করিডরে কেন ডর

মোস্তফা কামাল
০৫ মে ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
করিডরে কেন ডর

মত-দ্বিমতে নানা জের-ফের থাকলেও এখন পর্যন্ত বাস্তবতা হচ্ছে, দুই দেশের সরকারের অনুমতি ছাড়া বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে রাখাইনে ত্রাণ সহায়তা পাঠানোর সুযোগ সীমিত। চুক্তি না হলেও দুই দেশের সরকারের বোঝাপড়া ছাড়া এটি সম্ভব নয়। জাতিসংঘ চায় এ নিয়ে দুই সরকারের একটি ঐকমত্য। জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইসের বরাতে ঢাকা অফিসের ভাষ্য তারা রাখাইনে মানবিক পরিস্থিতিতে খুব উদ্বিগ্ন। বিবৃতি দিয়ে এও জানিয়েছে, জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখবে।

জাতিসংঘের এমন বিবৃতিতে একটু দেরিতে হলেও তাদের অভিপ্রায় পরিষ্কার। তাহলে গোলমাল বা সমস্যাটা কোথায়? প্রথমত, কিছুটা গোপনীয়তা। রমজানে জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস যখন হাইপ্রোফাইল সফরে এলেন, ঘটা করে কক্সবাজার গেলেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ রোহিঙ্গাদের নিয়ে ইফতার করলেন, তখন এ ধরনের টুঁ শব্দও হয়নি। বরং বেশি ফোকাস হয়েছে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাসের খবর। কিন্তু সামান্য সময়ের ব্যবধানে ফেরতের বদলে আরর বহুসংখ্যক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে। সেই সঙ্গে যোগ হয় রোহিঙ্গাদের সহায়তায় মিয়ানমারকে মানবিক করিডর দেওয়ার বিষয়।

কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের মাধ্যমে। তিনি জানান, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের রাখাইনের জন্য মানবিক করিডর দেওয়ার নীতিগত সম্মতি দেওয়া হয়েছে। তা যত না মন্তব্য তার চেয়ে বেশি তথ্য। খবরটি ছড়িয়ে পড়ার পর তা রাজনৈতিক অঙ্গনকে কাঁপিয়ে দেয়। ভয় জাগায় বিভিন্ন মহলে। একেক জনের একেক কথনে আলোচনা-সমালোচনার তেজ বেশ তুঙ্গে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বলা হয়েছে, সরকারের এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কিন্তু এতে সমালোচনা-ক্ষোভের পারদ নামেনি। যে যা পারছেন বলছেন। বলেই চলছেন। ততক্ষণে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমও তার বক্তব্য কিছুটা রিমেক করেছেন।

জাতিসংঘ উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশ মিয়ানমারের রাখাইনে মানবিক করিডরে রাজি হবে বলে শনিবার সর্বশেষ বক্তব্য তার। এও বলেছেন, করিডরের বিষয়টি চূড়ান্ত হলে সবার সঙ্গে কথা বলে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। করিডর নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্যকে ‘প্রিম্যাচিউর’ বলে মন্তব্যও করেন শফিকুল আলম। বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল শুরু থেকেই বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াস। তারা করিডরের পক্ষ-বিপক্ষ স্পষ্ট করছে না। বলছে তাদের না জানানোর বিষয়ে। কোনো দেশকে করিডর দেওয়ার সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকার নিতে পারে না, এর এখতিয়ার কেবল নির্বাচিত সরকারের বলে স্পষ্ট অবস্থান তাদের। এর মাঝে একটু ভিন্নমাত্রার বক্তব্য যোগ করেছেন সমরে অভিজ্ঞ বিএনপির সিনিয়র নেতা অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ। জনগণের সম্মতি ছাড়াই বাংলাদেশ যুদ্ধে জড়িয়ে যাচ্ছে কিনা, প্রশ্ন তোলেন তিনি।

রাখাইনে ত্রাণ পাঠানোর জন্য মানবিক করিডর দিতে বাংলাদেশের প্রতি জাতিসংঘের অনুরোধের তথ্যটি প্রকাশে আসলেই লুকোচুরি না হলেও বিলম্ব হয়েছে, তা এরই মধ্যে পরিষ্কার। সংস্থাটির প্রস্তাবে ভাসাভাসা সম্মতিও দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রস্তাবে কয়েকটি শর্তও ছিল। এর মধ্যে রয়েছেÑ রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরি, সবার জন্য সমানভাবে ত্রাণ বিতরণ, শর্তহীন ত্রাণ বিতরণ। এসব শর্ত না মানলে মানবিক করিডর দিতে নারাজের কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ। রাখাইনের নাগরিকরা যে খাদ্য ও ওষুধ সংকটে ভুগছে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের অজানা নয়। জাতিসংঘ এ ব্যাপারে বেশি ওয়াকিবহাল। এ কারণে রাখাইনে মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে বাংলাদেশকে বিশ্বমুরব্বি জাতিসংঘের করিডরের প্রস্তাব দেওয়াই স্বাভাবিক, যা দিয়ে বিপন্ন রাখাইনবাসীর জন্য বাংলাদেশ থেকে খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি, সার, বীজ, ওষুধসহ ত্রাণসামগ্রী পাঠাতে চায় জাতিসংঘ।

বিশ্বের সংঘাতময় অঞ্চলগুলোতে যেখানে মানুষ খাদ্য, ওষুধসহ জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী পায় না বা বেসামরিক নাগরিকসহ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়, সেখানে মানবিক করিডরের তাগিদ বোধ করে জাতিসংঘ। আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে আইনের আওতায় যাদের সরাসরি সহযোগিতা করা যায় না তাদের জন্যই এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে সংঘাতময় অঞ্চলগুলোতে মানবিক করিডরের প্রচলন শুরু। নাৎসি নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো থেকে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল ১৯৩৮-৩৯ সালে। নিরাপত্তা পরিষদের নেওয়া প্রস্তাবের ভিত্তিতে বসনিয়ার সারায়েভোতে ১৯৯২-৯৫ সালে এবং ২০১৮ সালে সিরিয়ার ঘৌতা থেকে বেসামরিক লোকজনকে সরিয়ে আনার জন্য মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। প্রথম আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধের (নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধ) সময় ১৯৮৯ সালে লাচিন করিডর স্থাপিত হলেও সেটি দ্্ুই বছরের মধ্যেই বন্ধ করে দেয় আজারবাইজান সরকার। ১৯৯৩ সালে নিরাপত্তা পরিষদের এক প্রস্তাবের মাধ্যমে সেব্রেনিৎসা ছিটমহলকে নিরাপদ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে ওই বছরেই আরেক প্রস্তাবের মাধ্যমে সারায়েভো, জেপা, গোরাজদে, তুজলা ও বিহাচকেও এর অন্তর্ভুক্ত করে মোট ছয়টি মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়। অনেক জায়গায় এ ধরনের মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ব্যর্থও হয়েছে। ইয়েমেনের চলমান যুদ্ধের মধ্যে বারবার এমন করিডরের আহ্বান জানিয়েও সফল হয়নি জাতিসংঘ।

বিশ্বের যেসব জায়গায় এমন মানবিক করিডর হয়েছে তার কোনো কোনোটি হয় বিবদমান পক্ষগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনার মাধ্যমে। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায়ও হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় মানবিক সহায়তা পাঠানোর যখন কোনো উপায় থাকে না, তখন একটি স্বীকৃত পথ বা প্যাসেজের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়। তবে করিডর মানেই যে জলভাগ বা স্থলভাগ হবে এমন নয় বরং এটি সময় নির্ধারণ করেও হতে পারে। জাতিসংঘের মানবিক করিডরের অর্থের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, জরুরি সরবরাহের জন্য একটি প্যাসেজ, যা দিয়ে ত্রাণসামগ্রী মুক্তভাবে সংঘাতময় এলাকায় যেতে পারে। আরাকানের সঙ্গে বাংলাদেশের করিডর এখনও ভবিতব্য। এ ছাড়া ‘করিডর-করিডর’ রব উঠলেও করিডর আসলে কত দূর বা তা কোন পথে হবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। স্থল ও নৌ উভয় পথেই করিডর হতে পারে। এ ছাড়া মিয়ানমারের ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। এই পথেও করিডর দিয়ে রাখাইন রাজ্যে ত্রাণসামগ্রী পাঠানো সম্ভব। করিডরে মিয়ানমার কি রাজি বা চেয়েছে? এ প্রশ্নেরও জবাব নেই। মিয়ানমার সরকার চাইলেও তা সম্ভব? এ প্রশ্নও রয়েছে। করিডরের জন্য মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মি উভয় পক্ষের সম্মতি প্রয়োজন। এক পক্ষ রাজি না থাকলে এই করিডর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। প্রশ্ন এবং বাস্তবতায় না গিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে উত্তাপের পারদ কিন্তু লাগামহীন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেই দিয়েছেন, রাখাইনে মানবিক করিডর দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল।

এ ধরনের সিদ্ধান্তে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে সংশয়ের কথাও বলেছেন তিনি। অন্য প্রায় সব দলের কথা এ রকমই। সেই সঙ্গে নানা ভয় ও শঙ্কার কথাও বলা হচ্ছে। তাদের সারকথা হচ্ছে, এই করিডরের মাধ্যমে আরাকান আর্মির মতো একটি রাষ্ট্রবিহীন, সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এটি শুধু একটি সাময়িক মানবিক করিডর নয়, বরং বাংলাদেশকে অনাকাক্সিক্ষত যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক শক্তির সংঘর্ষে জড়ানোর পথ খুলে দিচ্ছে।

এ রকম ভয়টাও স্বাভাবিক। দুনিয়ার বিভিন্ন অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, মানবিক করিডর দিনশেষে আর মানবিক থাকে না, হয়ে যায় অমানবিক। সামরিকও। সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিনের গাজায় ভয়াবহ নৃশংসতায় তীব্র মানবিক সংকটে পড়া গাজার মানুষদের জন্য সহায়তা পাঠাতে মানবিক করিডর বারবার আলোচনায় এসেছে। কিন্তু ফয়সালা হয়নি। বাংলাদেশের প্রেক্ষিত তত ভিন্ন নয়। করিডর বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ কার্যত আরাকান আর্মির পক্ষ নিলে যে গোষ্ঠীকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে এবং যার বিরুদ্ধে চীন, ভারত ও রাশিয়া মিয়ানমার জান্তা সরকারের পক্ষে অবস্থান নিতে পারে। অর্থাৎ এই করিডর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে গিয়ে বাংলাদেশকে চীন-ভারত-রাশিয়ার মতো পরাশক্তির বিরুদ্ধমুখী অবস্থানে ঠেলে দিতে পারে। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলে, ‘মানবিক করিডর’ অনেক সময়ই দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা ঝুঁকির উৎস হয়েছে। সিরিয়ায় মানবিক করিডরের ছায়ায় অস্ত্রপাচার ও মিলিশিয়া কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। বসনিয়ায় জাতিসংঘ ঘোষিত ‘সেফ জোন’-এ সংঘটিত হয়েছে গণহত্যা। কুর্দিস্তানে মানবিক সহায়তার আড়ালে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন জোরদার হয়েছে। মানবিক করিডরের নামে রাশিয়া তো ইউক্রেনই দখল করে নিয়েছে। এসব ঘটনা বিবেচনায় নিলে রাখাইনের সঙ্গে করিডর বাস্তবায়ন বাংলাদেশ নিজেদের ভূখণ্ডে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতকে আমন্ত্রণ জানানোর মতো হতে পারে বলে দুশ্চিন্তা ভর করা স্বাভাবিক।

২০০৯ সালে গঠিত এই সশস্ত্র গোষ্ঠী মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে এবং রাখাইন রাজ্যে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুদ্ধ করছে। তাদের বিরুদ্ধে মাদক, অস্ত্র ও মানবপাচারে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায়ও এদের সঙ্গে গোলাগুলি হয়েছে। এর বাইরে বাংলাদেশের ঘরের ভেতরেই আরেক যন্ত্রণা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। রাখাইনের সঙ্গে করিডর তাদের বাড়তি সুবিধা দেবে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল বানানোর দাবি বহুবার আন্তর্জাতিক ফোরামে উঠেছে। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক এবং বিভিন্ন এনজিও এ নিয়ে প্রতিবেদন ও সুপারিশ দিয়েছে। রোহিঙ্গা আপদ তো রয়েছেই। আরসা ও আরাকান আর্মি এখানে আরেক আপদ।


মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন