নাগরিকতায় বাঙালিয়ানার রঙ

ডা. সাগর খান
১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৩৪
শেয়ার :
নাগরিকতায় বাঙালিয়ানার রঙ

আজকের পহেলা বৈশাখ মূলত শহরকেন্দ্রিক এক রঙিন উৎসবে পরিণত হয়েছে, যেখানে নাগরিক জীবনের ছন্দের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালিয়ানার নানা অনুষঙ্গ। রমনা বটমূলে ছায়ানটের রবীন্দ্রসংগীত ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’-দিয়ে শুরু হয় নববর্ষের আনুষ্ঠানিকতা।এ গান আজও বাঙালির অন্তরে নতুন শুরুর প্রতীক হিসেবে বেঁচে আছে।

রমনা বটমূল কেবল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানস্থল নয়, এটি হয়ে উঠেছে বাঙালির চেতনা ও সহনশীলতার এক প্রতীক। এখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ একত্র হয়। নারীরা পরে লাল-সাদা শাড়ি, পুরুষেরা পাঞ্জাবি-সব মিলিয়ে এক অনারম্ভিক আনন্দযাত্রা, যেখানে সামাজিক বিভাজন ছাপিয়ে জীবনের উৎসব উদযাপিত হয়।

মঙ্গল শোভাযাত্রা: প্রতিবাদের নান্দনিক রূপ

১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে শুরু হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রা আজ ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্য। এটি রঙিন মুখোশ বা বিশাল কাঠামোর প্রদর্শনী মাত্র নয়; বরং এটি অশুভ শক্তি, সাম্প্রদায়িকতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ। শস্য, মাছ, ময়ূর, সূর্য, পাখি-এই প্রতীকগুলো আমাদের কৃষিনির্ভর অতীত ও প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধকে স্মরণ করিয়ে দেয়। শহর ছাড়িয়ে আজ গ্রামেও এই আয়োজনের অনুকরণে ছোট পরিসরে শোভাযাত্রা হচ্ছে-যা বাঙালির সম্মিলিত আত্মঘোষণায় পরিণত হয়েছে।

নতুন ধারার মেলা ও সাংস্কৃতিক চর্চা

গ্রামের ধুলোমাখা হাট এখন রূপ নিয়েছে শহরের সুসজ্জিত বৈশাখী মেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, শাহবাগ, চট্টগ্রামের ডিসি হিল, খুলনার শহীদ হাদিস পার্কসহ সারাদেশে অনুষ্ঠিত হয় নাটক, লোকনৃত্য, পল্লীগীতি, কবিতা পাঠ ও কনসার্ট। এসব আয়োজন শহুরে জীবনের ভেতর বাংলার শিকড়কে পুনর্জাগরিত করে।

এ ছাড়া বৈশাখ উপলক্ষে তৈরি হয় বিশেষ নাটক, গান, নৃত্যনাট্য, ফ্যাশন শো ও টিভি লাইভ অনুষ্ঠান। সোশ্যাল মিডিয়ায় #PohelaBoishakh হ্যাশট্যাগে সাজ-পোশাক, খাবার ও মেলা ঘুরে বেড়ানোর ছবি ছড়িয়ে পড়ে-এ যেন লোকসংস্কৃতি ও আধুনিক প্রযুক্তির এক অভিনব সম্মিলন।

পান্তা-ইলিশ: খাদ্যসংস্কৃতির রূপান্তর

এক সময় দরিদ্র কৃষকের দৈনন্দিন খাবার ছিল পান্তা-ইলিশ; আজ তা পরিণত হয়েছে অভিজাত রেস্তোরাঁর বিশেষ বৈশাখী মেনুতে। ঢাকার পাঁচতারা হোটেল থেকে শুরু করে মোড়ের চায়ের দোকান-সবখানেই পান্তা-ইলিশের চাহিদা তুঙ্গে।

তবে অনেকেই আজও বাসায় তৈরি করেন পিঠা, চিতই, ভর্তা, শুঁটকি ভাজি, দই, মোয়া বা সেমাই। ইউটিউব বা ফেসবুকের হোম কুকিং ইনফ্লুয়েন্সারদের রেসিপি এই চর্চাকে আরও প্রসারিত করছে। একদিনের জন্য হলেও এই স্থানীয় খাবার সবার খাদ্যরুচিতে জায়গা করে নেয়।

ফ্যাশনের উৎসবে রূপান্তরিত বৈশাখ

পহেলা বৈশাখ এখন ‘ফ্যাশনের উৎসব’ বলেই বিবেচিত হয়। লাল-সাদা রঙ, ফোক মোটিফ, আলপনার নকশা—পাঞ্জাবি, শাড়ি, থ্রি-পিস বা টি-শার্টে ফুটে ওঠে বাঙালিয়ানার ছাপ। ফ্যাশন হাউসগুলো বাজারে আনে "বৈশাখী কালেকশন"। ছেলেরা পরে গামছা-পাঞ্জাবি, মেয়েরা পরে ফুলের মালা, হাতে আলপনা। এমনকি শিশুরাও ‘মিনি বৈশাখী লুক’-এ সেজে ওঠে। সব মিলিয়ে বৈশাখ হয়ে উঠেছে এক শিল্পিত রঙের প্রতিযোগিতা।

ডিজিটাল বৈশাখ: উদযাপনের নতুন রূপ

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে উঠেছে বৈশাখ উদযাপনের নতুন প্ল্যাটফর্ম। আগে পরিবার নিয়ে মাঠে বেড়ানো ছিল মূল আনন্দ, এখন তা জায়গা করে দিয়েছে সেলফি, রিল ভিডিও বা ফেসবুক লাইভে। টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার করে বিশেষ অনুষ্ঠান, অনলাইন পোর্টালগুলো সরাসরি সম্প্রচার করে রমনা, চারুকলা কিংবা বিভিন্ন শহরের আয়োজন।

তবে প্রশ্ন থেকেই যায়-এই ডিজিটাল অংশগ্রহণ কি সত্যিকারের সংস্কৃতি চর্চা, নাকি নিছক প্রদর্শন?

উপসংহার

নাগরিক জীবনের ছন্দে পহেলা বৈশাখ এখন শুধু একদিনের উৎসব নয়, এটি বাঙালিয়ানার বহুরূপী রঙের এক প্রতিচ্ছবি। যেখানে আছে অতীতের স্মৃতি, বর্তমানের আধুনিকতা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা-একসঙ্গে বাঁধা বাঙালির জাতিসত্ত্বার উজ্জ্বল রঙে।