ঢাকার রাজপথে চলুক ট্রাম
ঢাকার বয়স নেহাত কম নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হওয়ার আগেও মাঝে মধ্যেই ভোগ করেছে প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা। দীর্ঘকালের পথপরিক্রমায় এই শহরের সাধারণ মানুষ বাহন হিসাবে ব্যবহার করেছে প্রধানত নৌকা, পালকি, গরুর গাড়ি আর ঘোড়ার গাড়ি। গত শতকের আশির দশকেও আড়তকেন্দ্রিক বাণিজ্যিক এলাকাগুলোয় ভিড় করে থেকেছে লম্বা শিংওয়ালা সফেদ হরিয়ানা গরুর টানা গাড়ি। সাপ্তাহিক বিচিত্রা পাঠের স্মৃতি হাতড়ে মনে পড়ে সম্ভবত ১৯৪০ সালে একজন বিধবা মহিলা ঢাকা শহরে প্রথমবারের মতো ৫টি রিকশা আনেন। ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ানদের এই রিকশার প্রতি ছিল তীব্র আপত্তি, কারণ ঘোড়া এই উদ্ভট বাহন দেখে ভয় পেয়ে দিগি¦দিক লাফিয়ে ওঠে, সওয়ারি নাজেহাল হয়। তবুও মানবিক কারণে ঢাকা পৌরসভা ওই মহিলাকে রিকশার লাইসেন্স দেয় এবং সিদ্ধান্ত হয় পৌরসভায় সর্বোচ্চ ৪০টি রিকশা চলতে পারবে। তার পর ক্রমান্বয়ে ঢাকা শহরের খালগুলো সড়ক হয়েছে, বুড়িগঙ্গার স্বচ্ছ জল নিকষ কালো হয়েছে আর ঢাকা শহর উপচে উঠেছে রিকশার পরবর্তী সংস্করণ ?বাংলার টেসলা?য়। রিকশা বন্ধের দাবি উঠলেই মানবিক আওয়াজ ওঠেÑ এই রিকশাচালকগুলো কী করবে? কোথায় যাবে? তা হলে তো ঢাকায় ফিরিয়ে আনতে হয় পালকি বেহারা, কোচোয়ান, গাড়িয়াল, বাতিওয়ালা, ভিস্তিওয়ালা, লাকড়িওয়ালা, ছাপাখানার কম্পোজিটর, পাঙ্খাপুলার, সার্ভিস মেথর, এমন নানা পেশাজীবী।
বড়সড় রাজধানী শহরের মধ্যে সম্ভবত এই ঢাকা শহরেই শুধু একই সড়কে নানা গতির বাহন চলে। এই শহরে মাথার ওপর দিয়ে মেট্রোরেল চলে। সড়কে ভলভো বাস যেমন চলে তেমনি রঙচটা প্রায় ভাঙাচোরা বাসও চলে। ঝা চকচকে অডি চলে আবার সেই একই সড়কে বাংলার টেসলা আর তিন চাকার রিকশাভ্যানও চলে। টেসলামুক্ত রাজপথ গড়ার প্রচণ্ড আন্দোলনের সময় বিকল্প এলো টেসলার, সেই তিন চাকারই, বুয়েট তার উদ্ভাবক। সরকার অনুমোদন দেবে নতুন নকশার ব্যাটারিচালিত রিকশার, চালকদের প্রশিক্ষণ দেবেন ৩০০ মাস্টার ট্রেইনার, নতুন বাহনের গতি বাড়বে, নিরাপত্তার দিকগুলো হবে মজবুত, কিন্তু দিনশেষে লাউয়ের বদলে কদু নামবে পথে।
পৃথিবীর প্রায় সব শহরেই ট্রাম চলে। যেসব শহরে মেট্রোরেলের বা সাবওয়ের ছড়াছড়ি সেখানেও দাপটের সঙ্গে চলে ট্রাম। ১৮৭৩ সালে কলকাতায় চালু হয়েছিল ট্রাম, তুরিন শহরের পরেই। কলকাতায় এখন মেট্রোরেলের নিবিড় নেটওয়ার্কের কারণে ট্রাম বন্ধ করলেও জনদাবিতে চালু হয়েছে আবার। ঢাকা শহরে অনেক সড়কই আছে ট্রাম চলার জন্য যথেষ্ট প্রশস্ত। ট্রামের লাইন বসানোর খরচও মেট্রোরেলের তুলনায় অনেক অনেক কম এবং স্থাপনে সময়ও লাগে কম। যে সড়কে ট্রাম চলে সে সড়কে দিব্যি চলে অন্য বাহনও। শুধু বিকল্প হয়ে যেতে পারে রিকশার তা সে প্যাডেলচালিত হোক বা ব্যাটারিচালিত। মহল্লার অলিগলিতে হয়তো চলবে না, তবে বাস চলাচল উপযোগী রাস্তায় ট্রাম চালু হলে রিকশার প্রচলন কমবে, হয়তো উঠেও যাবে। বাস, ট্রাম, মেট্রো ধরতে মহল্লার অলিগলিতে মানুষের হাঁটার অভ্যাস চালু হবে যা জনস্বাস্থ্যের জন্যও হবে সহায়ক। অন্তর্বর্তী সরকার নানা সংস্কারের জন্য মুখিয়ে আছে। মানুষও উন্মুখ হয়ে আছে পরিবর্তনের আকাক্সক্ষায়। মানুষ চায় নগর পরিবহণে আধুনিকতা আসুক। মেট্রোরেল মানুষের মনে আশার আলো জ্বালিয়েছে। ব্যয়বহুল ও দীর্ঘসূত্রতায় মানুষ দেখতে চায় নগর পরিবহনে দ্রুত ইতিবাচক সংস্কার! চলুক না ঢাকার রাস্তায় ট্রাম! প্রাথমিকভাবে না হয় মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমণ্ডির সন্নিহিত এলাকাই বেছে নেওয়া হোক। সে রুট সম্প্রসারিত হতে পারে সদরঘাট অবধি। শহরটা হয়ে উঠুক নাগরিকের সহজ ও স্বাস্থ্যকর বাসযোগ্য স্থান। স্মরণীয় হয়ে থাকুক অন্তর্বর্তী সরকারের একটি অনন্য কীর্তি।
আরও পড়ুন:
সব প্রতীক্ষার সমাধান হবে?
আকম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার