পথের দিশা নিশ্চিত করতে হবে তরুণ প্রজন্মকেই
ইদানীং বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে নানা ধরনের তর্কবিতর্ক নতুন প্রজন্মের সামনে একটি ধোঁয়াচ্ছন্নতা তৈরি করছে। এমনিতেই আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে জ্ঞানচর্চাহীন স্বার্থবাদী রাজনীতি জেঁকে বসেছে অনেককাল ধরে। এসব রাজনীতির নিয়ন্ত্রক নিজ নিজ রাজনৈতিক সুবিধা ও অভিলাষ চরিতার্থ করতে গিয়ে নতুন প্রজন্মকে ইতিহাসচর্চা-বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে, যাতে ক্ষমতাসীনদের প্রযোজিত কাহিনিকে ইতিহাস বলে বিবেচনা করতে পারে।
ভাইসরয় লর্ড কার্জনের ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ একটি নতুন বিতর্ক নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। বিশাল বাংলাকে ভেঙে শাসনতান্ত্রিক সুবিধার কথা বলে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ নামে নতুন দৃশ্যপটকে স্বাগত জানিয়েছিল পূর্ববঙ্গের বাঙালি, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান। অবহেলিত পূর্ববঙ্গে উন্নয়নের ছোঁয়াও লাগতে থাকে। ঢাকা নতুন প্রদেশের রাজধানী হওয়ায় এখানে একে একে স্থাপিত হয় স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত। ব্যবসায়-বাণিজ্যের জন্য কলকাতার মুখাপেক্ষী হওয়ার প্রয়োজন কমে যায়। বঙ্গভঙ্গের সুফল হিসেবে রাজধানী শহর ঢাকায় বড় বড় ইমারত নির্মিত হতে থাকে। হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট, কার্জন হল ইত্যাদি নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এভাবেই পূর্ব বাংলার মানুষ নতুনভাবে আশাবাদী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব ঘোষিত হলে বাংলার মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এক ধারার ভাবনায় মনে করা হয়, ইংরেজরা নিশ্চিন্তে দেশ শাসন করার জন্য এ অঞ্চলের অধিবাসীদের দুর্বল করে ফেলতে চাইছে। কংগ্রেস সমর্থক শিক্ষিত ও উচ্চবিত্তের হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা মনে করেন, এই বিভক্তি বাঙালির ঐক্যকে নষ্ট করে দেবে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপর হানবে চরম আঘাত। পূর্ববঙ্গের মুসলমান নেতারা মনে করেন, কলকাতার শিক্ষিত বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা পূর্ব বাংলার অনুন্নত ও অবহেলিত মুসলমানদের উন্নতির বিষয়টিকে সুনজরে গ্রহণ করেননি। তারা জানতেন বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলে নবগঠিত প্রদেশের রাজধানী হবে ঢাকা। এ অবস্থা কলকাতাবাসী ব্যবসায়ী, উকিল ও শিক্ষিত সমাজের স্বার্থবিরোধী হবে বলে মনে করা হয়। কলকাতায় অবস্থানকারী পূর্ব বাংলার জমিদাররাও কলকাতার বিলাসিতা ছেড়ে পূর্ব বাংলায় ফিরে যেতে উৎসাহী ছিলেন না। এসব কারণে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন তীব্র হতে থাকে।
এদিক বিচারে অনেকের অভিমত, বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব ইংরেজ শাসকদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতিরই প্রভাব। বাঙালিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ তৈরি করে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করে দিতে চেয়েছে। না হলে বাংলা ও ভারতে সুলতানি ও মোগল পর্বের প্রায় ছয়শ বছরের মুসলিম শাসনে যেখানে হিন্দু-মুসলমান বন্ধুর মতো পাশাপাশি বসবাস করেছে, তারাই এখন শত্রুতে পরিণত হলো; যে কারণে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন এক পর্যায়ে ইংরেজ শাসনবিরোধী রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে পরিণত হয়; যার প্রতিক্রিয়ায় ১৯১১ সালে সরকার বাধ্য হয় বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করতে। এই ঘোষণা পূর্ব বাংলার মুসলমান নেতাদের আশাহত করেছিল।
হিন্দু নেতারা তাদের মতো করে সক্রিয় হতে থাকেন। রাজনীতি ক্রমে হতে থাকে উত্তপ্ত। ইংরেজ শাসকরা সময়ের বাস্তবতা বুঝতে পেরে নিজেদের গুটিয়ে নিতে থাকে। ক্রমে স্পষ্ট হতে থাকে, ঔপনিবেশিক শাসনের সমাপ্তি ঘটতে চলছে। এ পর্বে মুসলমানদের রাজনীতির পুরোভাগে চলে আসেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ১৯২৯ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণ করার জন্য ১৪ দফা দাবি উপস্থাপন করেন। এই দাবিগুলোর মধ্যে স্বতন্ত্র নির্বাচন, প্রদেশের সরকারকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়া এবং কেন্দ্রীয় আইনসভার মোট আসনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখার বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্ব পায়। প্রকৃতপক্ষে জিন্নাহর ১৪ দফা সংকট মোচন না করে মুসলমান সম্প্রদায়কে হিন্দুদের প্রতিপক্ষ করে তোলে। ১৯৩২ সাল পর্যন্ত উত্তপ্ত রাজনীতি হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ককে নাজুক করে দিয়েছিল।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
ঔপনিবেশিক শাসকরা দুই সম্প্রদায়ের উত্তেজনা প্রশমনের জন্য অনেক নিষ্ফল প্রয়াস চালায়। শক্তিশালী হিন্দু সংগঠনগুলোর তুলনায় মুসলিম সংগঠন দুর্বল ছিল। তাই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহরা বুঝেছিলেন, ইংরেজ শাসকরা ভারতীয় নেতাদের হাতে ক্ষমতা বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলে নেতৃত্বে চলে আসবেন হিন্দু নেতারা। পারস্পরিক বিশ্বাস যেভাবে ভেঙে গিয়েছিল তাতে শঙ্কায় পড়লেন মুসলমান নেতারা। এ কারণে তারা মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি চাইলেন। পাকিস্তানের রূপরেখা তৈরি হয় এভাবেই। কিন্তু কংগ্রেসসহ হিন্দু সংগঠনগুলোর সমর্থন পায়নি পাকিস্তান প্রস্তাব। খুব সহজেই যে পাকিস্তান অর্জিত হয়েছিল তেমন নয়। রীতিমতো আন্দোলনে নামতে হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, পাকিস্তান অর্জনের জন্য রাজপথে সক্রিয় আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল বাঙালি।
বাংলার রাজনীতিতে চূড়ান্ত ধাপ হচ্ছে ১৯৩৭Ñ১৯৪৭ সালের রাজনৈতিক বিবর্তন। ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের শেষ ঘটনাবলি এই সময়েই ঘটেছিল। ১৯৩৫ সালের প্রস্তাবিত ভারত শাসন আইন ১৯৩৭ সালে কার্যকর করা হয়। এ বছরই এ আইনের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে প্রাদেশিক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এর মধ্যে নতুন পরিবর্তনের সম্ভাবনায় বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ছাড়াও ১৯২৯ সালে গঠিত হয়েছিল ‘নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি’ নামের একটি সংগঠন। ১৯৩৫ সালে একে ফজলুল হক এ সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ভারত শাসন আইনের পরে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনীতিতে কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। এ পর্যায়ে ফজলুল হক ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ফেডারেশন’ নামের একটি সংগঠনে যোগ দেন। অবশ্য প্রজা সমিতির প্রতিও তার সমর্থন থাকে। ১৯৩৬ সালে ‘নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি’ ‘কৃষক প্রজা পার্টি’ নামে নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করে। এই দলের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র থাকায় কিছুসংখ্যক মুসলিম নেতা ‘নিউ মুসলিম মজলিশ’ নামের একটি দল গঠন করেন, যা পরে ‘ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৭ সালের নির্বাচন ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এর সূত্র ধরেই এ দেশের গণমানুষের নেতা একে ফজলুল হক মন্ত্রিসভা গঠন করার সুযোগ পান। যদিও এ দেশের রাজনীতিতে পথচলা তখনও তেমন নিষ্কণ্টক ছিল না, তথাপি রাজনৈতিকভাবে ভারতবাসীর যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছিল, এর সূত্র ধরেই ভারত বিভাগের প্রথম সূচনা হিসেবে লাহোর প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা অর্জন ছিল এরই ধারাবাহিকতা।
অনেক প্রত্যাশা নিয়ে বাঙালি পাকিস্তানের জন্য রাজপথে আন্দোলন করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, পাকিস্তান সৃষ্টির অল্পদিন পরই তারা স্বাধীনতার কটু স্বাদ আস্বাদন করল। পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা চলে গেল উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের হাতে। ওদের ভাই হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন পূর্ব বাংলার (পূর্ব পাকিস্তান নাম পেয়েছে ১৯৫৬-এর সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর) নেতারা। কিন্তু সে মর্যাদা রাখেনি পাকিস্তানি শসকরা। ১৯৪৮-এর ডিসেম্বরে করাচিতে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের সভায় বাঙালি সদস্যের যৌক্তিক দাবি থামিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার সদম্ভ আওয়াজ তোলে। বাঙালি নেতা ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা বুঝতে পারেন, স্বাধীনতার নামে বাঙালিকে কোণঠাসা করে ফেলতে চায় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা। এভাবে পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই অস্বস্তিতে পড়ে যায় বাঙালি। ভাষা আন্দোলন দিয়ে শুরু হয় বাঙালির প্রতিবাদ। ইংরেজদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুলের’ মতো করে বাঙালির মধ্যে বিভেদ তৈরির চেষ্টা করে শাসকগোষ্ঠী। পাকিস্তানের পরিচিত ইসলামী দলের নেতা গোলাম আযম ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। অচিরেই জামায়াতে ইসলামী দলটিকে মুঠোয় নিয়ে আসে শাসকরা। তাই ১৯৭০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে এক সভায় গোলাম আযম নিজেই বলেন, ভাষা আন্দোলনে যোগ দেওয়া তার ভুল ছিল। উর্দুকেই তিনি সমর্থন করেন। সেন শাসকরা যেমন বাঙালিকে দাবিয়ে রাখার জন্য বাংলা ভোলানোর চেষ্টা করে সংস্কৃত চাপাতে চেয়েছিল, প্রচার করেছিল সংস্কৃত দেব ভাষা, তেমনি ১৯৫৮-এর পরে আইউব খানের সময় থেকে প্রচারণা শুরু হয়, উর্দু কোরআনের ভাষা আর বাংলা হিন্দুর ভাষা। উভয়ের উদ্দেশ্যই এক ছিল। সে সময় থেকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ভারতবিরোধিতা ছড়াতে থাকে পাকিস্তানি শাসকরা। যে ফর্মুলা এখনও সক্রিয় রয়েছে। তবে আধুনিক সময়ে ভারতবিরোধী মনোভাব সৃষ্টির পেছনে ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীরও যে ভূমিকা রয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
কিছুসংখ্যক পাকিস্তানপন্থিকে বাদ দিলে ভারত বিভক্তির মধ্য দিয়ে সৃষ্ট পাকিস্তান বাঙালিকে স্বস্তি দিতে পারেনি। তাই সৃষ্টির পর থেকে পাকিস্তানের চব্বিশ বছর শাসকদের বিরুদ্ধে বাঙালিকে অধিকার আদায়ের লড়াই করতে হয়েছে। বাঙালির দাবির প্রতি কোনো ধরনের সম্মান জানায়নি পাকিস্তানি শাসকরা, যে কারণে অধিকার আদায়ের দাবি একসময় স্বায়ত্তশাসন অর্জনের দাবিতে পরিণত হয়। দাবি পূরণের বদলে নেমে আসে নিপীড়ন, শেষ পর্যন্ত যা টেনে নিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত।
২০২৪-এ আমাদের তরুণ প্রজন্ম অসীম বীরত্বে অসাধ্য সাধন করেছে। স্বৈরশাসকদের বিতাড়িত করেছে। কিন্তু যখন আমরা তরুণদের নির্লোভÑনির্মোহ শক্তি দিয়ে দীর্ঘদিনের কালিমা মোচন করে রাজনীতি ও সমাজকে পরিশুদ্ধ করব বলে বিশ্বাস করতে চাচ্ছি তখনই মনে হচ্ছে ওদের ওপর যেন সেনরাজা বল্লাল সেন, লক্ষ্মণ সেন বা আইউব খানদের প্রেতাত্মা ভর করতে চাইছে। এ থেকে রক্ষা পেতে হলে ইতিহাসের কাছেই ফিরতে হবে। কারও গাইডলাইনে নয়Ñ ইতিহাস অধ্যয়ন করে পরবর্তী পথের দিশা নিশ্চিত করতে হবে তরুণ প্রজন্মকেই।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়