বিদেশি বিনিয়োগের সাম্প্রতিক উদ্যোগ প্রশংসনীয়

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
১৭ এপ্রিল ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বিদেশি বিনিয়োগের সাম্প্রতিক উদ্যোগ প্রশংসনীয়

দেশের আপামর জনগণ সম্যক অবগত আছেন, জুলাই-২৪ গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী সময়কালে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে রাষ্ট্র মেরামতের উদ্দেশ্যে যাবতীয় সংস্কারের বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ সর্বমহলে প্রশংসিত। ফলে পতিত সরকারের অনেক অজানা লুকায়িত তথ্য-উপাত্ত-পরিসংখ্যান জনসম্মুখে উন্মোচিত হয়েছে। যতটুকু ধারণা করা হয়েছিল তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি দুর্নীতি-লুটপাটের হালচিত্র উঠে এসেছে। সেতু-জ্বালানি-অবকাঠামো ও অন্যান্য খাতে মেগা প্রকল্প গ্রহণের পেছনে সুনিপুণ দুর্নীতির অপতৎপরতা জনগণ এখনও অবলোকন করছে। বিভিন্ন এক্সপ্রেসওয়ে-টানেল নির্মাণ-বন্দর উন্নয়ন ইত্যাদি লুণ্ঠনের দানবীয় উদ্দেশ্যে হয়েছিল বলেই বহু প্রতিবেদনে উল্লিখিত। ধারাবাহিকতায় বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্রমাগত অবনতি পরিলক্ষিত। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের নামে যা কিছু হয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা অন্তঃসারশূন্য বলে প্রতীয়মান।

গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়, দীর্ঘ সময় ধরে বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ছিল হতাশাব্যঞ্জক। বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জিডিপির বিপরীতে বাংলাদেশ অনেক দেশ থেকে পিছিয়ে ছিল। ২০২৩ সালে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ৩ বিলিয়ন ডলার। যদিও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী জিডিপির বিপরীতে বাংলাদেশে এই বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ দেড় শতাংশেরও কম। অথচ বিগত সময়ে চরম অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সংকটে দেউলিয়া হওয়া শ্রীলংকায় বিদেশি বিনিয়োগ জিডিপির ২০ শতাংশেরও বেশি। এ দেশে বিনিয়োগকারীদের উপার্জিত আয় নিজ নিজ দেশে ফেরত নেওয়ার ভোগান্তি, অস্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রার পরিস্থিতি এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে আগের বছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের নেট বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে নেট বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে ১ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে যা ছিল ১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ১৪২ মিলিয়ন ডলার।

উল্লেখ্য, প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসা পোশাক ও বস্ত্র খাতেও গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ১৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। ওই সময়ে খাতটিতে বৈদেশিক বিনিয়োগ এসেছিল ৪৪ কোটি ডলার। এর পর ব্যাংক খাতে ২৩ কোটি, রাসায়নিক ও ওষুধশিল্পে ১২ কোটি, গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামে ১২ কোটি, টেলিকমিউনিকেশনে ১০ কোটি, কৃষি ও মৎস্য আহরণে ৬ কোটি এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে ৫ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। এর মধ্যে রাসায়নিক ও ওষুধ এবং কৃষি ও মৎস্য আহরণ ছাড়া প্রায় সব খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আগের অর্থবছরের তুলনায় কমেছে। তা ছাড়া সামগ্রিকভাবে এফডিআই কমে যাওয়ায় কমেছে নতুন বিনিয়োগ (ইকুইটি) ও পুনর্বিনিয়োগও। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ১৪৬ কোটি ডলারের বিনিয়োগের মধ্যে ৪৫ শতাংশ বা ৬৭ কোটি ডলার হচ্ছে নতুন বিনিয়োগ। নতুন বিনিয়োগ আসার হারও গত দুই অর্থবছর ধরেই কমছে। পক্ষান্তরে ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৭৯ কোটি ডলারের পুনর্বিনিয়োগের বিপরীতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কমে পুনর্বিনিয়োগ হয়েছে ৬১ কোটি ডলার।

আমাদের সবার জানা, যে কোনো দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সংকট উত্তরণে বৈদেশিক বিনিয়োগের অবধান সমধিক তাৎপর্যপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ ১৯৮০-এর দশকে লাতিন আমেরিকান আর্থিক সংকট, ১৯৯৪-৯৫ সালের মেক্সিকান সংকট, ১৯৯৭-৯৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকট এবং কোভিড-১৯ মহামারী-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে বৈদেশিক বিনিয়োগের ভূমিকা ছিল আশাব্যঞ্জক। বিভিন্ন অভিজ্ঞতালব্ধ গবেষণামতে, বৈদেশিক বিনিয়োগ একটি দেশের মোট বিনিয়োগ ও দক্ষতা বৃদ্ধি-রপ্তানি উদারীকরণ এবং প্রযুক্তিগত ব্যাপকতার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করে থাকে। এটি দেশের পুঁজি অর্জন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং মানুষের সক্ষমতা-দক্ষতা বিকাশে প্রচণ্ড সহায়ক। ফলে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে বিশ্বের বহু দেশে একে অপরের মধ্যে প্রতিযোগিতা অতিশয় দৃশ্যমান। বিগত কয়েক বছরে বৈশ্বিক বিনিয়োগের পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার ফলে এর মাত্রা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, উচ্চখাদ্য-জ্বালানি মূল্য ও ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগের পরিমাণ ১২ শতাংশ কমে ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারে উপনীত হয়। ২০২৩ সালে তা ২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও মন্থর বিশ্ব অর্থনীতির কারণে। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে বেশির ভাগ দেশই নতুন করে তাদের জাতীয় নীতি প্রণয়ন করছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের আট মাসের অধিককাল অতিবাহিত হয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে দুর্দশাগ্রস্ত এই অবস্থানের দ্রুত পরিবর্তন মোটেও সম্ভবপর নয়। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সুযোগে শিল্পাঞ্চলগুলো, বিশেষ করে গার্মেন্টশিল্পে অরাজকতা আস্থার চরম সংকট তৈরি করেছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শুরু থেকেই পোশাক কারখানা অধ্যুষিত এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষের কারণে অসংখ্য কারখানার উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বহু কারখানায় ভাঙচুরসহ দেওয়া হয় আগুন। ফলে কঠিন হুমকির মুখোমুখি দেশের পোশাক খাত। পোশাক খাতসংশ্লিষ্টদের অভিমত, ইতোমধ্যেই শিল্পের কয়েক হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এরই মধ্যে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। শ্রমিক অসন্তোষের পাশাপাশি তীব্র জ্বালানি সংকটে নিপতিত অধিকাংশ কারখানা। কারখানা মালিকদের দাবি, বেশি দামে গ্যাসের মূল্য পরিশোধ করেও তারা চাহিদার মাত্র ৩০ শতাংশ গ্যাস পাচ্ছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেক বিনিয়োগ পাইপলাইনে থাকলেও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনেকেই বাংলাদেশে এই মুহূর্তে বিনিয়োগবিমুখ হতে পারেন বলে সতর্ক করেছেন অনেক বিশ্লেষক।

অর্থনীতিবিদদের ভাষ্য, দেশের বৈদেশিক বিনিয়োগ পরিস্থিতি বর্তমানে খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। এর স্বাভাবিকতা অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। বিশেষ করে দেশে যখন শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা চলমান। অনেক কারখানা ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। এর রেশ ছড়িয়ে পড়েছে ওষুধ, চামড়াসহ অন্যান্য খাতেও। বিরাজিত ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিশ্চিত পরিবেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহী হন না। বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং হ্রাসের প্রভাবও বিদেশি বিনিয়োগসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে পড়ছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নেতিবাচক খবরে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা প্রভাবিত হচ্ছেন। ইতিবাচক দিক হলো বর্তমান সরকারের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন। সরকারকে ওইসব দেশের বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করতে হলে অবশ্যই পরিবেশকে দ্রুত স্থিতিশীলতার দিকে নিতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে আগামী দিনে দেশে খুব একটা বিনিয়োগ নাও আসতে পারে। অদূর ভবিষ্যতে একেবারেই কমতে পারে ভারতের বিনিয়োগও। সেজন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। কারণ যখন কোনো দেশে বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পায় তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর নেতিবচাক চিত্রপট তৈরি হয়।

আশাজাগানিয়া বিষয় হচ্ছে, বিশ্বের অনেক দেশ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করার এবং বাংলাদেশে বিনিয়োগেরও আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সরকারও বৈদেশিক বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে বিনিয়োগকারীদের নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করছে। বিশেষত অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্র্ক এবং ওয়ান স্টপ ডিজিটাল সার্ভিস সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টারই ফসল। তা ছাড়া সরকার বিনিয়োগকারীদের জন্য বিভিন্ন রাজস্ব ও অ-আর্থিক প্রণোদনা প্রদান, করপোরেট আয়কর ছাড় বা কমানো, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের ওপর আমদানি কর হ্রাস, ভ্যাট হ্রাস, রপ্তানি ভর্তুকি প্রদান, বিভিন্ন ব্যাংকিং সুবিধা এবং বিশেষাধিকারের ব্যবস্থা করেছে। অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন বোর্ড (বিডা) কর্তৃক বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট’ আয়োজন বিনিয়োগকারীদের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে।

সম্মেলনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্ভাবনা, জুলাই বিপ্লবের পর সংঘটিত অর্থনৈতিক সংস্কার তুলে ধরা এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের পাইপলাইন তৈরি করা। সদ্যসমাপ্ত এই সম্মেলনে প্রাথমিকভাবে ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব এবং একাধিক বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগ প্রতিনিধিদলের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। ওই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিনিয়োগকারীরা আশাবাদের পাশাপাশি কিছু বাধার কথাও তুলে ধরেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ সরকারি সেবার মান, ইউটিলিটি সেবার অপ্রতুলতা, দুর্নীতি ও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সরকারি সংস্থাগুলোর বোঝাপড়ায় ঘাটতি। তা ছাড়া বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শনকালে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নীতি অপরিবর্তিত রাখা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করার সঙ্গে সঙ্গে শুল্ক-কর ও গ্যাস-বিদ্যুতের মতো পরিষেবা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। সামগ্রিক পর্যালোচনায় এটি সুস্পষ্ট যে, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের যথার্থ প্রক্রিয়ায় আস্থাভাজন করা এবং বিনিয়োগে উৎসাহিত করার সমূহ প্রচেষ্টা একান্ত জরুরি।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বিপুলসংখ্যক বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের বিকল্প নেই। সুযোগ-সুবিধার অধিকতর সম্প্রসারণ ঘটিয়ে বিদেশে অবস্থানরত দূতাবাসগুলোকে সক্রিয় করে বিনিয়োগের নতুন নতুন ক্ষেত্র অবশ্যই সংকট উত্তরণে সহায়ক হবে। প্রাসঙ্গিকতায় উল্লেখ্য যে, প্রচলিত ধারণা মতে দেশে নির্বাচিত সরকারের অধীনেই টেকসই উন্নয়ন বা বিদেশি বিনিয়োগ অধিকমাত্রায় লক্ষণীয়। কারণ হিসেবে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণে সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চাবিকাঠি। ব্যতিক্রম অধ্যায় তৈরি করে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ইতিবাচক প্রচেষ্টা বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে বহুলাংশে সার্থক। সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা ফলপ্রসূ করে এর যথাযথ দৃশ্যমানতাই সর্বাগ্রে প্রত্যাশিত।


ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী