শাহজাহান কমর একজন নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিকের প্রস্থান
অ ফিসের বার্তা বিভাগে তার টেবিলটা আছে। চেয়ারটাও আছে ঠিক আগের জায়গায়। টেবিলের বাম পাশে টেলিফোন সেট, সামনে কম্পিউটার মনিটর। সব কিছুই ঠিকমতো আছে যথাস্থানে। ডান পাশে সাদা মগটি সেই জায়গাতেই আছে; যার গায়ে ডোরেমন চরিত্রের উজ্জ্বল নীল রঙের কার্টুন সাঁটা। প্রতিটি জিনিস ঠিক নিজের জায়গায়, কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে একটি পরিবর্তন ঘটে গেছে। বড় বেদনাবিধুর, বড় কষ্টের সেই পরিবর্তন। আজকের এই চেনা দৃশ্যটি সম্পূর্ণ শূন্য, কারণ তার আসনটিতে আর বসে নেই শাহজাহান কমর, আমাদের সময়ের মফস্বল সম্পাদক। প্রিয় জ্যেষ্ঠ সহকর্মী, শ্রদ্ধেয় শাহজাহান কমর ভাই। তার আসনটি আজ বড় শূন্য। গত ১০ এপ্রিল বৃহস্পতিবার রাজধানীর মুগদা মেডিক্যালে ভোর ৪টা ৪৫ মিনিটে চিরদিনের মতো পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন। রেখে গেলেন অজস্র অম্লান স্মৃতি।
প্রতিদিন রুটিনমাফিক অফিসে এসে ওই চেয়ার-টেবিলে বসে হাসিমুখে তার পছন্দের সাদা মগটি হাতে নিয়ে কাজ শুরু করতেন কমর ভাই। এক সপ্তাহ আগেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। মগের ভেতরে গরম চা কিংবা কফি থাকত। সেই মগের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তার প্রিয় ডোরেমন চরিত্রটি। ডোরেমন ছিল তার মনের খেলা, তার শৈশবের স্মৃতি এবং তার হাস্যরসের সঙ্গী। প্রতিটি মুহূর্তেই হাসি ছিল তার সঙ্গী, আর সেই হাসির মাঝে পুরো অফিসের পরিবেশ এক নতুন মাত্রায় উঠে আসত।
যতবারই আমাদের মধ্যে আলোচনা হতো, কমর ভাই ছিলেন সেই মানুষ যিনি একটু থেমে গিয়ে সবাইকে একটা দৃষ্টিভঙ্গি বা চিন্তা উপহার দিতেন। কোনো কটু মন্তব্য বা বাজে কথা কখনও শোনা যায়নি তার মুখ থেকে। বরং প্রতিটি কথাতেই ছিল সহানুভূতি, ভালোবাসা এবং দায়িত্বশীলতার ছোঁয়া। কাজের মাঝে তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। সে সময়টাতে শুধু কাজই নয়, তার উপস্থিতিতে থাকত আরও কিছুÑ একটা সজীবতা, একটা সজাগ দৃষ্টি। কাজের মাধ্যমে তার পেশাদার আঙ্গিককে আরও সুন্দর করে তুলতেন।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
কাজের প্রতি তার একনিষ্ঠতা ও দায়িত্বশীলতা ছিল তুলনাহীন। তার মধ্যে এ বিষয়টা যেভাবে দেখা যেত তা ছিল দৃষ্টান্তমূলক। সারা দেশের প্রতিনিধিদের অভাব-অভিযোগ কতটা হাসিমুখে মেটানো যায় তা শাহজাহান কমরই দেখিয়েছেন। তাদের পাঠানো নিউজ কতটা সুন্দরভাবে পত্রিকার পাতায় উপস্থাপন করা যায় তা নিয়েই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। বার্তাকক্ষকে তিনি করে তুলেছিলেন সারা দেশের ইনফরমেশন সেন্টার হিসেবে।
সিলেট এমসি কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি ছড়াকার হিসেবে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। মেধাবী ছড়াকার হিসেবে আবির্ভূত হলেও তা চর্চায় রাখেননি। বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতাকে। সাংবাদিকতার হাতেখড়িও ছাত্রাবস্থায়। সে সময় সিলেটের জাসদ নেতা লোকমান সাহেবের অধুনালুপ্ত দৈনিক আজকের সিলেটের বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। দীর্ঘ সাংবাদিকতায় দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা, দৈনিক খোলা কাগজ ও সর্বশেষ আমাদের সময়ে কাজ করেছেন। ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন অসাধারণ নম্র, ভদ্র, বিনয়ী। সাংবাদিক হিসেবে ছিলেন সৎ, নির্ভীক ও আপসহীন। তার এই অকাল প্রয়াণে সাহিত্য ও সংবাদজগৎ একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মীকে হারাল। সততা, নৈতিকতা, নিষ্ঠা, পরিমিতিবোধ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাঝ দিয়ে সর্বোপরি নীতি ও আদর্শ এবং পরিশ্রম দিয়ে দীর্ঘ সময় তিনি ধরে রেখেছিলেন তার কর্মজীবন।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
একজন জ্যেষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে তিনি ছিলেন একান্ত আপনজন। একজন অভিভাবকও। ছোটখাটো অনেক বিষয় তিনি বুঝিয়ে দিতেন অকপট মানসিকতায়। প্রতিদিন অফিস শেষে একই পথে বাড়ি ফেরার সময় খিলগাঁওয়ে গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার সময় বলতেন, ‘এই আসি।’ সেদিনও এই আসি বলে চলে গেলেন, চিরকালের জন্যই...। কমর ভাই আপনি আমাদের মাঝে ছিলেন এক জীবন্ত প্রেরণা, এক অদম্য উৎসাহ আর উদ্যমের প্রতীক। আপনার প্রতিটি কথায় ছিল মানবিকতা, আপনার প্রতিটি কাজের মধ্যে ছিল নিষ্ঠা এবং আন্তরিকতা। আজ, যখন টেবিলের পাশে আপনার শূন্য চেয়ারের দিকে তাকাই, মনে হয় যেন কিছুই বদলায়নিÑ সব কিছু ঠিক আগের মতো আছে। মনে হয়, এই তো, আপনি হয়তো নির্বাহী সম্পাদক মহোদয়ের কামরায় গেছেন, কিংবা বার্তা সম্পাদকের সঙ্গে মিটিংয়ে আছেন, এক্ষুণি এসে পড়বেন। কিন্তু পরক্ষণেই ছ্যাঁৎ করে ওঠে বুকের ভেতর। আপনি চলে গেছেন সেই না-ফেরার দেশে। আর কোনো দিন আসবেন না। গুমরে ওঠে মন। আপনার অনুপস্থিতি পুরো পরিবেশকে একেবারে শূন্য করে দিয়েছে, কমর ভাই।
আপনার রেখে যাওয়া অগণন স্মৃতি কাজের মাধ্যমে বারবার ফিরে আসবে। মফস্বল অঞ্চলের সমস্যাগুলো আপনি যেভাবে চিহ্নিত করে তুলে ধরতেন, আমরা চেষ্টা করব তা অনুকরণ করতে। আপনার দীক্ষা আমাদের সাহস জোগাবে। ছিলেন সেই সহায়ক, আগামী দিনেও স্মরণে থাকবেন প্রতি মুহূর্তে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
জীবনের অনেক কিছু বাকি রয়ে যায়। বাকি রেখেই চলে যেতে হয়। ওপারের ডাক এলে নশ^র মানুষের সাধ্য কী তা ফেরায়! ছড়াকার হিসেবে আপনি হয়তো আত্মপরিচয় চাননি। তারপরও লুকানো ইচ্ছাটা প্রকাশ করেছিলেন। আর তাই এ বছর অমর একুশে বইমেলায় বই প্রকাশ করার কথাও ভেবেছিলেন। নানা ব্যস্ততা ও শারীরিক সমস্যার কারণে তা হয়ে ওঠেনি। পরে আগামী আগস্টে প্রকাশ করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। আগামী পহেলা মে সবার ছুটি। ওই দিন ডেস্কের সবাইকে নিয়ে কুয়াকাটা যাওয়ার একটা প্রস্তুতির কথা বলেছিলেন। সেখানে ওই অঞ্চলের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটা সম্মেলন করার কথাও ছিল। শেষ পর্যন্ত তা অসমাপ্ত রেখেই চলে যেতে হলো আপনাকে; কিন্তু আপনার এ ভাবনা আর পরিকল্পনা থেকে স্পষ্ট হয় আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল পেশাদারত্বের মোড়কে ঠাসা। এমন পেশাদার সাংবাদিকের আজ বড়ই প্রয়োজন ছিল। আপনার কাজের প্রতি একাগ্রতা আর নিষ্ঠা হয়ে থাক আমাদের পাথেয়।