ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে কে জিতল কে হারল
মিডিয়ার যুগে যুদ্ধ দুই প্রকার : সরাসরি যুদ্ধ আর তথ্যযুদ্ধ। এক ফ্রন্টে সরাসরি সম্মুখযুদ্ধ, আরেক ফ্রন্টে মিডিয়া নিজেই যুদ্ধক্ষেত্র। সরাসরি যুদ্ধ শুরুর আগেই মিডিয়ায় যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে তথ্য হলো প্রধান অস্ত্র। তথ্য প্রচারের মাত্রা আর ভঙ্গি বলে দেয়, তথ্য অস্ত্র কতটুকু বিধ্বংসী। যেসব দেশ যুদ্ধে জড়ায় বা জড়াতে চায়, সেসব দেশের সরকার যুদ্ধ শুরু করার আগে দুটো দিকে লক্ষ করে : ১. অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সমৃদ্ধ হয়েছে কিনা ২. আকর্ষণীয় তথ্যে সমৃদ্ধ হচ্ছে কিনা। সরাসরি যুদ্ধের আগে প্রত্যেক সরকার নিজেদের যুদ্ধে জড়ানোর পক্ষে জোর প্রচারণা চালায়। সংবাদপত্র, টেলিভিশন আর সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগায় যুদ্ধের পক্ষে সম্মতি প্রতিষ্ঠার জন্য। যুদ্ধের পক্ষে সম্মতি তৈরির প্রধান পদ্ধতি হলো চিহ্নিত ‘শত্রু’র বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চালানো।
শব্দের অলংকারে সরকারি ভাষ্য প্রচার করা হয়। সেই ভাষ্যে বোঝানো হয়, ‘যুদ্ধ আমরা চাই না, আমাদের যুদ্ধে নামতে বাধ্য করা হচ্ছে।’ এখানে শত্রুপক্ষকে এই বলে চিত্রিত করা হচ্ছে যে, শত্রুরা যতটা এ দেশের সরকারের বিরুদ্ধে, তার চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় এই জাতির বিরুদ্ধে। মিডিয়ার প্রচারণা থেকে স্পষ্ট করা হয় যে, যুদ্ধটা এক দেশের সরকার বনাম আরেক দেশের সরকার নয়। এক দেশের বিরুদ্ধে আরেক দেশের যুদ্ধ; এক জাতির বিরুদ্ধে আরেক জাতির। সরকার যেন জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে জাতির ত্রাণকর্তা। সরকার ভালো করেই জানে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকারপ্রধান-নির্বাচনে জাতি বিভক্ত হয়ে পড়লেও যুদ্ধের ক্ষেত্রে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়। শুধু তাই নয়, একটা দেশের সরকার জনপ্রিয়তা হারালে তা উদ্ধারের মোক্ষম পদ্ধতি হলো যুদ্ধ।
মানুষ যুদ্ধ চায় না। কিন্তু মানুষ সেই যুদ্ধ চায়, যে যুদ্ধকে মিডিয়ার প্রচারে অনিবার্য করে তোলা হয়। মিডিয়া এমনভাবে দেশপ্রেমকে জাতীয়তাবাদের স্লোগানে জাগিয়ে তোলে, জাতি তখন যুদ্ধের প্রশ্নে দ্বিধান্বিত থাকে না। দেশে যদি বহুদলীয় গণতন্ত্র থাকে, সেই বহুদল যুদ্ধের প্রশ্নে একদলে রূপান্তরিত হয়। এখানেই সরকার শক্তিশালী হয়। যদিও সেই ঐক্য স্থায়ী নয়। কেননা যুদ্ধে পরাজয় হলে অতিদ্রুত সরকার জনসমর্থন হারায়। নেপোলিয়নের প্রতি ফ্রান্সের জনসমর্থন ততদিন ছিল, যতদিন সে বহু অঞ্চল দখল করতে পেরেছিল। যখনই নেপোলিয়ন পরাজিত হয়, তখন তার ভাগ্যে জোটে নির্বাসন। অতঃপর মৃত্যু। এর মানে জনগণ সেই যুদ্ধ চায়, যে যুদ্ধে তারা জিতবে।
সরকার মিডিয়াকে দিয়ে এমন প্রচারণা চালায়, যেন এই যুদ্ধের চূড়ান্ত অর্থ দাঁড়ায় বিজয়। প্রচারণায় স্থান পায় যুদ্ধাস্ত্রের তথ্য, বহুবিধ রণকৌশলের গল্প, যুদ্ধের ইতিহাস আর ঐতিহ্য। বিশ্বকাপ ম্যাচের মতো ইতিহাসের পর্যালোচনা চলে দফায় দফায়। বিশ্লেষণে এই ধারণা প্রতিষ্ঠা পায় যে, এবার জয় অবশ্যম্ভাবী। এরই সঙ্গে এই প্রচার করা হয় যে, এই যুদ্ধে শুধু সরকারই নয়, বিরোধী দলসহ অন্য সব দলের জোরালো সমর্থন রয়েছে। সর্বদলীয় সংলাপ করে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংলাপ যুদ্ধকে অনিবার্য করে। সংলাপে থাকে সমর্থন। এমন সমর্থন দেখে পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
‘শত্রু’ দেশের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখনও মিডিয়ায় তথ্যযুদ্ধ চলে। যুদ্ধের আগে, যুদ্ধচলাকালীন এবং যুদ্ধের শেষেও তথ্যযুদ্ধ অব্যাহত থাকে। তথ্যযুদ্ধে জড়িত প্রত্যেক দেশ নিজেদের সপক্ষে এমনভাবে প্রচার চালায়, জনগণ বাধ্য হয়ে সরকারি তথ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়।
যখন সরাসরি যুদ্ধ হয়, তখন এক দেশের বাহিনী ‘শত্রু’ দেশের ওপর আক্রমণ চালায়। একই সঙ্গে সেই দেশের সরকারি ও বেসরকারি মিডিয়া আক্রমণের সচিত্র প্রতিবেদন তথ্য আকারে প্রচার করে। পুরো দেশের জনগণ মিডিয়ার সামনে অবস্থান করে যুদ্ধের তথ্য জানার জন্য। মনেপ্রাণে তারাও যোদ্ধা। যুদ্ধের আসল প্রকৃতি সাধারণ জনগণের পক্ষে বোঝা মুশকিল। সেই সুযোগে ‘প্রতিপক্ষের ক্ষতি বেশি হয়েছে আর নিজেদের ক্ষতি কম হয়েছে’- এমন ধারণা প্রচার করা হয়। তথ্য লুকিয়ে তথ্য প্রচারের চর্চা যুদ্ধের বেলায় বেশি লক্ষ করা যায়। সরকারি মিডিয়ায় প্রচার করা হয়, ‘সন্ত্রাস দমনে আমরা অনেকদূর এগিয়ে গেছি।’ এমন কথা শুনে মিডিয়ার সামনে বসা সাধারণ জনগণ খুবই আশ্বস্ত হয়। সরকারকে বাহবা জানায়। জনগণ সত্য-মিথ্যার মিশেলে বানানো তথ্যের প্যাকেজে দারুণভাবে প্রভাবিত হয়। বেশি মিথ্যার সঙ্গে অল্প সত্য মেশানো হলে তা যেন জনগণের কাছে সবচেয়ে বেশি সত্য। এমন ধারণা প্রকাশ পায় দার্শনিক ও সমাজতাত্ত্বিক জ্যা বড্রিয়ার (Jean Baudrillard)) তত্ত্বে। তার তত্ত্বের নাম হাইপার রিয়েলিটি। ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর জ্যা বড্রিয়ার পত্রিকায় এক আর্টিকেল লেখেন। যার শিরোনাম ছিল- ‘The Gulf War did not happen।’ এমন শিরোনামের কারণ ছিল এই যে, আগে যেভাবে যুদ্ধ হতো আর যুদ্ধ সম্পর্কে মানুষ যেভাবে ধারণা নিত, মিডিয়ার অধ্যায়ে সেই যুদ্ধের ধরন পাল্টে যায়। এখন সবচেয়ে বড় ধরনের যুদ্ধ হয় মিডিয়ায়। মানুষ যুদ্ধের ধারণা নেয় মিডিয়া থেকেই। সেই ধারণা সত্য-মিথ্যার মিশেলে হলে মানুষ তা একেবারে সত্য মনে করে।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ তা থেকে আলাদা কিছু নয়। ভারত যুদ্ধ শুরু করে ‘সন্ত্রাসবাদের’ বিরুদ্ধে লড়াই- এমন পপুলার বাক্য ব্যবহার করে। মার্কিন প্রজেক্ট থেকে ধার করা ধারণা। দুই দেশ পারমাণবিক শক্তিধর, সেই কারণে বিপদ বেশি। তবুও দুই দেশের মধ্যকার যুদ্ধ এড়ানোর জন্য কেউ উদ্যোগ নেয়নি। যুদ্ধ শুধু দুই দেশের যুদ্ধ নয়। যুদ্ধের হিসাব-নিকাশ অনেক ব্যাপক। যেসব দেশ থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্র কেনা হয়েছে, যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেসবের গুণগত মান পরীক্ষা করা হয়। সেদিক থেকে চিন্তা করে কিছু কিছু দেশ চায় যুদ্ধ চলুক। ভারত পাকিস্তানে আক্রমণ করতে ইসরায়েল ও ফ্রান্সের অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান ও মিসাইল ব্যবহার করেছিল। তাদের সমর্থন ভারতের দিকে থাকাই স্বাভাবিক। জানা যায়, লড়াইয়ের সময় ভারতের যেসব যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে তিনটি ফরাসি রাফায়েল জেট, যার প্রতিটির মূল্য ২৫ কোটি ডলার। এদিকে পাকিস্তান ব্যবহার করেছিল চীন ও তুরস্কের অস্ত্র ও যুদ্ধবিমান। অল্প সময়ের যুদ্ধে রাফায়েল জেটের ক্ষমতা পরীক্ষিত হওয়ায় ফ্রান্স অস্ত্রের বাজারে বিপাকে পড়ে। এদিকে চীন ও তুরস্কের অস্ত্র বিজ্ঞাপিত হয় যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এমন দশা দেখে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনে আমেরিকা। আমেরিকা চায় না চীন-তুরস্কের অস্ত্র এভাবে বিজ্ঞাপিত হোক।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
মোটের ওপর ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ যদিও এখন বিরতির অবস্থানে, তবুও এ কথা সত্যি যে, যুদ্ধে হেরে যায় প্রতিটি দেশের জনগণ। মিডিয়া দিয়ে তথ্যের বিভ্রাট সৃষ্টি করা হয়। তথ্য দিয়ে সরকারকে অক্ষত রাখার চেষ্টা করা হয়। অথচ নিজ নিজ দেশের স্বৈরাচারী শাসকের শাসন অব্যাহত থাকে। যুদ্ধে শুধু সমরাস্ত্রের ব্যবসা হয় না, বিভিন্ন দেশের সমরাস্ত্রের বাজার নিরূপণে যুদ্ধ একটা টেস্ট কেস। যুদ্ধে মিডিয়াকে কাজে লাগানো হয় গণমানুষের সম্মতি কেনার জন্য। সেই সম্মতি দিয়ে সামরিক শাসক অথবা স্বৈরাচারী শাসক ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেষ্টা চালায়। যুদ্ধ শাসকদের ক্ষমতায় থাকার বৈধতা দেয়। সেনাদের জীবন যায়, দেশের কোটি কোটি ডলার অপচয় হয়, জনগণের ভাগ্য যে তিমিরে, সেই তিমিরেই থেকে যায়। শেষ পর্যন্ত জিতে যায় মিডিয়া, হেরে যায় জনগণ। যুদ্ধ না হওয়াই সবচেয়ে বড় মঙ্গল।
ড. আশেক মাহমুদ : সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!