবে।

শেষ কথা হচ্ছে, বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন অপরাধ নয়। বরং তা একজন মানুষের আশাবাদ, চেষ্টা আর উন্নত জীবনের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন। কিন্তু যখন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে মানুষ অবৈধ বা প্রতারণার পথ বেছে নেয়, তখন তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্য যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি জাতির জন্যও লজ্জাজনক।

তরুণরা যাতে বিদেশে গিয়ে মর্যাদার সঙ্গে কাজ করতে পারেন, বৈধ পথে যান এবং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেন, সেজন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত ও বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা। কর্মসংস্থান, দক্ষতা উন্নয়ন, সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থা, পাসপোর্ট ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আস্থা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হতে পারে।


চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক