হারিয়ে যাচ্ছে কৃষিজমি : ফসল হবে কোথায়?

চপল বাশার
০৮ এপ্রিল ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
হারিয়ে যাচ্ছে কৃষিজমি : ফসল হবে কোথায়?

আবহমানকাল ধরে বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে পরিচিত। এ দেশের অর্থনীতি এক সময় ছিল পুরোপুরি কৃষিনির্ভর। শিল্প বলতে তেমন কিছু ছিল না। বাণিজ্য যা ছিল তাও কৃষিপণ্যভিত্তিক। এখনকার তুলনায় অতীতে দেশের জনসংখ্যা ছিল অনেক কম। জনগণের খাদ্যচাহিদা মেটাতে দেশের মাটিতে উৎপাদিত ফসলই ছিল যথেষ্ট। সময়ের পরিক্রমায় জাতীয় অর্থনীতির দৃশ্যপট পাল্টেছে। অর্থনীতি এখন কেবল কৃষির ওপর নির্ভরশীল নয়। শিল্প এবং বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যও অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। দেশের বিপুল জনশক্তির একটি বড় অংশ বিদেশে কর্মরত। তাদের পাঠানো অর্থ জাতীয় অর্থনীতিকে চলমান রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

এতকিছুর পরও বলতে হবে বাংলাদেশ এখনও কৃষিনির্ভর একটি দেশ। জাতীয় আয়ের বিশাল অংশ এবং প্রবৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য অর্জন নির্ভর করে কৃষি খাতের উৎপাদনের ওপর। কৃষিতে ভালো উৎপাদন হলে জাতীয় আয় ও জিডিপিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। যে কোনো কারণে হোক কৃষিতে উৎপাদন খারাপ হলে বা আশানুরূপ না হলে নীতিবাচক প্রভাব হবেই। জাতীয় আয় কমে যাবে এবং জিডিপিও লক্ষ্যমাত্রার নিচে থেকে যাবে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী জিডিপিতে কৃষির অবদান ১১ শতাংশ। দেশের শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশ কৃষিকাজে নিয়োজিত।

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও মূলত কৃষিনির্ভর, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু যে হারে দেশের কৃষিজমি বা চাষযোগ্য জমি কমে যাচ্ছে, তা অবশ্যই উদ্বেগের কারণ। চাষযোগ্য কৃষিজমি যেভাবে অকৃষি খাতে যাচ্ছে তাতে এক সময় দেশে চাষের জমি বলে কিছু থাকবে না। চাষের জমি না থাকলে ফসল উৎপাদন হবে কোথায়? তখন কি বাংলাদেশকে কৃষিনির্ভর দেশ বলা যাবে?

কমছে কৃষিজমি : একদিকে দেশে জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে, পাশাপশি কমছে কৃষিজমি। ফসল ফলানোর মতো জমি না থাকলে কৃষিকাজ হবে কোথায়? বাড়ির ছাদে, যাকে আজকাল ছাদবাগান বলা হয়? ছাদবাগানে ফুল ফোটানো যাবে, কিছু ফলও উৎপাদন করা যেতে পারে। কিন্তু চাল-ডালের মতো খাদ্যশস্য হবে না বাড়ির ছাদে। মানুষ তখন কী খেয়ে বাঁচবে? কৃষিজমির অভাবে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা বিরাট ঝুঁকি ও হুমকির মুখে পড়বে, যা মোকাবিলা করা সরকারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

বাংলাদেশের আয়তন ৫৬ হাজার বর্গমাইলের কিছু বেশি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পায়, তখন দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটির মতো। বর্তমানে এই জনসংখ্যা ১৮ কোটির কাছাকাছি পৌঁছেছে বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ, কিন্তু দেশের জমির পরিমাণ বাড়েনি। খাদ্য সরবরাহ সেই সময়ের তুলনায় বেড়েছে, কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তদুপরি কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে ক্রমেই, ফলে খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়ছে। খাদ্যশস্য উৎপাদনে, বিশেষ করে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ কিছুকাল স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। কিন্তু সেই অবস্থা বেশিদিন টেকেনি। আবার চাল আমদানি করতে হয়েছে চাহিদা পূরণের জন্য। খাদ্যশস্যে ঘাটতির অন্যতম কারণ কৃষিজমি কমে যাওয়া বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমলে ফসল উৎপাদন কমবে, এটাই স্বাভাবিক।

কৃষিজমিতে স্থাপনা : বাংলাদেশে কৃষিজমির পরিমাণ কমছে বহু বছর থেকে। প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি রূপান্তরিত হচ্ছে এবং তা ব্যবহৃত হচ্ছে কৃষিবহির্ভূত অন্যান্য কাজে। কৃষিজমিতে ঘর-বাড়ি, শিল্প প্রতিষ্ঠান, ইটভাটা, সড়কসহ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। ফলে সেখানে চাষাবাদ বন্ধ, কৃষিজমি চলে যাচ্ছে অকৃষি খাতে। কৃষিজমিকে অকৃষি খাতে নেওয়ার প্রক্রিয়া ক্রমেই বাড়ছে বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। দেশে চাষযোগ্য জমি তথা কৃষিজমির পরিমাণ এখন কত? বছরে কত কৃষিজমি অকৃষি খাতে চলে যায়? এসবের সঠিক হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। বিভিন্ন সূত্র থেকে বিভিন্নরকম তথ্য দেওয়া হয়।

একজন কৃষি বিশেষজ্ঞের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ এক কোটি ১১ লাখ হেক্টর। কিন্তু এই জমির পুরোটাতে চাষ হয় না বিভিন্ন কারণে। ২০১১ সালে ৭৮ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছিল বলে তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু সেটাও ১৯৮৫ সালের তুলনায় কম। ১৯৮৫ সালে ৮৮ লাখ, ৫০ হাজার হেক্টরে চাষাবাদ হয়েছিল। অর্থাৎ ২৬ বছরে কৃষিজমি কমেছিল ৯ লাখ হেক্টরের বেশি। কমে যাওয়ার এই হার ছিল বছরে প্রায় ০.৩০ শতাংশ। কৃষিজমি হ্রাসের এই হার এখন আরও বেড়েছে বলে এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন। কৃষিজমির পরিমাণ হ্রাসের কারণ ব্যাপক নগরায়ণ ও কৃষিজমিতে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ। সাম্প্রতিককালে ২০২৪ সালে কৃষিজমি কত কমেছে সেই তথ্য বিশেষজ্ঞের গবেষণায় নেই।

গত জানুয়ারিতে ঢাকায় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে বলা হয়, দেশে প্রতিবছর প্রায় তিন হাজার হেক্টর চাষযোগ্য জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। সেমিনারে অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘দেশে জনসংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমছে। ভবিষ্যতে এটি খাদ্যনিরাপত্তার জন্য গুরুতর উদ্বেগের কারণ হবে। অনেকে চাষযোগ্য জমিতে ঘর-বাড়ি, ইটভাটাসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ করছেন। এটি দেশের ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা পূরণের সক্ষমতার ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।’

চাষযোগ্য জমি প্রতিবছর কী হারে কমছে, সে সম্পর্কে সরকারি তথ্য পাওয়া না গেলেও দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাওয়া তথ্যে এ বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়।

কৃষিজমি হ্রাস : খুলনায় : খুলনা বিভাগে কৃষিজমি হ্রাস সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন গণমাধ্যমে এসেছে। এতে বলা হয়, ‘অপরিকল্পিত আবাসন, যত্রতত্র বাজারসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণে খুলনা অঞ্চলে আশঙ্কাজনক হারে কমছে কৃষিজমি। মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, প্রতিবছরই কৃষিজমি এক শতাংশের বেশি কমছে। কোনো কোনো উপজেলায় এক দশকে ৫০ শতাংশ আবাদি জমি অনাবাদি হয়েছে। ‘সরকারি নির্দেশনায় কৃষিজমিতে আবাসন প্রকল্প না থাকার নির্দেশ থাকলেও এক দশক ধরে খুলনাঞ্চলে বাজার কিংবা আবাসন নির্মাণ হচ্ছে কোনো নিয়ম না মেনেই। গত এক দশকে খুলনা জেলায় ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে কৃষি আবাদ কমেছে। এ ছাড়া বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর, নড়াইল, ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরেও বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি অকৃষি খাতে চলে গেছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আশিকুর রহমান বলেন, উপজেলা পর্যায়ে যেভাবে আবাসন গড়ে উঠছে তা আশঙ্কাজনক। এভাবে চলতে থাকলে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হবেই। এ কারণে সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরকে সমন্বিত পরিকল্পনায় কাজ করতে হবে। কৃষিজমি রক্ষায় উপজেলা পর্যায়ে স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলা যেতে পারে। উপজেলা পর্যায়ে প্লট তৈরির প্রকল্প নেওয়া যাবে না।’

দিনাজপুর : দিনাজপুরের পরিস্থিতি সম্পর্কে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘উত্তরের জেলা দিনাজপুরকে বলা হয় শস্যভাণ্ডার। জেলার অধিকাংশ জমি দুই এবং তিন ফসলি। রয়েছে চার ফসলি জমিও। অর্থাৎ কৃষি অর্থনীতির বড় অংশজুড়েই প্রভাব রয়েছে। তবে কয়েক বছর ধরেই কৃষিজমি গিলে খাচ্ছে আবাসন প্রকল্প। ইটভাটা ও কলকারখানার পর আবাসন গড়ে উঠছে যত্রতত্র। এতে করে কমছে জমি ও ফসল উৎপাদন। এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে কৃষকদের ওপর।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দিনাজপুর জেলায় গত ছয় বছরে আবাদি জমি কমেছে তিন হাজার ২৩২ হেক্টর। এভাবে জমি কমলে হুমকিতে পড়বে ফসল উৎপাদন। দিনাজপুরের রাজারামপুর এলাকায় পাশাপাশি তিনটি আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে। কৃষিজমিগুলো প্লট আকারে বিক্রি করে গড়ে তোলা হচ্ছে আবাসন। অথচ দুই বছর আগেও এসব জমিতে ধান, টমেটো ও কলার চাষ হতো। জেলার ১৩টি উপজেলায় একই চিত্র। কৃষিজমিতে মাটি ভরাট করে উঁচু আবাসন প্লট গড়ে তোলায় পানি নিষ্কাশনের রাস্তাও বন্ধ হচ্ছে।

খাগড়াছড়ি : গণমাধ্যমে প্রকাশিত খাগড়াছড়ির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘খাগড়াছড়ি জেলায় বছরদশেক আগেও ঘর-বাড়ির সংখ্যা ছিল প্রায় দুই লাখ। এরই মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় চার লাখে। নতুন বাড়ি-ঘর ও স্থাপনার কারণে ক্রমেই কমে যাচ্ছে কৃষিজমির পরিমাণ। ফলে এক সময় খাদ্য উৎপাদনে এগিয়ে থাকা জেলাটিকে বর্তমানে খাদ্যচাহিদা পূরণের জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে অন্য জেলার ওপর। বাড়ি-ঘর, স্থাপনা নির্মাণের কারণে জেলায় কৃষিজমি কমে দাঁড়িয়েছে এক লাখ একরের কম।

আইনের প্রয়োগ নেই : সারাদেশেই একই চিত্র। কৃষিজমি কমে যাচ্ছে, কমে যাচ্ছে ফসল উৎপাদন। এই অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। কৃষিজমিকে অকৃষি খাতে নেওয়া ঠেকাতে হবে দেশের খাদ্যনিরাপত্তার স্বার্থে। এজন্য কৃষি ও কৃষিজমির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও সরকারি কর্তৃপক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ ও পদক্ষেপ জরুরি। কৃষিজমি রক্ষার জন্য দেশে আইন রয়েছে। কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। কৃষিজমি রক্ষার জন্য বাংলাদেশে বর্তমানে কৃষিজমি (রূপান্তর) অ্যাক্ট, ২০০১ বলবৎ রয়েছে। এই আইন প্রায় সর্বত্রই উপেক্ষিত হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আইন প্রয়োগে ব্যর্থ হচ্ছে। যথাযথ প্রয়োগের জন্য আইনটিকে আরও কঠোর করে সংশোধন করতে হবে।

সমন্বিত পদক্ষেপ চাই : সরকার ও সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে এখনই সমন্বিত উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নিতে হবে কৃষিজমি রক্ষার জন্য। একই সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে ফসলের উৎপাদন বাড়াতে হবে। কৃষক যাতে তাদের শ্রমের মর্যাদা ও ফসলের ন্যায্যমূল্য পায়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। কৃষি ও কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে, কৃষিনির্ভর অর্থনীতি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।


চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক