আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে মুশফিক মাহমুদউল্লাহর অভিমানী বিদায়

জাহিদ রহমান
২৪ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে মুশফিক মাহমুদউল্লাহর অভিমানী বিদায়

সময়ের ব্যবধান মাত্র এক সপ্তাহ। এই সময়ের মধ্যে দেশের হয়ে দীর্ঘ সময় ধরে খেলা দুই ক্রিকেট নক্ষত্র মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ বিদায় জানালেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে আর কোনো ফরম্যাটের ক্রিকেটেই দেখা যাবে না। মুশফিক শুধু হাতে রেখেছেন টেস্ট ক্রিকেট। আপাতত তাদের নিয়ে তাই আর কোনো হিসাবনিকাশ নেই। নেই স্বপ্নের জালের নতুন কোনো বিনুনি। তবে দুজনের নীরব বিদায় কিছুটা হলেও ক্রিকেটাঙ্গনকে যেমন শোকাচ্ছন্ন করেছে তেমনি প্রশ্নবিদ্ধও করেছে। ক্রিকেট আঙিনার বাইরে দুজন আবার পরম আত্মীয়ও, সম্পর্কে আপন ভায়রা ভাই। দুজনেরই ক্রিকেটজীবনে কত উচ্ছ্বাস, কত রং, কত উত্তেজনাÑ অথচ দুজনের বিদায়টা হলো একেবারেই ম্যাড়মেড়ে। কোথায় যেন অভিমানের সুর। প্রশ্ন উঠেছে, তারা তো আন্তর্জাতিক ম্যাচ থেকেই বিদায় নিতে পারতেন। ক্রিকেট মাঠ থেকে রাজকীয় বিদায় নিয়েছেন ব্রায়ান লারা, শচীন টেন্ডুলকর, শহীদ আফ্রিদিসহ ক্রিকেটের কত কত নক্ষত্র। স্টিভ ওয়াহ, শচীন টেন্ডুলকার, কুমারা সাঙ্গাকারা, ইউনুস খানÑ এসব তারকার বিদায়ক্ষণ তো এখনও ক্রীড়ামোদীদের চোখে লেগে আছে। নিঃসন্দেহে এমনটা প্রাপ্য ছিল আমাদের দুই অহংকার মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহরও।

দেশের জন্য সারাজীবন খেলে, লড়াই করে মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহর বিদায় নিতে হলো একেবারেই নীরবে-নিভৃতে। দুজনের এমন বিদায় কেনÑ এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সর্বত্র। ভেতরে ভেতরে তাহলে কি কোনো বেদনার গান আছে, যে বেদনাকে আরও ভীষণ অব্যক্ত রাখতেই এমন নীরব প্রস্থান? সময় এলে হয়তো সব জানা যাবে। অবার বিষয়টি রহস্যময় হয়েও থাকতে পারে। ক্রিকেট বিশ্লেষকদের মতে, ঘোষণা দিয়ে মাঠের দুই নক্ষত্র মাঠ থেকে বিদায় নিলেই তা হতো শোভিত এবং সৌন্দর্যময়। কেননা বাংলাদেশের ক্রিকেটের উজ্জ্বলতম পাটাতন তৈরিতে এই দুই ক্রিকেটারের অবদান অসামান্য। দুজনই বরাবর সর্বোচ্চ পেশাদারত্ব দেখিয়েছেন আপন ভুবনে। ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায় তাই তাদের নাম বহুবিধ কারণেই আলোকময় হয়ে আছে। স্বভাবতই যে দর্শকদের কাছে তারা ভীষণ রকম প্রিয় ছিলেন, সেই দর্শকদের হাততালি ছাড়াই তাদের বিদায় স্মরণীয় হয়ে রইল না।

ফেব্রুয়ারি-মার্চে নবমবারের মতো দুবাইয়ে বসেছিল আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আসর। ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই টুর্নামেন্টের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয় ৯ মার্চ। দুবাই ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট স্টেডিয়ামে নিউজিল্যান্ডকে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশ একদম ভালো করেনি। টাইগাররা মিরাকল কিছু ঘটাতে পারেনি। ফলে হতাশার চিত্রটা ছিল সর্বত্র। কিন্তু সেই হতাশা পেরোতে না পেরোতেই পর পর দুজন ক্রিকেটারের অবসর ভালো লাগেনি কারও কাছেই। এটা সত্য, দুজনেরই বয়স হয়েছে। দুজনের ওপরই ভর করেছিল ক্লান্তি-অবসাদ। উইকেটের পেছনে বছরের পর বছর দাঁড়ানো মুশফিকের বয়স এখন ৩৮ ছুঁই ছুঁই। তার জন্ম ১৯৮৭ সালের ৯ মে। অন্যদিকে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের বয়স চল্লিশে পড়েছে, জন্ম ১৯৮৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। দুজনের বয়সের ব্যবধান মাত্র এক বছর।

প্রথমে আকস্মিকভাবেই ৫ মার্চ এক দিনের ক্রিকেটকে বিদায় জানান মুশফিকুর রহিম। ওই দিন সামাজিক মাধ্যম তথা ফেসুবকে তিনি বিদায়বার্তা সবার কাছে তুলে ধরেন। বিদায়বার্তায় তিনি বলেন, ‘আমি আজ ওয়ানডে ফরম্যাট থেকে অবসর ঘোষণা করছি। সব কিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ। বৈশ্বিক পর্যায়ে আমাদের অর্জন সীমিত হতে পারে, তবে একটি বিষয় নিশ্চিত, যখনই আমি আমার দেশের জন্য মাঠে নেমেছি, নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে ১০০ ভাগের বেশি দিয়েছি।’ তিনি আরও কিছু আবেগঘন কথা লেখেন। মুশফিক এর আগে ২০২২ সালে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। টি- টোয়েন্টি থেকে বিদায়ের আগে তিনি মোট ১০২টি ম্যাচ খেলে ১,৫০০ রান করেন। এখন কেবল টেস্ট ম্যাচেই তাকে দেখা যাবে। ২০০৬ সালে প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ খেলেন মুশফিকুর রহিম। গত ১৯ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে খেলেছেন ২৭৪ ম্যাচ। ৯ সেঞ্চুরি ও ৪৯ ফিফটিতে ৩৬.৪২ গড়ে করেছেন মোট ৭,৭৯৫ রান, যা বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তামিম ইকবালের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ দলকে ওয়ানডেতে নেতৃত্বও দিয়েছেন তিনি। টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন এযাবৎ ৯৪টি, যেখানে ৬,০০৭ রান, সঙ্গে রয়েছে ১১টি সেঞ্চুরি এবং ২৭টি ফিফটি। এদিকে ওয়ানডে ইতিহাসে ডিসমিসাল সংখ্যায় মুশফিক আছেন ৫ নম্বরে। ২৪১টি ক্যাচ নেওয়া মুশফিক স্টাম্পিং করেছেন ৫৬টি। টেস্ট, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে মুশফিক স্টাম্পিং করেছেন মোট ১০১টি।

অন্যদিকে ১২ মার্চ ওয়ানডে ক্রিকেটকে বিদায় জানান মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। তিনিও সামাজিক মাধ্যমে নিজের বিদায়বার্তার ঘোষণা দেন ঠিক মুশফিকের মতোই। ফেসবুকে ইংরেজিতে এক ছত্র লিখে বলেন, ‘বিদায় ক্রিকেট।’ মুশফিকের বিদায়ের গল্প ফুরোতে না ফুরোতেই মাহমুদউল্লাহর বিদায় সংবাদে ক্রীড়ামোদীরা খানিকটা বিস্মিতই হন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের এমন চিরবিদায়ের সংবাদ ক্রীড়াঙ্গনে কিছুটা বিষাদের ঢেউ তোলে। ক্রিকেটে কত অবদান, কত সাফল্য। ঠাণ্ডা মাথায় কত একা একা লড়াইয়ের গল্প তার। অথচ বিদায়টা নিলেন ফেসবুকের পাতায় ঘোষণা দিয়ে। এ কারণেই প্রশ্ন ঘুরছে সব দিকে। কিন্তু কোথাও কোনো উত্তর নেই।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের অর্জন ও কীর্তির শেষ নেই। মাহমুদউল্লাহ দলের দুঃসময়ে কাব্যিক সব ইনিংস খেলেছেন। দেশের মানুষকে আনন্দ উপহার দিয়েছেন নীরবে। আর বরাবরই আড়ালে-আবডালে থাকা এক চরিত্র তিনি। ঠাণ্ডা মাথার মানুষ হিসেবে সব সময়ই প্রশংসা পেয়েছেন। বয়সের মধ্যভাগে এসে সেঞ্চুরি উপহার দেওয়ার আনন্দময় কীর্তিও তার। ২০০৭ সালের ২৫ জুলাই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন মাহমুদউল্লাহ। দীর্ঘ ১৮ বছরের ক্যারিয়ারে ২৩৯ ওয়ানডেতে রান করেছেন ৫,৬৮৯। ৩২ ফিফটির বিপরীতে করা ৪ সেঞ্চুরিই আইসিসির টুর্নামেন্টে। উইকেট পেয়েছেন ৮২টি। অন্যদিকে ১৪১টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে অংশ নিয়ে করেছেন ২,৪৪৪ রান। টি-টোয়েন্টি ম্যাচে কোনো সেঞ্চুরি না থাকলেও ফিফটি আছে মোট ৮টি। টি-টোয়েন্টিতে তার প্রাপ্ত উইকেট ৪১টি। টেস্ট ক্যারিয়ার তার শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালের ৯ জুলাই। ৫০টি টেস্ট ম্যাচে তার মোট রান ২,৯১৪। আর ৫ সেঞ্চুরির সঙ্গে রয়েছে ১৬টি ফিফটি। টেস্ট ম্যাচে প্রাপ্ত উইকেট ৪৩। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম সেঞ্চুরি করেছেন তিনিই। আবার পর পর দুই সেঞ্চুরি করার কৃতিত্বও তার। ২০২৩ সালে ওয়ান ডে বিশ্বকাপে দেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি বয়সে সেঞ্চুরি করার রেকর্ডও তার। আরও অনেক অনেক রেকর্ড রয়েছে তার। বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে সব সংস্করণ মিলিয়ে ৪৩০ ম্যাচ খেলেছেন মাহমুদউল্লাহ। ১১ হাজার ৪৭ রানের সঙ্গে নিয়েছেন ১৬৬ উইকেট। আবার আইসিসি টুর্নামেন্টে দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি, চারটি সেঞ্চুরিও এসেছে তার ব্যাট থেকে।

মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ দীর্ঘ সময় ধরে ক্রিকেট খেলেছেন। ধীরস্থিরভাবে খেলে আত্মনিবেদনের সুন্দর উদাহরণ রেখে গেছেন। ক্রিকেটের সঙ্গে তাদের ছিল এক আত্মিক সম্পর্ক। আর তাইতো দুজনই দেখিয়ে গেছেন তারকাজীবন কতটা সুন্দর, স্বচ্ছ, স্নিগ্ধ ও মুগ্ধময় হতে পারে। তারকাজীবন কতটা বিতর্কহীন থাকতে পারে। পেশাদারত্বে দুজনই ছিলেন উন্নত ও দীপ্তিময়। সব সময় বিতর্কের বাইরে থেকেছেন। নতুন প্রজন্মের জন্য অবশ্যই এ দুজন অনুসরণীয় চরিত্র। মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ নিঃসন্দেহে আমাদের ক্রিকেটের অমূল্য সম্পদ। এই সম্পদকে কাজে লাগাতে পারলে এ দেশের ক্রিকেট আরও লাভবান হবে।

জাহিদ রহমান : ক্রীড়া লেখক, গবেষক