অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ জরুরি

নিরাপদ সড়কের পথে বাধা

সেলিম রানা
২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ জরুরি

বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থায় রিকশা একসময় শহর থেকে গ্রাম সর্বত্রই স্বল্প দূরত্বের যাতায়াতের অন্যতম প্রধান বাহন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। মাটিছোঁয়া জনজীবনের সঙ্গে এই তিন চাকার বাহনের বন্ধন ছিল গভীর ও প্রাসঙ্গিক। সহজলভ্যতা, পরিবেশবান্ধব এবং কম খরচে চলাচলের সুবিধা সব মিলিয়ে রিকশা ছিল সাধারণ মানুষের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় যখন এই রিকশা রূপ নেয় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায়, তখন থেকেই শুরু হয় নানা জটিলতা। এই পরিবর্তনটি একদিকে যেমন মানুষের চলাচলে কিছুটা আরাম এনেছে, অন্যদিকে তেমনি সৃষ্টি করেছে বিপজ্জনক পরিস্থিতি, যা এখন সারাদেশের সড়কব্যবস্থাকে এক গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। প্রথমদিকে শহরাঞ্চলে সীমিত পরিসরে ব্যাটারিচালিত রিকশা দেখা গেলেও বর্তমানে এটি ছড়িয়ে পড়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে জাতীয় মহাসড়ক পর্যন্ত। একটি এমন একটি যান যা মূলত গ্রামীণ ও আঞ্চলিক সড়কের জন্য তৈরি, সেটিই আজ মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ট্রাক, বাস, অ্যাম্বুলেন্সসহ উচ্চগতিসম্পন্ন যানবাহনের পাশাপাশি। অথচ মহাসড়ক একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির যানবাহনের জন্য নির্ধারিত, যেখানে ধীরগতির, অনিয়ন্ত্রিত ও নিরাপত্তাহীন বাহনের চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। হাইকোর্টের জারিকৃত নির্দেশনায় মহাসড়কে এ ধরনের অটোরিকশার চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ কোথাও চোখে পড়ে না। এই বেআইনি ও বেপরোয়া চলাচল প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে তুলছে দুর্ঘটনা, প্রাণহানি এবং পথচারীদের ভোগান্তি।

এই বাহনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এর নিয়ন্ত্রণহীন উৎপাদন ও ব্যবহার। অটোরিকশাগুলোর অধিকাংশই স্থানীয় ও অদক্ষ কারিগরদের হাতে তৈরি, যেগুলোর কোনো প্রকার মান নিয়ন্ত্রণ নেই। নেই সরকারি নিবন্ধন, নেই মডেল যাচাই, এমনকি নেই কোনো নিরাপত্তা পরীক্ষাও। এটি মূলত একেকটি ‘চলন্ত ফাঁদ’, যা যেকোনো মুহূর্তে মৃত্যু ডেকে আনতে পারে চালক, যাত্রী বা অন্য গাড়িচালকদের জন্য। তার চেয়েও ভয়াবহ বাস্তবতা হলো এই যানগুলোর চালকরা অধিকাংশই অদক্ষ, প্রশিক্ষণহীন, প্রাপ্তবয়স্ক নয় কিংবা অন্য পেশা থেকে আসা এমন মানুষ, যারা ট্রাফিক আইনের জ্ঞানের বালাই রাখে না।

অন্যদিকে এসব যানবাহনের চার্জিং ব্যবস্থা নিয়ে রয়েছে মারাত্মক উদ্বেগ। অনিরাপদ চার্জিং পদ্ধতি এবং নিম্নমানের ব্যাটারির কারণে প্রায়ই আগুন লেগে যায়, যা জনজীবনের জন্য এক নতুন ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নৈরাজ্য যদি এখনই নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তাহলে ভবিষ্যতে সড়ক নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা ও সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব হতে পারে চরম ধ্বংসাত্মক। তাই এই তিন চাকার দানবকে রোধ করতে হলে এখনই প্রয়োজন যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ, কঠোর আইন প্রয়োগ, কারিগরি মানদণ্ড নির্ধারণ, লাইসেন্সপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষিত চালকের বাধ্যবাধকতা এবং সর্বোপরি জাতীয় পর্যায়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলা।

সড়ক নিরাপত্তা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন যৌথভাবে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে পারে। রাস্তায় সাইনবোর্ড, পোস্টার, লিফলেট বিতরণ এবং স্কুল-কলেজে সেমিনারের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিরোধে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। এমনকি সামাজিক মিডিয়া, টেলিভিশন, রেডিও বা সংবাদপত্রের মাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তা সম্পর্কে বিভিন্ন জনসচেতনতামূলত কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে।

সেলিম রানা, গণমাধ্যমকর্মী ও কলাম লেখক