স্মৃতির আলোয় সাংবাদিক শাহজাহান কমর : এক নিঃসঙ্গ সংগ্রামী জীবন
সমাজে কিছু মানুষ থাকেন, যারা নিজেদের অস্তিত্ব দিয়ে একেকটা সময়কে চিনিয়ে দেন। তাদের পথচলা, কর্ম ও দর্শন হয়ে ওঠে অনুপ্রেরণার বাতিঘর। সাংবাদিক শাহজাহান কমর ছিলেন তেমনই এক মানুষ, যিনি সাংবাদিকতার নিরেট জমিনে সততার বীজ বুনে গেছেন নীরবে-নিষ্ঠায়। তার জীবন ছিল সংবাদমাধ্যমের ভেতরের সৎ ও সাহসী কণ্ঠের প্রতীক।
দৈনিক আমাদের সময়ে প্রথমে একজন কর্মঠ সাংবাদিক হিসেবে যাত্রা শুরু করে পরবর্তী সময়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মফস্বল সম্পাদক। একজন নেতৃত্ব প্রদানকারী চিন্তক, যিনি শুধু সংবাদের খোঁজ করেননি, খুঁজেছেন মানুষের কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার পথ। দৈনিক আমাদের সময়ের মফস্বল সম্পাদক শাহজাহান কমর মাত্র ৫৭ বছর বয়সে ১০ এপ্রিল রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
শাহজাহান কমরের জন্ম সিলেটের বড়লেখার গ্রামতলা গ্রামের এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে। শৈশব থেকেই তার মধ্যে ছিল দৃঢ়তা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস আর গভীর পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা। ছোটবেলায় স্কুলের দেয়াল পত্রিকায় লেখা, বিতর্কে অংশ নেওয়া এবং ছোটখাটো প্রতিবাদে নেতৃত্ব দেওয়া ছিল তার কাছে নিয়মিত ঘটনা। তার মা-বাবা তাকে শৃঙ্খলা ও মানবিকতা শেখাতে কখনও পিছপা হননি। সাত ভাই ও তিন বোনের মধ্যে ষষ্ঠ ছিলেন শাহজাহান কমর। পরিবার চেয়েছিল তিনি লেখাপড়া শিখে ডাক্তার বা প্রকৌশলী হন- কিন্তু তিনি নিজেই নিজের জন্য বেছে নেন সত্য অনুসন্ধান করার পথÑ সাংবাদিকতা। সেই সময়টায় এ পেশাটি মফস্বল পর্যায়ে মারাত্মক ঝুঁঁকিপূর্ণ ছিল। তবু তিনি পিছিয়ে যাননি। সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জৈন্তাবার্তা পত্রিকার সিলেট প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরে সিলেটের ডাক পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন। শুরুতে তিনি কাজ করতেন মফস্বল থেকে প্রতিবেদন পাঠিয়ে। সমাজের নিভৃত পল্লী থেকে উঠে আসা মানুষের কথা, উপেক্ষিত জনপদের সমস্যা, স্থানীয় রাজনীতি, দুর্নীতিÑ সব কিছুই ছিল তার রিপোর্টের মূল বিষয়। তার কলম ছিল একেবারে নির্মোহ। সত্যকে যেমন তিনি বুঝতেন, তেমনই তুলে ধরতেন। এই মনোভাব তাকে ধীরে ধীরে আলাদা করে তোলে। এরপর তিনি জাতীয় দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা এবং সর্বশেষ দৈনিক আমাদের সময়ে মফস্বল সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
দীর্ঘদিনের কঠোর পরিশ্রম ও নিষ্ঠার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি আমাদের সময় পত্রিকার মফস্বল সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান। এটি ছিল তার জীবনের এক বড় স্বীকৃতি। কিন্তু এই দায়িত্বকে তিনি কখনও চাকরির মতো দেখেননিÑ বরং এটি ছিল তার কাছে একটি মিশন; মফস্বলের সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের কলমকে নির্ভয়ে লিখতে শেখানোর মিশন। তার সম্পাদনায় প্রতিটি রিপোর্ট ছিল তথ্যনির্ভর, বস্তুনিষ্ঠ এবং সমাজে প্রভাব বিস্তারকারী। তিনি বলতেন, ‘মফস্বলের সংবাদই জাতীয় বাস্তবতার আয়না। ৬৮ হাজার গ্রামের সোঁদামাটির গন্ধ মেশানো সংবাদ জাতীয় পত্রিকাগুলোর অক্সিজেন। রাজধানীর চোখে যা ছোটÑ সেটা দেশের প্রাণস্পন্দন।’ তিনি দেশের শতাধিক জেলা প্রতিনিধি ও স্থানীয় রিপোর্টারদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ রাখতেন। তাদের শুধু তথ্য নয়, নানা সমস্যায় পাশে দাঁড়াতেন, নৈতিক সাহস জোগাতেন।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
শাহজাহান কমরও একটি দর্শন ও আদর্শ নিয়ে সাংবাদিকতা করেছেন। তার সাংবাদিকতা দর্শনের মূলভিত্তি ছিল সততা, সাহস এবং সাধারণ মানুষের পক্ষাবলম্বন। তিনি কখনোই নিরপেক্ষতার নামে অন্যায়ের প্রতি নিরুত্তর ছিলেন না। বরং প্রতিবাদের ভাষাকে শক্তিশালী করে তুলতেন কলম দিয়ে। তার মতে, ‘সাংবাদিকতা মানে নিছক খবর পরিবেশন নয়, এটি সচেতনতা তৈরির একটি দায়িত্বÑ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আর ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার।’ তার লেখায় ছিল সাহস, তার বক্তব্যে ছিল তীক্ষè যুক্তি, আর ব্যক্তিত্বে ছিল সম্মান ও মাধুর্য। বর্তমানে নাম লিখিয়েই অনেকে নিজেকে খুব বড় সাংবাদিক মনে করেনÑ নিজেকে ওজন করতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে শাহজাহান কমর ছিলেন অতি সাধারণ। তিনি কখনও নিজেকে বড় সাংবাদিক ভাবেননি। বরং তরুণ সাংবাদিকদের নিঃস্বার্থভাবে সহযোগিতা করতেন। নতুন রিপোর্টারদের কাছে তিনি ছিলেন এক আদর্শ শিক্ষকÑ যার উপদেশ ছিল বাস্তবসম্মত এবং সহানুভূতিশীল। অনেক তরুণ এখন বড় বড় পত্রিকায় কাজ করছেনÑ যারা একসময় শাহজাহান কমরের হাত ধরে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি নিয়েছেন। তাদের কাছে তিনি এক আদর্শ। তার কাছের মানুষ মাত্রই জানেন, শাজাহান কমর কখনও রাগ করতেন নাÑ কলিগ বা অনুজদের ভুল এমনভাবে ধরিয়ে দিতেন, সেটাই যেন শেখার সবচেয়ে বড় সুযোগ হয়ে দাঁড়াত।
সাংবাদিক শাহজাহান কমর ব্যক্তিজীবনে ছিলেন অত্যন্ত সরল, বিনয়ী ও নিরহংকার। অসুস্থ বা আর্থিক সমস্যায় থাকা সহকর্মী বা এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়ানো ছিল তার এক অদ্ভুত অভ্যাস। অনেক সময় তিনি নিজের কষ্ট গোপন রেখে অন্যকে সাহায্য করতেন।
একজন গণমাধ্যমকর্মী শাহজাহান কমরের রেখে যাওয়া আদর্শ, সাংবাদিকতার দর্শন এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসা যুগ যুগ ধরে অনেক সাংবাদিকের কাজকে প্রভাবিত করবেÑ এটা চিরন্তন। তার জীবন আমাদের শেখায়, সাংবাদিকতা মানে ক্ষমতার লেজুড়বৃত্তি নয় বরং মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো। তার লেখাগুলো সংরক্ষণ করে রাখা প্রয়োজন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তার জীবনের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি হওয়া উচিত।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
আজ আমরা যখন ভুয়া সংবাদ, পেইড নিউজ কিংবা নিরপেক্ষতার মুখোশ পরা সাংবাদিকতার ভিড়ে হাঁপিয়ে উঠিÑ তখন শাহজাহান কমরের সাংবাদিকতা জীবন আমাদের কাছে এক দৃঢ় পথনির্দেশনা হয়ে দাঁড়াবে।
মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!