একজন শাহজাহান কমর: আমার মেইনস্ট্রিম সাংবাদিকতায় অভিষেক

মো. রোমান আকন্দ,শরীয়তপুর প্রতিনিধি
১১ এপ্রিল ২০২৫, ১৯:১১
শেয়ার :
একজন শাহজাহান কমর: আমার মেইনস্ট্রিম সাংবাদিকতায় অভিষেক

সালটি ২০১২ সাল। আমি শরীয়তপুরে শ্রদ্ধেয় শহিদুল ইসলাম পাইলট ভাই সম্পাদিত দৈনিক রুদ্রবার্তায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ ছেড়ে দিয়ে ঢাকা থেকে দৈনিক স্বাধীন মত ও দৈনিক প্রভাত পত্রিকায় শরীয়তপুর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছিলাম। তবে হঠাৎ করে স্বাধীন মত পত্রিকা প্রায় বন্ধের মতো হয়ে যায় এবং দৈনিক প্রভাত পত্রিকাটিও অনিয়মিত। এক দিন আসে নাতো তিন দিন আসে না। এরই মধ্যে দৈনিক আমাদের সময় শরীয়তপুর প্রতিনিধি খুঁজছে। যদিও কিভাবে কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। এমতাবস্থায় একটা অনলাইন পোটার্লে কাজও করছিলাম। তখন আশার আলোর হয়ে ওই অনলাইনের স্টাফ রিপোর্টার রাজ কুমার নন্দীর মাধ্যমে আমাদের সময়ের স্টাফ রিপোর্টার আসাদ রহমান পরিচয় হয়। সেই সুবাদে আসাদ ভাইকে কয়েকদিন বিরক্ত করার পর সে আমাদের সময়ের তৎকালীন আরেক স্টাফ রিপোর্টার আলী আসিফ শাওনের (বর্তমান ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনের চিফ রিপোর্টার) কাছে নিয়ে যান। শাওন ভাই আমাদের সময়ের তৎকালীন বার্তা প্রধান মরহুম হুমায়ুন কবীর খোকন ভাই তৎক্ষণাৎ আমাদের সময়ের মফস্বল সম্পাদক সদ্য মরহুম শাহজাহান কমর ভাইর সাথে পরিচয় করিয়ে আমার সিভি চান। আমার ভুলে ভরা সিভি নিয়ে ৬ মাস নিউজ পাঠাতে বলেন এবং আমার সাথে ১৭ জন প্রতিযোগী আছে বলে জানান। এসময় শাওন বলে ওর টাইম ৬ মাস না ২ মাস, না পারলে বাদ। আমি কাজ করা শুরু করি। এই পর্যায়ে দিনকালের শরীয়তপুর প্রতিনিধি শ্রদ্ধেয় আল-আমিন শাওন ভাই দিনরাত নিজেই কঠোর পরিশ্রম আমার প্রতিনিধি হওয়ার সহযোগিতা করার কারণে আমার আমাদের সময়ে যোগদান সহজ হয়েছে। এই পর্যায়ে সকলের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। সেই থেকে কমর ভাই একদম পিতৃস্নেহে আমাকে একজন প্রকৃত সাংবাদিক হিসে গড়ে তুলতে থাকেন। কাজ করতে গিয়ে তিনি এক অনন্য উচ্চতার মানুষ। তিনি অতি সাধারণভাবে চলাচল করে। সন্তানের অনেক আদর ও শাসন পেয়েছি। কখনো সরাসরি, কখনো মোবাইলে নানান দিক নির্দেশনা দিয়ে এক প্রকৃত সাংবাদিক হিসেবে গড়ে তুলেছেন। ২০১৪ সালের ২৬ ফ্রেব্রুয়ারি আমার নিয়োগ চূড়ান্ত হয়। এরপর আমাকে নিয়োগ পত্র ও পরিচয় পত্র দেয়। আমিও তাঁর দেখানো পথে সততা ও নিষ্ঠার সাথে সাংবাদিকতা করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এক যুবকের জীবন কিভাবে পাল্টে দিতে পারে তাঁর প্রমাণ করেছেন আপনি। কমর ভাইয়ের আদর-শাসন সারাজীবন মিস করবো। সাংবাদিকতায় যা কিছু শিক্ষা তার বেশির ভাগই আপনার কাছ থেকে শেখা।, আপনি ইহলোকের মায়ের ত্যাগ করলেও আপনি মিশে থাকবেন আমার অস্তিত্বের সাথে।

কমর ভাই দৈনিক আমাদের সময়কে হৃদয় দিয়ে ভালবাসতেন। তেমনি পুরো আমাদের পরিবারও তাকে ভালবাসতেন। তাঁর মৃত্যুতে পুরো আমাদের শোকের ছায়া নেমে আসে। ঢাকা অফিস ছাড়াও সারাদেশের প্রতিনিধিদের কাছে তিনি ছিলেন মধ্যমনি।

ঈদের দিন কথা বললাম, ভাইয়া বললবো গ্রামের বাড়িতে যায় নি। শরীর বেশি ভাল না, রেষ্ট নিতে বললাম। টুকটাক কুশলাদী বিনিময় করে অল্প কথায় দোয়া চেয়ে কেটে দিলাম।

ঈদের পর অফিস খোলার একদিন পরেই আমাদের সময়ের সিনিয়র সাব এডিটর মোহাম্মদ আখতার উজ্জামান ভাইয়ের এক পোস্টে জানতে পারলাম। ভাই অসুস্থ। ভাইকে মোবাইলে ফোন করলে রিসিভ করেনি তিনি। কিছুক্ষণ পর নিজেই কল করে বলল আমি একটু অসুস্থ৷ আমি বললাম ডাক্তারের পরামর্শ নেন আর রেষ্ট নেন। তখন বলল, আগামী ১৭ এপ্রিল তারিখ। তাই আর ফোন করে বিরক্ত করতে চাইনি ভাইকে।

এদিকে, ৯ এপ্রিল বুধবার দিবাগত রাতে কেন জানি ছটফট করছি, কোনো ঘুম হয়নি। ভোররাতে মানে বৃহস্পতিবার ভোর ৫ টার দিকে আখতার উজ্জামান ভাইয়ের এক পোস্টে জানতে পারলাম, আমার পিতৃ সমতুল্য কমর ভাই আর নেই। চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। একের একের অফিসের লোকজনকে ফোন করতে থাকলাম। পরে সিনিয়র সাব এডিটর আবুল হাসান হৃদয় জানালো সরাসরি গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের বড়লেখায় নিয়ে যাবে ভাইকে। আমিও যেতে চাইলাম। ময়মনসিংহের নজরুল ভাই বলল সেও যাবে। আমি শরীয়তপুর থেকে প্রথমে ঢাকার যাত্রাবাড়ি। এরপর পর্যায়ক্রমে শ্রীমঙ্গল। সেখানে মৌলভীবাজার প্রতিনিধি চৌধুরী ভাস্কর হোমের সহযোগিতায় ৬ টায় বরলেখা পৌছলাম। এতক্ষণে প্রথম জানাজা হয়ে গেছে। হাউ মাউ করে কাঁদছিলাম। জামান ভাইসহ সবাই আমাকে থাকে থামানোর চেষ্টা করছিল। পরে আমার কমর ভাই মুখটা দেখলাম। মনে হয় একদম চাঁদের মতো হাঁসি মুখে ঘুমাচ্ছে। এর ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে ভাবি সহ সবার সাথে দেখা করে লাঞ্চ করলাম। পরে সন্ধ্যার পর বিয়ানীবাজারের আরেকটি বাড়িতে ভাইয়ের জানাজা ও দাফন সম্পন্ন করতে গেলাম। রাত ১০ টায় সেখান থেকে সবশেষ করে বড়লেখা পৌছে ডিনার করে আবার গাড়িতে কুলাউড়া রেল স্টেশনে আসলাম। সিলেট ব্যুরো প্রধান সজল ছত্রী দাদা আগেই হৃদয় ভাই, জামান ভাই ও আমাদের জন্য ঢাকার টিকেট করে রেখেছিল। স্টেশনে কুলাউড়া প্রতিনিধি খালেদ বক্স ভাই যথেষ্ট আতিথিয়েতা, যা কখনোই ভুলবো না। সকালে কমলাপুর নেমে সেখান যাত্রাবাড়ি গিয়ে শরীয়তপুরের বাসে উঠে পড়লাম। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে শরীয়তপুর নাম। বাসায় চলে গেলাম। এদিকে, নজরুল ভাই সহ অনান্য জেলা উপজেলা প্রতিনিধি ও স্থানীয় সাংবাদিকরা যে যার যার মতো করে বিদায় চলে গেলো নিজ গন্তব্যে। আর একটা কথা বলাই হয়নি দুইটি জানাজায় ছিলো জনতার ঢল। জানাজার আগে পরে সবাই কমর ভাইর কথা বলে অঝোরে অশ্রুসিক্ত হয়েছে। এতেই প্রমাণ করে আপনি হাঁজার বছন বেঁচে থাকবেন আপনার কর্মের মাধ্যমে।

ভাই, কি এমন অভিমান ছিল? মাত্র ৫৭ বছর বয়সে আমাদের এতিম করে চলে যেতে হলো।

আপনি সন্তানতুল্য আদর করতেন বলে অনেক দুষ্টামি করেছি, আমাকে শেষবারের মতো মাফ চাইবার সুযোগ দিলেন না। আমার ক্যারিয়ার আল্লাহর রহমত, আপনার সঠিক দিকনির্দেশনায় হয়েছে। শুণ্য থেকে শিখরে পৌছাতে না পারলেও আমার একটা শিরধার্য। যে কাজই করি না কেন, আগে ভাল মানুষ হতে হবে। শুধু আমি নয়, আমার হাজারো সাংবাদিক তৈরি করেছেন। তারা খেয়ে পড়ে ভাল আছে, দেশের জন্য কাজ করছে। আপনার জীবন সার্থক কমর ভাই। অনেক শ্রদ্ধা ও ভালবাসা আপনার জন্য।

আজকের এই রোমান হওয়ার সিংহভাগ অবদানই আপনার। এটা শোধ করার কোনো উপায় নাই। দোয়া করি আল্লাহ আপনার জীবনের সব দোষত্রুটি ক্ষমা করে জান্নাতের উচ্চস্থানে কবুল করুক, আমিন।