উন্নয়নেও বৈষম্য
অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেক বড় বিষয়, দীর্ঘমেয়াদি এর প্রক্রিয়া ও প্রভাব। স্বল্প সময়ে এর স্বরূপ বিশ্লেষণ কঠিন। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সচরাচর আমাদের সামনে আসে তা হলো, উন্নয়নের নামে উন্নয়ন বরাদ্দে আঞ্চলিক বৈষম্য। উন্নয়ন বরাদ্দের ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনা প্রাধান্য পায় বলে প্রতীয়মান হয় এবং এ ব্যাপারে অনুযোগ-অভিযোগ প্রায়ই পাওয়া যায়। নানা পর্যালোচনা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাষ্ট্রের চেয়ে সরকারের ওপর নির্ভর করে উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত ও বাস্তবায়িত হচ্ছে, আঞ্চলিক উন্নয়ন হচ্ছে। প্রয়োজন সরকারের সময়সীমার মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্প নেওয়া, অন্যথায় সরকারের পরিবর্তন ঘটলে জাতীয় উন্নয়ন প্রকল্পও পরিত্যক্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। লাগসই ও টেকসই উন্নয়ন পরিক্রমার জন্য এটি বিব্রতকর পরিস্থিতি।
বলা বাহুল্য, স্রেফ রাজনৈতিক কারণে আঞ্চলিক তথা আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে মনুষ্যসৃষ্ট বৈষম্যের কারণে এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। তৎকালীন পাকিস্তানের নীতিনির্ধারক রাজনৈতিক ও সামরিক-বেসামরিক প্রভাবশালী আমলারা অধিকাংশই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। তাই ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসনে পূর্বের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন হয়েছিল অঞ্চলভিত্তিক। সে সময় সিংহভাগ বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহার ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হতো পশ্চিম পাকিস্তানেই। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমানের বাংলাদেশ বরাবরই ছিল বঞ্চিত। এ বৈষম্যের কারণেই এ থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য বাংলাদেশকে মহান মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল।
স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশে কেন্দ্রীভূত চিন্তাচেতনায় শক্তিশালী পরিকল্পনা কমিশন গঠন করা হয়। সব অঞ্চলের সমান সুবিধাপ্রাপ্তির কথা মাথায় রেখেই এই কেন্দ্রীয় ভাবনার কমিশন গঠিত হয়। এসব কথা কাগজে-কলমে থাকলেও পরবর্তীকালে বাস্তবে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে পাকিস্তানের মতোই বিশেষ দল, মত, গোষ্ঠী, কর্মকর্তা বা অঞ্চল প্রাধান্য পেতে থাকল, যার ফলে দেশের উত্তর জনপদ দীর্ঘদিন অবহেলিত ছিল। যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের পর সেখানে অন্যান্য প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে শুরু করেছে। দেশের সংবিধানে লেখা আছেÑ জš§স্থান, শিক্ষাগত যোগ্যতা, অর্থনৈতিক অবস্থান ও অঞ্চলভিত্তিক বিবেচনার পরিবর্তে সবার সমান মৌলিক অধিকার পাওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগে উদ্ভব হয়েছে নানা জটিলতা। রাষ্ট্রের সুবিধা ক্ষমতাসীন দল, সরকার মতাবলম্বী নেতাকর্মী ও কর্মকর্তাদের করায়ত্তে চলে যায়।
ইআরডিতে কাজ করার সময়ে দেখেছি, ক্ষমতাসীন দল, সচিব কিংবা কর্মকর্তারা বিদেশি দাতাগোষ্ঠীকে নিজ গ্রাম বা অঞ্চলেই নিয়ে যান বিশেষ প্রকল্পের জন্য। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের অধিকাংশ সাহায্য সংস্থ’া কাজ করে কোনো কোনো বিশেষ অঞ্চলে। কারণ সংশ্লিষ্টদের ওই অঞ্চলের প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব রয়েছে। বাইরে থেকে বড় যে কোনো সাহায্য সংস্থা এলেই ওই অঞ্চলে কাজ শুরু করে। এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পক্ষপাতিত্ব বাদ দিয়ে মৌলিক ও সর্বজনীনতার ভিত্তিতে উন্নয়নের অধিকার নিশ্চিতকরণের অনিবার্য অবকাশকে অস্বীকার করা চলে না।
আমাদের জিডিপির ২৫ শতাংশ আসে উপকূলীয় অঞ্চল থেকে। এখানে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, দুটি প্রধান সমুদ্রবন্দর, আনব্রোকেন সি-বিচ। অথচ এ অঞ্চলের স্থায়ী উন্নয়নে কেন্দ্রীয়ভাবে কেউই বিশেষ মনোযোগী হননি। উপকূলীয় উন্নয়ন বোর্ড গঠনের কথা বলা হয়েছিল ল্যাগিং বিহাইন্ড কমিটির রিপোর্টে। এরপর কিছু কথাবার্তা হলেও আলোর মুখ দেখেনি সে পরিকল্পনা। এর মূল কারণ একটিইÑ সরকারি প্রশাসনে এ অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বকারীদের অংশগ্রহণ শক্তিশালী ভূমিকায় ছিল না বা নেই। তাই এ অঞ্চল বরাবরই বঞ্চিত হয়ে এসেছে। আইলা বা সিডরের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষকে সীমাহীন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বোঝা যায় এতদঞ্চলের মানুষ প্রকৃতি ও রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার দৃষ্টিতে কতটা উপেক্ষিত। সিডর ও আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত ক্ষতিপূরণ পেতেও অনেক টালবাহানা, মামলা-মোকদ্দমার সমস্যা হয়েছে। এসব খবর বিভিন্ন সময়ে আমরা পেয়েছি। সব কিছুর মূলে রয়েছে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা, দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়নবৈষম্য।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
প্রতিটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনের আগে তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনার ইশতেহার ঘোষণা করে। প্রতিশ্রুতি দেয়, দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলে তারা এ অনুযায়ী কাজ করবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এজাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কমযজ্ঞ দর্শনের দৃষ্টিতে যুক্তিযুক্ত কিন্তু সেটি দলীয় কর্মসূচির সীমাবদ্ধতার আবর্তে না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব, দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত কর্মকাণ্ডের প্রভাব পড়ে আঞ্চলিক উন্নয়নে। দেখা যায়, নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা শুধু নিজের এলাকার কথা বলেন। অনেকে স্থানীয় জনপ্রিয়তার সুবিধা বিবেচনায় রেখে স্থানীয় শুল্ক বা কর আরোপ করতে চান না। ভাবেন, এতে তার ভোট নষ্ট হবে। কিন্তু এমনটা হওয়া উচিত নয়। উন্নয়ন সরকারকেই করতে হবে। তার জন্য অর্থের প্রয়োজন। জনগণকে বোঝাতে হবে, আপনার অর্থ ব্যয় করা হবে আপনারই সেবায়। উন্নয়ন হওয়া দরকার সার্বিক ও নিরপেক্ষভাবে।
ব্র্যাক সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখিয়েছেÑ নব্বইয়ের দশক থেকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল কিংবা প্রভাবশালী মন্ত্রীরা শুধু নিজেদের এলাকার উন্নয়ন করেছেন। আমরা এই তথ্যের সঙ্গে একমত। সংসদে সবাই দেখে সংসদ সদস্যরা বাজেট আলোচনায় নিজ এলাকায় ডাকঘর ও সেতু তৈরির দাবির ওপর জোর দেন বেশি। বাজেট তো জাতীয় বিষয়। এখানে আঞ্চলিক স্বার্থ মুখ্য হতে পারে না। দেশ, জাতি ও অর্থনীতিÑ কোন দিকদর্শন সামগ্রিক উন্নয়নে কাজ করবে, সেটিই বাজেটের পর্যালোচনায় আলোচিত হওয়া উচিত ।
গবেষণায় দেখা গেছে, সংসদে বাজেট পর্যালোচনায় পাওয়া দশ মিনিটের মতো সময় মাননীয় সংসদ সদস্যরা কীভাবে ব্যয় করেন। প্রায় প্রতিজনই ৬ মিনিট অর্থাৎ ৬০ শতাংশ সময় ব্যয় করেন দলের নেতাসহ অন্যদের স্তুতি ও বন্দনাগীত করে। বাকি ৪ মিনিটে নিজের কিংবা নিজ অঞ্চলের স্বার্থের কথা তুলে ধরেন; যেখানে জাতীয় বাজেটে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা তুলে ধরাই ছিল যথার্থ। একইভাবে বিরোধীদলীয়রাও প্রথম ৬ মিনিট বাজেটের কূট সমালোচনা করেন, পরে নিজের কিছু কথা থাকলে তা বলেন। এসব আলোচনায় জাতীয় স্বার্থের প্রতিফলন ঘটে না। বিশেষ করে উন্নয়নকাজে ব্যবহৃত বৈদেশিক ঋণ বা সাহায্যের ব্যবহার বা সেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে সংসদে আলোচনা হয় না। হলে সবাই বুঝতে পারতেন কোথায় কী হচ্ছে, কীভাবে ঋণ বা অনুদান সহায়তা ব্যয় হচ্ছে। উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ ও দেশের সার্বিক উন্নয়নের অভীপ্সা প্রতিফলিত হওয়া সবচেয়ে জরুরি। সংসদে মাননীয় সদস্যরা যেসব লিখিত প্রশ্ন (তারকা চিহ্নিত প্রশ্ন) করেন সেগুলোও একই ধারায় হয়ে থাকে। প্রশ্ন আসেÑ মাননীয় মন্ত্রী বলবেন কি এ পর্যন্ত আমরা কত বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছি? এটা কার্যকর কোনো প্রশ্ন হতে পারে না। এর জবাব সবখানেই পাওয়া যায়। বরং প্রশ্ন হতে পারতÑ এ পর্যন্ত বিভিন্ন খাতে পাওয়া আমাদের বৈদেশিক সাহায্য দিয়ে কোন কোন এলাকায় কী কী উন্নতি হয়েছে? কিংবা এসব সাহায্যপ্রাপ্তিতে কী কী শর্ত আরোপিত হয়েছে। তাহলে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সরকারি উন্নয়ন ও কর্মকাণ্ডের গতিপ্রকৃতি জনগণ জানতে পারত। কিন্তু এই প্রশ্ন তো রাখা হয় না। মাননীয় সংসদ সদস্যরা দেশ, জাতি ও অর্থনীতির উন্নয়নে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে জাতীয় চেতনাকে শাণিত ও উজ্জীবিত করতে পারেন।
মাননীয় মন্ত্রী হচ্ছেন সমগ্র দেশের। তিনি শপথের সময় বলেনÑ কারও প্রতি রাগ কিংবা অনুরাগের বশবর্তী হয়ে কোনো পদক্ষেপ নেবেন না। এ কথার মাধ্যমে স্পষ্ট বোঝা যায়, তিনি শুধু নিজের অঞ্চলের কিংবা তার দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের প্রতি অনুরাগে ও পক্ষপাতিত্বে সিক্ত হবেন না। অন্যান্য অঞ্চলের, দলের, মতের মানুষের উন্নয়নের ব্যাপারেও সমভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকবেন তারা। অনেক সময় দেখা যায় মন্ত্রী বা ক্ষমতাসীন দলের অঞ্চলে অধিক উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। কোনো এলাকার বিশেষ কারও ক্ষমতাবলে ওই এলাকায় অভূতপূর্ব সব উন্নয়ন কার্যক্রম হয়েছে। হঠাৎ করে ওই সব এলাকা দেখলে আরেক বাংলাদেশ কিংবা দেশের বাইরের কোনো জায়গা বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এটা তো হওয়ার কথা নয়। তাহলে যেসব অঞ্চল থেকে কোনো প্রভাবশালী মন্ত্রী বা নেতা নেই বা আসেননি, তারা কি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘দরখাস্তের দ্বিতীয় পাতায়’ চলে যাবে? এ ধরনের প্রভাব কিংবা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার সুবাদে অঞ্চলে ও গোত্র কিংবা দলগত উন্নয়ন ভাবনায় জাতীয় উন্নয়ন চেতনা ও দর্শনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষতাসীনরা অনেকে ভাবতেই পারেন, আগামীবার ক্ষমতায় আসতে হলে নিজের এলাকায় কাজ দেখাতে হবে। এতে করে জাতীয় নেতৃত্ব গোটা দেশের দায়িত্ব পালনে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েন। গোটা দেশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার পূর্ণ প্রতিফলন তার বা তাদের দ্বারা ঘটে না।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
কার্যকর সুরাহা-সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ তথা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দেশের সামষ্টিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ও পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য; সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!