সমঝোতার পথই শুল্ক সমস্যা সমাধানের সেরা উপায়
যুক্তরাষ্ট্রের ‘রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ নীতির ঘোষণায় এখনও বিশ্বজুড়ে তোলপাড় চলছে। এ নীতির কারণে বিশ্বের ধনী-দরিদ্র প্রতিটি দেশকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির জন্য কমপক্ষে ১০ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। প্রধান রপ্তানিকারক কিছু দেশকে গুনতে হবে ২০ থেকে ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক। বিভিন্ন দেশ বিভিন্নরকম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এই শুল্কনীতি সম্পর্কে। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা এই নীতিকে ঘিরে বড় রকমের বাণিজ্যযুদ্ধের আশঙ্কা দেখছেন। এর প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা নেমে আসতে পারে বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।
বাংলাদেশের অবশ্য বাণিজ্য যুদ্ধ বা বিশ্ব মন্দা নিয়ে ভাবার সুযোগ নেই। বাণিজ্য যুদ্ধ বা মন্দা দেখা দিলে বিশ্বের প্রতিটি দেশের মতো বাংলাদেশেও তার তীব্র প্রভাব পড়বে। তবে এমন আঘাত এলেও সেটি বেশ সময়সাপেক্ষ। বাংলাদেশকে বরং ভাবতে হচ্ছে ট্যারিফ নীতির তাৎক্ষণিক ও প্রত্যক্ষ প্রভাব নিয়ে। কারণ স্বল্প যে কয়েকটি দেশের ওপর অতি উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশ তার একটি। এতদিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের পণ্য রপ্তানিতে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হতো। এখন থেকে গুনতে হবে ৩৭ শতাংশ, যা আগের হারের দ্বিগুণেরও বেশি।
নিয়ম অনুসারে, পণ্য আমদানির শুল্ক সংশ্লিষ্ট আমদানিকারককে পরিশোধ করতে হয়। আমাদের রপ্তানিকারকদের সরাসরি এ শুল্ক দিতে হবে না। কিন্তু তবু তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য। কারণ বাড়তি শুল্কের কারণে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানির খরচ বাড়বে। ফলে পণ্যের দাম না বাড়ালে মুনাফার মার্জিন কমে যাবে। তাতে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা নিরুৎসাহিত হবেন, তারা পণ্য আমদানির বিকল্প উৎসের প্রতি ঝুঁকবেন। অন্যদিকে আমদানিকারকরা যদি পণ্য মূল্য বাড়িয়ে মুনাফা ঠিক রাখতে চান, তা হলে বাড়তি মূল্যের কারণে ক্রেতার আগ্রহ কমে যাবে। পণ্যের চাহিদা কমলে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
পাল্টা ট্যারিফের সম্ভাব্য সংকট সমাধানে সরকার ইতোমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছে। শনিবার (৫ এপ্রিল) প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছেন। তার আগে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ বৈঠকেও বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ এবং বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা ও সমঝোতার পথে এগোনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা নিজে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলার দায়িত্ব নিয়েছেন। পাশাপাশি আজ-কালের মধ্যে একটি আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠানো হবে। তাতে বাড়তি শুল্কের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করা হবে। এ ছাড়া সরকার যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে শুল্ক কমানো ও দেশটি থেকে আমদানি বাড়ানোর জন্য কী কী উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সেগুলোর উল্লেখ থাকবে। ইতোমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও ট্যারিফ কমিশন শুল্ক হ্রাসের ক্ষেত্রগুলো এবং সম্ভাব্য আমদানি পণ্য চিহ্নিত করার কাজ শুরু করে দিয়েছে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
শুল্ক সমস্যার সমাধানে সরকার বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্তই নিয়েছে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় অর্থনীতির সঙ্গে বিরোধে জড়ানো বা চ্যালেঞ্জ করার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই। দেশটি বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের প্রধান বাজার। আমাদের মোট রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশের বেশি আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এ বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার ধাক্কা সামলাতে পারবে না আমাদের অর্থনীতি। দ্বিতীয়ত, ট্রাম্প প্রশাসন তার দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন শুল্কনীতি প্রণয়ন করেছে। তাদের প্রধান লক্ষ্য বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি কমানো। যে কয়েকটি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বাণিজ্য ঘাটতি আছে, বাংলাদেশ তার একটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৭ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার এবং দেশটি থেকে আমদানি ছিল ২ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ৫ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার।
দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি তীব্র চাপে আছে। বছরের পর বছর ধরে দেশটিতে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি চলছে। শিল্প খাতেও বিরাজ করছে মন্থরতা। ইউএস সেনসাস ব্যুরো (ট.ঝ. ঈবহংঁং ইঁৎবধঁ)-এর পরিসংখ্যান অনুসারে, মাত্র এক দশকে দেশটির বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৭৩৪ বিলিয়ন ডলার, যা বেড়ে ২০২৪ সালে ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার দাঁড়ায়। বিশাল বাণিজ্য ঘাটতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বাজেট ঘাটতিও বাড়ছে। আর এই ঘাটতি মেটাতে বেপরোয়াভাবে ঋণ নিতে হচ্ছে দেশটিকে, যা অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি করছে। ইতোমধ্যে একাধিকবার ঋণের পরিমাণ জাতীয় ঋণসীমাকে ছাড়িয়ে যাওয়ায় দেশটির কিছু জরুরি সেবা ছাড়া বাকি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার হুমকির মুখে পড়ে। দেশটির সংসদ কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট এবং নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ বিপর্যয় এড়াতে কখনও ঋণসীমা বাড়িয়েছে, কখনও সাময়িকভাবে এটি স্থগিত করেছে। গত বছরের ডিসেম্বরেও দেশটি শাটডাউনের মুখে পড়েছিল। ওই সময়ে জাতীয় ঋণসীমা ছিল ৩৩ ট্রিলিয়ন ডলার, কিন্তু ঋণের পরিমাণ ৩৬ ট্রিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। এমন বাস্তবতায় বাণিজ্য ঘাটতি কমানো, নিজ দেশের শিল্প খাতে প্রাণসঞ্চার ও ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য শুল্ক বাড়ানোকে সবচেয়ে উপযোগী হাতিয়ার মনে করেছে নতুন প্রশাসন।
তাই যুক্তরাষ্ট্রের বাস্তবতা ও ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের বিষয়টি মাথায় রেখেই ‘রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ নীতিজনিত সংকট উত্তরণে উপযোগী পথ খুঁজতে হবে। এদিক থেকে সরকারের অবস্থান বাস্তবসম্মত হলেও উদ্যোগগুলোর বাস্তবায়ন করতে হবে দ্রুতগতিতে। হাতে তেমন সময় নেই। আগামী ৯ এপ্রিল নতুন শুল্ক হার কার্যকর করার কথা। এর মধ্যে চূড়ান্ত সমঝোতা করা না গেলেও সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত নতুন শুল্ক হার স্থগিত রাখার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সম্মত করানো জরুরি।
এমনিতেই আমরা বেশ বিলম্ব করে ফেলেছি। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধির ঘোষণা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো আকস্মিকভাবে আসেনি। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর একাধিকবার ইঙ্গিত দিয়েছেন। শুরুটা হয় জানুয়ারি মাসে চীনের সব পণ্যে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের মধ্য দিয়ে। ফেব্রুয়ারিতে মেক্সিকো ও কানাডার পণ্যেও শুল্ক বৃদ্ধির ঘোষণা দেন তিনি। এরপর অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও যে এমন সিদ্ধান্ত আসতে পারে, তা ভালোভাবেই অনুমান করা যাচ্ছিল।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
বেশ কিছু দেশ সম্ভাব্য পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে প্রস্তুতিও নেয়, প্রক্রিয়া শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে মোটা দাগে শুল্ক কমানোর। দেশগুলোর মধ্যে প্রতিবেশী ভারতও আছে। ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের আগেই মার্কিন পণ্যে শুল্ক কমানোর প্রক্রিয়া শুরু করে দেশটি। এরই মধ্যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের মদের ওপর শুল্কের হার ১৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০০ শতাংশ, কৃষিপণ্যের শুল্ক ১০০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ নির্ধারণ করে। দেশটিতে অনলাইন প্ল্যাটফর্মের বিজ্ঞাপনে বিদ্যমান ৬ শতাংশ কর প্রত্যাহারেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়, যার সুফল পাবে গুগল, ফেসবুক (মেটা) ও আমাজনের মতো মার্কিন টেক জায়ান্টরা। এ ছাড়া ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী ইলন মাস্কের টেসলা গাড়ির বাজার বাড়াতে সব মার্কিন ইলেক্ট্রিক গাড়ির ওপর শুল্ক হার কমানোর প্রক্রিয়াও শুরু করে দেশটি। এর সুফলও পায় তারা। ভারতীয় পণ্যে ২৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়, যা আগের তুলনায় ১০ শতাংশ কম।
নতুন শুল্কনীতি ঘোষণার একদিনের মাথায় থাইল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানিতে ব্যাপকভাবে শুল্ক কমানোর ঘোষণা দেয়। ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান সরাসরি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ফোন করে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৯০ শতাংশ শুল্ক শতভাগ প্রত্যাহারের কথা জানান। তিনি একটি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির আগ্রহ প্রকাশ করে তা স্বাক্ষরের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্পকে ভিয়েতনাম সফরের আমন্ত্রণ জানান। উচ্ছ্বসিত ট্রাম্প নিজেই তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে তা জানিয়েছেন। মনে রাখা প্রয়োজন, ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। ইতোমধ্যে কম্বোডিয়া যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে শুল্কের হার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতম মিত্র ইসরায়েলও বাড়তি শুল্কের ধাক্কা এড়াতে কূটনৈতিক উদ্যোগ শুরু করেছে। আমরা যদি জানুয়ারি থেকেই কূটনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করতে পারতাম তাহলে হয়তো পরিস্থিতি আরেকটু সহনীয় হতো।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় শুল্ক হ্রাস ছাড়াও বেশ কিছু ইস্যু উঠে আসতে পারে। বাংলাদেশে আমদানি শুল্ক ছাড়াও নানা ধরনের শুল্কের প্রচলন আছে। এ ছাড়াও আছে কিছু অ-শুল্ক বাধা। প্রয়োজনে সেগুলোতেও ছাড় দিতে হবে। তবে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে আমাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের বিষয়ে যাতে যুক্তরাষ্ট্র আস্থা রাখতে পারে সেটি নিশ্চিত করা। কারণ আমাদের বিষয়ে দেশটির কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতাও আছে। আমরা দেশটি থেকে যে তুলা আমদানি করি, এক সময় বন্দরে সে তুলা ফিউমিগেশনের (জীবাণু ও বিষমুক্ত করা) বাধ্যবাধকতা ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পুনঃপুন অনুরোধ ও তাগিদের পরও সেটি প্রত্যাহারে আমাদের ২০ বছর সময় লেগেছে। শ্রম ইস্যু নিয়ে তাদের কিছু পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ আছে। বছরের পর বছরে ধরে এগুলো ঝুলে আছে, গ্রহণযোগ্য সমাধান করা হয়নি। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে ‘টিকফা’ চুক্তি করার জন্য অনেক বছর ধরে চেষ্টা চালাচ্ছে। এটিও ঝুলে আছে, যা দেশটি ভালোভাবে না-ও নিয়ে থাকতে পারে। দক্ষ কূটনৈতিক চেষ্টা ও কার্যকর দরকষাকষির মাধ্যমে দেশের স্বার্থ রক্ষা করেই কীভাবে ঝুলে থাকা ইস্যুগুলোর সমাধান করা যায় সে চেষ্টা করতে হবে সরকারকে।
জিয়াউর রহমান : সাংবাদিক ও বিশ্লেষক
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!