পুলিশ ক্ষমতাসীনের নয়, নাগরিকের সুরক্ষার প্রতি থাকুক দায়বদ্ধ

সফিক চৌধুরী
০৩ মে ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
পুলিশ ক্ষমতাসীনের নয়, নাগরিকের সুরক্ষার প্রতি থাকুক দায়বদ্ধ

আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী বাহিনী হিসেবে পুলিশের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বক্ষণ নজরদারি করা এবং কোথাও আইনের ব্যত্যয় ঘটলে তা নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ। যেহেতু সমাজের নানা অপরাধের বিপরীতে আইন তৈরি করে সরকার এবং সরকারের বাহিনী হিসেবে তা যথাযথভাবে প্রয়োগের অধিকার ও দায়িত্ব পুলিশের, ফলে সমাজে শান্তি বজায় রাখতে পুলিশ যখন সেই অধিকার প্রয়োগ করতে যায়, তখন ক্ষেত্র বিশেষে কখনও কখনও অত্যধিক বলপ্রয়োগ পুলিশের সেই কার্যকলাপকে নাগরিকের কাছে সরকারের নির্দেশে অত্যাচার বলেই প্রতীয়মান হয়। এ কথাও সত্য, বিগত সময়ে আমাদের রাজনৈতিক সরকারগুলো তাদের রাজনৈতিক সুবিধা চরিতার্থ করার জন্য পুলিশকে ব্যবহার করেছে অনেকটা ঢালাওভাবে।

অন্য যে কোনো সরকারি চাকরির মতোই পুলিশও রাষ্ট্রের বেতনভুক্ত কর্মচারী। কিন্তু তাদের কাজের ধরনটাই এমন যে, অধিকাংশ নাগরিকের পক্ষ থেকে সুনাম কুড়ানোর বদলে তাদের নামে জোটে বদনাম। অবশ্য এতে তাদের একটা অংশের দায়ও কম নয়। জুলাই অভ্যুত্থানের পর পুলিশ নিগ্রহের নানা ঘটনা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলমান। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি, বিভিন্ন থানা এমনকি পুলিশ লাইন্সে পর্যন্ত তারা আক্রান্ত হয়ে অনেকে দুঃখজনকভাবে মারাও গেছেন। যদিও কয়েক বছর আগেও ভয়ংকর ও দুর্ধর্ষ অপরাধীরাও পুলিশের গায়ে হাত তুলতে ভয় পেত, আর এখন সাধারণ মুষ্টিমেয় কিছু নাগরিক এমন অপরাধ সংঘটিত করেও কেমন যেন নির্লিপ্ত, অনুশোচনা বোধ নেই। পুলিশ নিগ্রহের এমন নানা ঘটনায় অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হওয়া দরকার। কিন্তু পুলিশের কর্তৃত্ব অগ্রাহ্য করার, পুলিশের নির্দেশকে তুচ্ছ করে পুলিশকেই উপযুক্ত ‘শিক্ষা’ দেওয়ার এই মানসিকতা কী করে সাধারণের মাঝে এভাবে ছড়িয়ে পড়ল, তার আলোচনাও প্রয়োজন। যদিও এর কার্যকারণগুলো খুঁজে বের করতে খুব বেশি অনুসন্ধানের প্রয়োজন বোধকরি নেই। বিগত সময়ে আমাদের সরকারগুলো তাদের দলীয় রাজনীতিকে নিষ্কণ্টক ও শাসনব্যবস্থাকে ন্যূনতম হুমকিমুক্ত রাখতে পুলিশকে ব্যবহার করেছে যাচ্ছেতাইভাবে, যা বাধ্যগতভাবে চোখের সামনে দেখেছে নাগরিকরা। রাজনৈতিক প্রশ্রয়প্রাপ্ত সমাজের নানা অপরাধচক্র নিয়মিত সচল থেকেছে। দুষ্কৃতকারীদের অবাধ আইন লঙ্ঘনের সামনে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা তার ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। সমাজে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাবানদের লাগামহীন দাপট পুলিশের প্রতি নাগরিকের আস্থা কমিয়েছে। পাশাপাশি বিরোধী মতের রাজনৈতিক কর্মী অথবা শাসক দলের নানা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত সাধারণ নাগরিকদের প্রতি পুলিশের নির্দয় আচরণ, নানা মিথ্যা মামলা আরোপও প্রায় ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠেছিল।

ফলে পুলিশের প্রতি নাগরিকের অনাস্থা, অশ্রদ্ধার মনোভাব ক্রমেই ছড়িয়েছে। সর্বোপরি জনমনে এই ধারণা তৈরি হয়েছে, পুলিশকে ‘প্রভাবিত’ করা কঠিন নয়Ñ রাজনৈতিক নেতা বা ক্ষমতাবানের সুদৃষ্টি থাকলে আইনের প্রয়োগকে সহজেই কঠোর বা শিথিল করা যায়। কখনও কখনও সমাজের প্রভাবশালীদের নানা অপকর্ম থেকে তাদের বাঁচাতে পুলিশের সক্রিয়তা, বিপরীতে নাগরিকের বিপন্নতায় নিষ্ক্রিয়তাÑ পুলিশের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ নতুন নয়। পুলিশ অপরাধীকে ধরবে না বা ধরলেও তদন্ত হবে না, এই ধারণা থেকেই অভিযুক্তকে ‘শিক্ষা দেওয়া’র বা সমাজে ‘মব’ সৃষ্টি হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয় নাগরিকদের একাংশের মাঝে।

জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী পুলিশি ব্যবস্থাকে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তকরণ, পুলিশ বাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামোর দুর্বলতা নির্ণয়, প্রশাসনিক স্তরে পুলিশকে কাজে লাগানোর প্রক্রিয়া সহজকরণ ও জবাবদিহিতামূলক এবং সত্যিকার জনবান্ধব পুলিশ গড়ে তোলার নিমিত্তে অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, যা আমাদের জন্য আশাব্যঞ্জক।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল জনবহুল রাষ্ট্রে এমনিতেই চাহিদা অনুযায়ী পুলিশের সংখ্যা অপ্রতুল, তার ওপর ভিআইপিদের পেছনে পুলিশের একটা বড় অংশকে নিয়োজিত রাখা হয়, ফলে পুলিশের স্বাভাবিক কার্যক্রম যেমনÑ অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত, সাক্ষ্য সংগ্রহের মতো প্রয়োজনীয় কাজগুলো দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে। তাই পুলিশের সততা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি, পুলিশি ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও সক্রিয় করার উপায় নিয়েও ভাবতে হবে। পুলিশের কাজের প্রতি শুধু অনাস্থা প্রকাশ করে শেষ বিচারে আইনের শাসনকে দুর্বল না করে যথাযথ সচেতনতা তৈরি এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারের দাবি তোলাও নাগরিক সমাজের কর্তব্য।

যে কোনো সুস্থ সমাজে পুলিশের সঙ্গে নাগরিকের একটা বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক থাকে, পারস্পরিক অধিকার বোধের সম্পর্ক বিরাজ করে। আবার যে কেউ অন্যায় করলে তাকে শাস্তি পেতেই হবে, সেই ভয় বা সমীহের সম্পর্কটাও থাকে। কিন্তু নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় আমাদের শাসনব্যবস্থায় পুলিশ ও নাগরিকের সম্পর্কের এই জায়গাটা ইদানীং একটু ধূসর। মাঝে মাঝেই আইনকে হাতে তুলে নেওয়ার একটা মারাত্মক প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে কোথাও কোথাও কারও কারও মাঝে। আইনশৃঙ্খলার প্রতি সাধারণ নাগরিকদের একাংশের দায়বদ্ধতার অভাবই এতে প্রকট বলে মনে হয়।

নাগরিকদের কারও কারও মাঝে কেন দায়বদ্ধতার অভাব, তা খুঁজে বের করা দরকার। আমার মনে হয়, এসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার পেছনে পুলিশকে বিশ্বাস করতে না পারা এবং অন্যায় করলে বা আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে যে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে, তার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া খুব কঠিন নয়, এমন ধারণা অনেককেই এমন সব অপরাধ করতে ইন্ধন জোগায়।

কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ পুলিশ সংস্কার কমিশন ‘কেমন পুলিশ চাই’ শিরোনামে একটি জনমত জরিপ পরিচালনা করে। জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ তদন্তে একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন সংগঠনের পক্ষে মত দিয়েছেন ৬০ শতাংশ মানুষ। হাইকোর্ট বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত স্থায়ী তদন্ত কমিশন গঠনের কথা বলেছে ২০ শতাংশ। এ ছাড়া জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধন করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে ক্ষমতা অর্পণের কথা বলেছেন ২০ শতাংশ মানুষ। ৪১ শতাংশ স্বাধীন ‘পুলিশ ন্যায়পাল’ প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় পুলিশি হেফাজতে বা রিমান্ডে আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের ধারাটি সংশোধন ও সংস্কার চান প্রায় ৯২ শতাংশ উত্তরদাতা। জরিপে বেশ কিছু ইতিবাচক ঘটনাও উঠে এসেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯’। এই সেবায় ৫৭ শতাংশ সন্তুষ্ট বলে জানানো হয়েছে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় জরুরি সেবা নিয়ে আরও বেশি প্রচার হওয়া দরকার। বর্তমানে শহরাঞ্চলেই এই সেবার উপকারভোগী বেশি। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এই কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন, যাতে প্রান্তিক মানুষরা উপকৃত হয়।

আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, কমিশন পুলিশের আইন ও কাঠামো সংস্কারের ক্ষেত্রে জরিপের বিষয়গুলো অগ্রাধিকার দেবে। বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশ বাহিনী গঠন করতে পারলে, তাদের মধ্যে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাত্রাও কমবে।

জনগণ সত্যিকার অর্থে একটি গণমুখী পুলিশ বাহিনী প্রত্যাশা করে, যারা সব ধরনের অন্যায় প্রভাবের বাইরে থেকে সততার সঙ্গে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করবে। পুলিশ প্রকৃতই জনগণের বন্ধু হবে। সমাজে পুলিশ সম্পর্কে বেশির ভাগ নাগরিকেরই ধারণা নেতিবাচক। যদিও এই ধারণা এখন থেকে নয়, বহুকাল থেকে। তবে ধারণাটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। আজও আমাদের পুলিশ বাহিনীতে বহু সদস্য আছেন, যারা ন্যায়পরায়ণ ও সৎ জীবনযাপন করেন। যারা মানুষের সঙ্গে, দুর্বলের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ একেবারেই সমর্থন করেন না।

সে যাই হোক, গত ২৯ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে গতকাল ২ মে, চার দিনব্যাপী ‘পুলিশ সপ্তাহ ২০২৫’ পালন হয়েছে। যা জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার আমলের প্রথম পুলিশ সপ্তাহ।

সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা চাই, পুলিশ ক্ষমতাসীনের নয়, নাগরিকের সুরক্ষার প্রতি থাকবে দায়বদ্ধÑ এই নীতি পালন করুক সর্বত্র। সব নিবেদিতপ্রাণ পুলিশ সদস্যের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা, শুভকামনা ও ভালোবাসা।


সফিক চৌধুরী : বিতার্কিক ও কলাম লেখক