ক্রীড়াঙ্গনে কতটা প্রাণ ফেরাতে পারছে সংস্কার

জাহিদ রহমান
০৫ মে ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ক্রীড়াঙ্গনে কতটা প্রাণ ফেরাতে পারছে সংস্কার

ক্রীড়াঙ্গনে এক নতুন রূপান্তর প্রক্রিয়ার সূচনা হয়েছে ৫ আগস্টের পরপরই। সংস্কারের ধারাবাহিকতায় ক্রীড়াঙ্গন থেকে দলীয়করণসহ রাজনৈতিক সব স্বার্থপরতা উপড়ে ফেলার অভিপ্রায়ই এখানে মুখ্য। অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তাই দ্রুতই ভেঙে ফেলা হয় জেলা, বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা। সরিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন ফেডারেশনের সভাপতিকে। ক্রীড়াঙ্গনকে নতুন করে সাজাতে গঠন করা হয় সার্চ কমিটি। তরুণ ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার এসব সিদ্ধান্ত সমাদৃত হয় সর্বত্র। কেননা বিগত সরকারের আমলে অনেক ফেডারেশনেরই সার্বিক কর্মকাণ্ড, সফলতা নিয়ে নিরন্তর প্রশ্ন ছিল। বিভিন্ন ফেডারেশনে বছরের পর বছর ধরে এক শ্রেণির কর্মকর্তার পদ আঁকড়ে রাখার প্রবণতাও ছিল অনেক উঁচুতে। কিছু ফেডারেশনে অস্বচ্ছতা, অনিয়ম, দুর্নীতিও কম ছিল না। আবার ফুটবলসহ কিছু ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন অনেকটাই আজীবনের জন্য নির্বাচিত। শত অভিযোগ উঠলেও সভাপতি পদের মধু থেকে তারা কখনোই বঞ্চিত হতে চাননি। হাসিনা যুগে তাই এক ধরনের সুবিধাভোগীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল ক্রীড়াঙ্গনের মানুষ। বিপরীতে যোগ্য, দক্ষ, ডেডিকেটেড ক্রীড়া সংগঠকদের দীর্ঘশ্বাসও শোনা যেত চারদিকে।

৫ আগস্টের পর ক্রীড়াঙ্গনে পরিবর্তন তাই সবাই-ই চেয়েছিলেন। কিন্তু গত আট মাসে সেই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় এগোনোটা নিয়ে অনেকেই এখন শঙ্কিত। বিশেষ করে যারা ক্রীড়াসংশ্লিষ্ট, যারা ক্রীড়া নিবেদিতপ্রাণ তাদের মতে, ক্রীড়াঙ্গনের টেকসই অগ্রগতির জন্য দ্রুত যেভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর কথা ছিল, তা হচ্ছে না। উল্টো সর্বত্র এক শ্লথগতির চিত্র। যেসব ফেডারেশন নতুনভাবে তৈরি বা সাজানো হয়েছে সেগুলো নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। কেননা বিভিন্ন ফেডারেশনে অ্যাডহক কমিটিতে নতুন করে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ অন্যান্য পদে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে খুব একটা যাচাই-বাছাই করা হয়নি বলে অনেকের পর্যবেক্ষণে বেরিয়ে এসেছে। কেউ কেউ বলেছেন, নতুন করে গঠিত ফেডারেশনে কেবলই কিছু নতুন মুখ সংযোজন করা হয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞতা, দক্ষতাটাকে খুব একটা প্রায়োরিটি দেওয়া হয়নি। ফলে সেই পুরনো মডেলেরই ছায়া দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

জুলাই অভ্যুত্থানের শুরুতেই প্রথম পরিবর্তনটা আসে ফুটবল ও ক্রিকেটে। দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এই দুই ইভেন্টের মধ্যে ২১ আগস্ট বিসিবিপ্রধানের পদ ছাড়েন নাজমুল হাসান পাপন। তার জায়গায় অভিষিক্ত হন সাবেক ক্রিকেটার ফারুক আহমেদ। এর পরপরই আলোচিত ফুটবল ফেডারেশনের শীর্ষপদেও পরিবর্তনের আভাস আসে। ফেডারেশনের সভাপতির পদটি বহুদিন ধরেই আঁকড়ে ছিলেন ফুটবলের কিংবদন্তি কাজী সালাউদ্দিন। তার আমলে ফুটবল নিয়ে অনেক ধরনের স্বপ্ন দেখানো হলেও বাস্তবে ছিল অন্যটা। পুরুষদের ফুটবলে তেমন কোনো অগ্রগতিই ছিল না। বরং ফিফা র‌্যাংকিংয়ে বারবার অবনমন প্রমাণ করেছিল কতটা আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। অবশেষে ২৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বাফুফে নির্বাচনে কাজী সালাউদ্দিন প্রার্থী না হওয়ায় ফেডারেশনের নতুন সভাপতি হয়ে আসেন আলোচিত তাবিথ আউয়াল। তার নেতৃত্বেই এখন ফুটবলের কার্যক্রম চলছে।

আরও মনে করিয়ে দিচ্ছি, ক্রীড়াঙ্গনে নতুন গতি আনতে গত ২১ আগস্ট ভেঙে দেওয়া হয় সারাদেশের সব জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা এবং জেলা ও বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থা। ঢাকার ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোতেও পরিবর্তনের ডাক দেওয়া হয়। ১০ সেপ্টেম্বর যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে একসঙ্গে ৪২টি ফেডারেশনের সভাপতিকে অব্যাহতি দেয়। এর মধ্যে ২৬টি ফেডারেশন হলো : ব্যাডমিন্টন, শ্যুটিং, হ্যান্ডবল, জুডো, কারাতে, তায়কোয়ান্দো, টেবিল টেনিস, জিমন্যাস্টিকস, বাস্কেটবল, আর্চারি, বক্সিং, রাগবি, ফেন্সিং, ভারোত্তোলন, উশু, ক্যারম, সাইক্লিং, টেনিস, কুস্তি, ভলিবল, স্কোয়াশ অ্যান্ড র?্যাকেটস, রোইং, অ্যাথলেটিকস, খো খো, রোলার স্কেটিং ও বধির ফেডারেশন। সরানো হয় ফেডারেশনের নিচের স্তর ১৩টি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিকেও। এগুলো হলো : বেসবল-সফটবল, বাশআপ, সার্ফিং, মাউন্টেনিয়ারিং, চুকবল, সেপাট-টাকরো, জুজুৎসু, প্যারা আর্চারি, কান্ট্রি গেমস, থ্রো বল, আন্তর্জাতিক তায়কোয়ান্দো, ঘুড়ি ও খিউকুশিন। এর আগে বাংলাদেশ দাবা, কাবাডি ও ব্রিজ ফেডারেশনের সভাপতিকে অপসারণ করেছিল ক্রীড়া মন্ত্রণালয়।

ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারের জন্য গত বছর ২৯ আগস্ট সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। প্রথম অফিস আদেশে দুই মাসের মধ্যে সার্চ কমিটিকে ক্রীড়াঙ্গনের অপরিহার্য ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রতিবেদনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সার্চ কমিটির এক সদস্য পরিবর্তন করে পুনর্গঠনের সময় অফিস আদেশে অবশ্য সময়সীমা ছিল না। কিন্তু ২০ মার্চ ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সার্চ কমিটির আহ্বায়ককে ২০ এপ্রিলের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করার চিঠি প্রেরণ করে। সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে সার্চ কমিটি তাদের কর্মকাণ্ড ও সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরেছিল। কিন্তু এর আগে ১৯ এপ্রিল ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সার্চ কমিটির সময়সীমা বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় সার্চ কমিটিকে ১০ মের মধ্যে কাজ সমাপ্ত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সার্চ কমিটি গঠিত হওয়ার আগের ঘটনা সবারই জানা। জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ক্রীড়াঙ্গন অনেকটাই এলোমেলো হয়ে যায়। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিসিবিসহ বিভিন্ন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকসহ অনেক কর্মকর্তাই রাজনৈতিক কারণে আত্মগোপনে চলে যান। ফলে সব ফেডারেশনেই কমবেশি নেতৃত্বের সংকট তৈরি হয়। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও দলীয়করণের বড় এক অভিযোগ ছিল। বিভিন্ন ফেডারেশনে মন্ত্রী, এমপিদের অনুরোধে অনেক অযোগ্যকে জায়গা করে দেওয়া হয়েছিল। কেউ কেউ ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরেও সভাপতির পদে আঁকড়ে ছিলেন। আবার কেউ কেউ ফেডারেশনে জায়গা করে নিয়েছিলেন শুধু মিটিং ভাতা আর বিদেশ সফরের আশায়। আদতে দেশের খেলাধুলাকে এগিয়ে নিতে তাদের কোনো ধরনের ভূমিকাই ছিল না। তবে এটা সত্য, সব রাজনৈতিক সরকারের আমলেই দেখা গেছে ক্রীড়াঙ্গনে ‘এরে ওরে তারে’ এনে বসানোর সংস্কৃতি। সেই সংস্কৃতির আবার অতিব্যবহার ছিল শেখ হাসিনার যুগে।

ক্রীড়াঙ্গনে এখন পুরনো আমলের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নেই। দলীয়করণের আবর্তেও ক্রীড়াঙ্গন বন্দি নয়। স্বভাবতই সবাই চেয়েছিলেন সব ফেডারেশনেই যোগ্য ও দক্ষ সংগঠকরাই জায়গা পান। অযোগ্য, অনভিজ্ঞরা যেন জায়গা না পান। একই সঙ্গে যারা কন্ট্রিবিউট করতে পারবেন না, পৃষ্ঠপোষক আনতে পারবেন না তাদেরও যেন জায়গা না দেওয়া হয়। আর কোনো ফেডারেশন ব্যক্তিবিশেষের নির্দেশনা বা ইচ্ছায় চলবে না। সবখানে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। কাউন্সিলর ব্যবসা বন্ধ হবে। নতুন এক আশা নিয়ে এগিয়ে যাবে দেশের ক্রীড়াঙ্গন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই গরমিল পরিলক্ষিত হচ্ছে। সার্চ কমিটি এবং এনএসসির সিদ্ধান্তের সমন্বয়হীনতার কথাও উঠে এসেছে বিভিন্ন মিডিয়ায়। এসব নিয়েই আমরা কথা বলেছিলাম সাবেক তারকা ফুটবলার আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নুর সঙ্গে। তার মতে, ‘ক্রীড়াঙ্গনে মেধা ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন সংগঠকদের সমাহার ঘটানো প্রথম প্রায়োরিটি হওয়া উচিত। নইলে ভালো ফল প্রত্যাশা করা যাবে না। আগের মতো চললে হবে না। এখন নতুন করে নতুন কিছু করার অবারিত সুযোগ এসেছে। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।’ সাবেক তারকা হকি খেলোয়াড় রফিকুল ইসলাম কামালও একই রকম মনে করেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ হকি দল ইন্দোনেশিয়ায় আয়োজিত এএইচএফ কাপের সেমিফাইনালে ওমানের কাছে হেরে এশিয়ান কাপ খেলার চূড়ান্ত পর্বে উঠতে ব্যর্থ হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে তীব্র। কামাল মনে করেন, হয়তো ভাগ্য খারাপ হওয়ার কারণেই এমন হয়েছে। তবে হকিকে এগিয়ে নিতে হলে এখনই আরও নতুন করে ভাবতে হবে। চলমান ক্রীড়া সংস্কারের মধ্যে হকিকে বাঁচিয়ে ও এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন তীব্রভাবে রাখতে হবে।

ক্রীড়াঙ্গনকে নতুন স্পিরিটে উদ্দীপ্ত করতে তৃণমূল থেকে ক্রীড়াকেন্দ্র রাজধানীতে ফেডারেশনসহ বিভিন্ন সংস্থায় যে পরিবর্তন আনা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে শুধু নেতৃত্বের পরিবর্তন করলেই হবে না, সভাপতির চেয়ার বদল করলেই হবে না, সেই সঙ্গে ফল বয়ে আনার তীব্র মোটিভেশনও থাকতে হবে। আর ফল পেতে গেলে অবশ্যই প্রতিভার সন্ধান করতে হবে, নতুন খেলোয়াড় তৈরি করতে হবে, ভালো পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। এভাবে সমন্বিত চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারলেই কেবল ক্রীড়াঙ্গনে নতুন স্বপ্নের সূচনা হবে। ক্রীড়াঙ্গনকে নতুন করে তৈরির যে সুযোগ এসেছে, খেয়াল রাখতে হবে তা যেন কোনোভাবেই ব্যর্থ না হয়।


জাহিদ রহমান : ক্রীড়া লেখক ও গবেষক