আছিয়া হোক লড়াইয়ের মশাল
আছিয়ার মৃত্যু হলো। তাকে মেরে ফেলা হলো। খুব করে চাইছিলাম আছিয়া বেঁচে উঠুক। আইসিইউতে আছিয়ার বেঁচে থাকার প্রাণপণ চেষ্টাকেই মনে হচ্ছিল একটা লড়াই। আমাদের সবার বেঁচে ওঠার একটা লড়াই। আট বছরের শিশুটির জীবনের প্রতি পক্ষপাত আর জীবনীশক্তি দেখে ডাক্তারও অবাক হয়েছিলেন । বলেছিলেন, ‘আছিয়া যে ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে তাতে সাধারণত তার তাৎক্ষণিক মৃত্যু হওয়ার কথা। মেয়েটার বেঁচে থাকাটাই আশ্চর্য।’ আছিয়ার বেঁচে থাকাটা ছিল আশ্চর্য। শুধু আছিয়া নয়, বাংলাদেশের নারীদের বেঁচে থাকাটাই আশ্চর্যের।
যে দেশে ধর্ষণ একটা উৎসব, যেখানে বুক ফুলিয়ে চলে ধর্ষক; আমরা তো এও জানি কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতারা ধর্ষণের শতসংখ্যা পূরণ করে উৎসব করে। গর্বভরে প্রচার করে তার একশ পূর্ণ হয়েছে। আমরা সে উৎসবের মাহাত্ম্যে দাঁত কেলিয়ে হাসি, পিঠ চাপড়ে বাহবা দিই। এরপর সে মহাপুরুষকে ফুলের মালা পরিয়ে মহান নেতা বানাই। কয়েকদিন আগেও তো দেখা গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানি করা হলো। তার পোশাক নিয়ে কথা বলা হলো। তারপর সেই ব্যক্তি কৃতকর্মের গৌরবে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে গলা ফাটিয়ে যৌন হয়রানির পক্ষে বক্তৃতা দিল। আর তাকে পাগড়ি, মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হলো। অথাৎ নারীকে নির্যাতন অথবা হয়রানি করলেই পাওয়া যাচ্ছে পুরস্কার আর সম্মান। তাই নির্যাতন আর ধর্ষণের উৎসবের রং আরও বর্ণিল আরও গাঢ় হচ্ছে, বিজয়ের মালা পরার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ধর্ষক আর নির্যাতক।
এমন একটা ঘুণে ধরা, পচে যাওয়া, ক্ষয়ে যাওয়া মূল্যবোধ আর বিকৃত মানসিকতার সমাজে নারীর বেঁচে থাকাটা সত্যিই অলৌকিক। নারী নির্যাতনের ভয়াবহ পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেও যারা এখনও বেঁচে আছে তাদের পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্যতম জীব হিসেবে বিবেচনা করা যায়। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩৯ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২১টি এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ১৮ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৭টি, এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৭টি, ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা দুটি । ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের শিকার ৫৭ জনের মধ্যে ১৬ জন শিশু, ১৭ জন কিশোরী এবং পাঁচজন প্রতিবন্ধী। অন্যদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে তিনজন কিশোরী ও ১৪ জন নারী; ধর্ষণের পর হত্যার শিকার দুজন নারী। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা ১৯টি, যৌন হয়রানি ২৬টি, শারীরিক নির্যাতনের ৩৬টি ঘটনা ঘটেছে এই মাসে।
অর্থাৎ নারী, কিশোরী, শিশু কেউ এখানে নিরাপদ নয়। শিশুরা বরং সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে রয়েছে। নানা রকম বির্তক দেখি, নানা রকম যুক্তি দাঁড় করানো হয়; বলা হয়, নারীকে ধর্ষণের জন্য নাকি নারীই দায়ী। সে নাকি এমন কিছু করে যাতে পুরুষ উত্তেজিত ও উত্থিত হয়ে পড়ে। নারী নাকি এমনই এক লোভনীয় বস্তু? তাকে দেখলেই লোভের লালা ঝরে। হাস্যকর, বিভ্রান্তিমূলক এসব যুক্তি দাঁড় করানো যায় নারীর বিরুদ্ধে। আছিয়াই তো প্রথম নয়। ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর খেলতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল পাঁচ বছরের শিশু পূজা দাস। এরপর তাকে পাওয়া গিয়েছিল ধর্ষিত রূপে। তার যৌনাঙ্গ কেটে ধর্ষণ করা হয়েছিল। পুরান ঢাকার গে-ারিয়ার তিন বছরের শিশু আশামণির মৃত্যু হয়েছিল ধর্ষণে। কোর্ট প্রাঙ্গণে শিশু ধর্ষণের ঘটনা সারাদেশে ঝড় তুলেছিল।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
শিশু ধর্ষণের এমনই আরও বহু লোমহর্ষক, বীভৎস ও বিকৃত ঘটনার সাক্ষী আমরা। কিন্তু প্রতিকার কি হয়েছে? সারাদেশে গত কয়েকদিন ধরে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে ঝড় উঠেছে। মানুষের মনে ঘৃণার তুফান বইছে। ধর্ষকের ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার হয়েছে জনতা। কিন্তু এরপর কী? কী হবে? সেই পূজা দাসের ঘটনার আসামি কি শাস্তি পেয়েছে? পায়নি, বরং সে নাকি জামিনে মুক্তি পেয়েছে। এই যে এত ধর্ষণ, হত্যা, নির্যাতনের ঘটনা, কয়টির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে? মূল আসামিও কি সব সময় ধরা পড়েছে? নাকি ডামি আসামিকে নিয়েই লোকদেখানো খেলাধুলা হয়েছে? এসব মৃত্যু আর ধর্ষণের খবর এা নৈমিত্তিক যে এগুলো নিয়ে শুধু তামাশাই করা যায়, বিচার নামক প্রহসনই করা যায়, আর কিছু নয়। প্রকৃত বিচার নামক কিছুই নেই। সে রকম কিছু থাকলে, ধর্ষকদের শাস্তি হলে, সেই শতসংখ্যা পূর্তির গৌরবের বিচার হলে এত ধর্ষণ, মৃত্যু, শিশু নির্যাতন কি থাকত? সমাজ, দেশ কি এমন শ্বাপদ, হন্তারক, ধর্ষক হয়ে উঠত?
সামাজিক মাধ্যমে আছিয়ার ওপর অসংখ্য পোস্ট দেখেছি, কোনোটিতেই মন্তব্য করিনি, নিজেও পোস্ট দিইনি। শুধু প্রার্থনা করেছি আছিয়া বেঁচে উঠুক। বারবার মনে হয়ছে, এই যে আড়াই দশক ধরে আমি জেন্ডার ইস্যু নিয়ে লিখছি, অসংখ্য কলামে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়েছি, কী হয়েছে ফল? কিছুই না; যেখানে একটা নিষ্পাপ শিশুও রক্ষা পায় না হিংস্র লোলুপ সমাজ থেকে, ধর্ষকের কিছুই হয় না, ধর্ষিতাকে মুখ লুকিয়ে চলতে হয়।
বারবার চেয়েছি বেঁচে থাকুক মেয়েটা। বেঁচে থাকাটাই তার প্রতিবাদ। আছিয়া বেঁচে থাকলেও হয়তো তার কিছু সমস্যা হতে পারত। মেয়েটার মাতৃত্ব নষ্ট হয়ে যেত পারত, পঙ্গু হতে পারত। হয়তো আরও অনেক কিছুই হতে পারত। ভেবেছি, যা কিছু হোক তবু বাঁচুক। বাঁচুক মেয়েরা। মেয়েদের বেঁচে থাকাটাই এখন প্রতিবাদ, বেঁচে থাকাটাই লড়াই।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
আছিয়ার হত্যাকারী ধর্ষকের ফাঁসি চাই আমরা। দোষী সব ব্যক্তির ফাঁসি চাই। আছিয়ার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু মৃত্যু ঘটেনি তার বেঁচে থাকার লড়াইয়ের। আছিয়া এখন বেঁচে থাকার লড়াইয়ের মশাল। বিচার হবে কি হবে না, আমরা জানি না। তবে আমরা অগণিত অসংখ্য নারী মাথা তুলে বাঁচব, লড়াই করব আর পায়ে পায়ে নিজেরাই পিষে দেব উত্থিত পিশাচ পুরুষকে।
নূর কামরুন নাহার : কবি ও কথাসাহিত্যিক এবং কলাম লেখক
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!