নীরব থেকে উপভোগ আর কতদিন?
গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা
মাঝখানে কিছুদিন বন্ধ থাকার পর ইদানীং আবার দেশের বিভিন্ন জায়গায় নানা কারণে গণপিটুনির ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে, অনেকে তাতে মারাও যাচ্ছে। গত ছয় মাসে গণপিটুনিতে হত্যার সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় চার গুণ বেড়েছে। জানা যায়, গত বছরের অক্টোবরে গণপিটুনিতে মারা গেছে ১৯ জন, নভেম্বরে ১৪ জন ও ডিসেম্বরে ১৪ জন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে গণপিটুনিতে নিহত হয় ১৬ জন।
গণপিটুনির এমন নানা ঘটনা নিয়ে মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে বিগত সময়ে এবং বর্তমানেও নানা লেখালেখি, আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। মব লিঞ্চিং বা গণপিটুনির এক-একটা ঘটনা ঘটে, গণমাধ্যমগুলো আবেগনির্ভর খবরে ও লেখায় ভরে ওঠে। এর কিছুদিন পর আমরা আবার সব ভুলেও যাই। এরপর আবার এমন একটা খবর এলে, পত্রিকার পাতাজুড়ে যখন সেই ঘটনা আমরা দেখি তখন আবার সরব হই, আবেগ উথলে ওঠে, ধীরে ধীরে আবার আগের মতো ভুলেও যাই। এভাবেই চলছে।
গণপিটুনি বা মব সৃষ্টি করে হেনস্তা, আহত বা নিহত হওয়ার ঘটনা যখন শুনি তখন নিজেকে ‘মানুষ’ হিসেবে ভাবতে গ্লানিবোধ করি। এজাতীয় অমানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় নিয়ে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে গভীরভাবে চিন্তা করার সময় এসেছেÑ আমাদের সমাজের চারদিকে আসলে হচ্ছেটা কী? এভাবে কোথায় চলেছি আমরা? কেন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের যেদিকে তাকাই সেদিকেই শূন্যতা, নীতিহীন আদর্শ আর কদর্য চরিত্রহীনতার দৃষ্টান্ত?
প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ডাকাতি, কিশোর অপরাধ, মব লিঞ্চিং, গণপিটুনি ও নারী নির্যাতনের বিভিন্ন ন্যক্কারজনক ঘটনা-পরবর্তী সময়ে কিছু ক্ষেত্রে অনেককেই বলতে শোনা যায়, যেভাবে ঘটনার ব্যাপকতা প্রকাশ করা হয়েছে, আসলে ঘটনা এত বড় নয়! তাহলে প্রশ্ন এসে যায়, কী হলে আমরা ধরে নেব, ঘটনার ব্যাপকতা অনেক বেশি?
গণপিটুনি বা মব লিঞ্চিং-জাতীয় ঘটনা বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্ত হলেও তার কারণ অনেক গভীর। প্রথমেই বলে রাখা ভালো, এই উন্মত্ত জনবিচার (মব জাস্টিস) একটি জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত ও সামাজিক সমস্যা।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
‘বিচারবহির্ভূত’ বা ‘গণপিটুনি’তে মানুষ হত্যা নিয়ে বিগত এবং বর্তমান সময়েও কিছু সাধারণ মানুষ বেজায় খুশি! অনেক সাধারণ নাগরিককে বলতে শুনেছি, ‘ঠিকই আছে, কিছু ভুল হলেও এভাবে না মারলে (!) দেখা যাবে, দুই দিন পরে তারা (যদি ‘অপরাধী’ হয়ে থাকে) আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে এসে আবারও অপরাধজগতে মিশে গেছে।’ কথাটি হয়তো ভুল নয়। কিন্তু অপরাধীরা এত সব হত্যা, খুন, ডাকাতি, ধর্ষণসহ নানা অপরাধ করেও এত দ্রুত আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসে কীভাবে? বিচার প্রলম্বিত হয় কেন? এসবের সোজা উত্তর হচ্ছেÑ এমন বেশির ভাগ মামলাই ঠিকভাবে সাজানো হয় না, সাক্ষীর অভাব, সাক্ষী ও অভিযোগকারীর নিরাপত্তার অভাব, আইনের বিভিন্ন অসংগতি ইত্যাদি। অর্থাৎ সুশাসন ও জবাবদিহিতার অভাব। দেশে সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে থাকতে বাধ্য।
মাঝে মাঝে ভাবতে অবাক লাগে, এই যে আমাদের এত চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও বিভিন্ন ডিগ্রিধারীর সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু কেন আমাদের মূল্যবোধের সংকট, আদর্শের অনটন, সৃজনশীলতা আর সংবেদনশীলতার অভাব; কেন আমরা প্রকৃত ‘মানুষ’ হতে পারছি না? আমার মনে হয়, আমরা আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রাণী সম্পর্কে যতটা রচনা শেখাই, তাতে আমরা এসব প্রাণীর আকৃতি, প্রকৃতি ও আচরণ সম্পর্কে জেনে বড় হই, কিন্তু ‘মানুষ’ আর ‘মানবিকতা’ আমাদের কাছে অজানাই রয়ে যায়। যে কোনো সমাজে মানবিক সংস্কৃতির বাতাবরণ তৈরি হয় যথাযথ শিক্ষার মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার আধার সংস্কৃতির উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে।
অনেকেই মনে করেন, সম্মিলিত মানুষ কোনো অন্যায় কাজ করতে পারে না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সমাজ গঠিত হয়েছিল মানুষের প্রয়োজনে, মানুষের চাহিদায়। কিন্তু এই সমাজের হাত যত শক্ত হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তি মানুষ ততই দুর্বল হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে খর্ব হয়েছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যও। সমাজের যৌথ শক্তি একদিকে যেমন দুর্বল, অক্ষম মানুষকে রক্ষা করে আবার অন্যদিকে সমাজের চোখে অপরাধী, ক্ষতিকর মানুষকেও মাঝে মাঝে করে তোলে প্রবল অত্যাচারী।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গণপিটুনির শিকার হয় দুর্বল, অসহায় মানুষ। বড় বড় অপরাধী সমাজে দিব্যি ঘুরে বেড়ালেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছোটখাটো কারণে গণপিটুনির ঘটনাগুলো ঘটে। চোর-ডাকাত সন্দেহে, ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মৃত্যুর খবর সংবাদপত্রগুলোতে চোখ রাখলেই দেখা যায়। এ খবরগুলো এখন এতটাই গা-সওয়া হয়ে গেছে যে, এই মৃত্যুগুলো আমাদের অনেককেই আর আলাদাভাবে ভাবায় না। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এই নিহত মানুষগুলোর মধ্যে খুব কমসংখ্যক মানুষ অপরাধকর্মের সঙ্গে জড়িত, অনেকেই হয়তো নিরপরাধ।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
গণপিটুনির নেপথ্যে প্রধান যে বিষয়গুলো কাজ করে তা হলো গুজব ও কুসংস্কার। গুজব ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি করে এবং সেই আতঙ্ক থেকেই গণপিটুনির ঘটনাগুলো ঘটে। ছেলেধরা গুজবে বহু মানুষের প্রাণ গেছে। শিশুদের স্কুলের পাশে অজ্ঞাতপরিচয় কোনো ব্যক্তিকে ঘোরাফেরা করতে দেখলেই অনেকের মনেই সন্দেহের বীজ বাসা বাঁধে। আর সেই মানুষটির কথাবার্তা কিছুটা অসংলগ্ন বলে মনে হলে তো জনতা ধরেই নেয় যে, মানুষটি সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর এবং তার সমুচিত শাস্তি পাওয়া উচিত। তাই অনেক সময়ই এমন ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধভাবে কিছু লোকের উসকানিতে জনগণ সম্মিলিতভাবে নিজের হাতে আইন তুলে নেয় এবং অবলীলায় পিটিয়ে হত্যা করে। বর্তমানে আবার যুক্ত হয়েছে ধর্ম রক্ষার জন্য মব লিঞ্চিং। দুঃখজনক হলেও সত্য, এগুলোর মধ্যে কোনো ক্ষেত্রেই বিচার হয়নি বা সম্মিলিত হত্যাকারীরা কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়নি।
গণপিটুনি বা মব লিঞ্চিংয়ের শিকার হচ্ছে যে মানুষগুলো, তারা কোনো অপরাধ করে থাকতেই পারে, কিন্তু তাই বলে তাদের বিচারের অধিকার জনগণের নেই। যে কোনো অপরাধের জন্য পুলিশ প্রশাসন আছে, আইন আছে। সন্দেহজনক কোনো ব্যক্তিকে ঘোরাফেরা করতে দেখলে বা তার কথাবার্তা সন্দেহজনক মনে হলে তাকে অবিলম্বে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। কিন্তু তা না করে কিছু মানুষের নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়া পরোক্ষভাবে দেশের আইন ও শাসনব্যবস্থার প্রতি এক তীব্র হুমকি ও প্রবল অমর্যাদা প্রদর্শন, যা কখনও কাম্য হতে পারে না।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, সমাজ এমন হিংস্র ও নির্মম হয়ে উঠছে কেন? কেন সম্মিলিত মানুষ যে কোনো কারণেই হোক অন্য একটি মানুষকে বেঁধে পিটিয়ে মারছে? এর নেপথ্যে মানুষের কী মনস্তত্ত্ব কাজ করছে? সমাজের এই মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ মানুষই নানাভাবে অসুখী। পুঁজিবাদী ও ভোগবাদী সমাজব্যবস্থা মানুষকে গ্রাস করেছে প্রবলভাবে। নানাভাবে বিভাজিত সমাজের নানা স্তরের মানুষের মনে কাজ করে চলেছে বিভিন্ন কারণে হতাশা, ক্ষোভ, ঘৃণা ও অপ্রাপ্তি। আর সেই অপ্রাপ্তি ও হতাশা থেকে যখন একটি মানুষকে সামনে পাচ্ছে তখন মনের মধ্যে জমে থাকা যাবতীয় ক্ষোভ, ঘৃণা উগরে দিচ্ছে তার ওপরই। আমাদের বুঝতে হবে, কেউ একজন কাউকে মেরে হত্যা করলে তা যেমন ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত, ঠিক তেমনি অনেকে মিলে পিটিয়ে মারলেও তা হত্যা এবং অবশ্যই ফৌজদারি অপরাধ।
এটা সত্য যে, গুজব ছড়ানো বা গুজবে বিশ্বাস করার প্রবণতা মানুষের সহজাত। কিন্তু আমাদের সমাজে আগে যে গুজব ওই ঘটনার আশপাশে সীমাবদ্ধ থাকত, এখন সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে তা দ্রুত বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে, আর আমরাও ঘটনার পূর্বাপর না জেনে তাতে অংশগ্রহণ করছি। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গুজবের জেরে এমন হিংসাত্মক ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। তাই সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে আমাদের আরও সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। এমন কোনো ঘটনা যা সমাজে অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি করতে পারে, সে ক্ষেত্রে সত্যতা যাচাই করা সম্ভব না হলে সেই ঘটনা শেয়ার করা থেকে বিরত থাকাই সুনাগরিক হিসেবে আমাদের কর্তব্য। আর গণপিটুনিতে যুক্ত ও সমাজমাধ্যমে গুজব ছড়ানোয় জড়িতদের দ্রুত চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার ও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই। কঠোর আইনি ব্যবস্থা ও জনগণের সচেতনতাতেই কমতে পারে গুজব-দৈত্যের দাপট, গণপিটুনি ও মব লিঞ্চিং।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
সে যাই হোক, আমরা যদি আমাদের সমাজে গণপিটুনি বা মব লিঞ্চিং-জাতীয় যে কোনো অমানবিক ও বর্বর কার্যক্রম বন্ধ করতে চাই, তাহলে অবশ্যই আমাদের সরকার, সমাজবিদ ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে, এমন যে কোনো ঘটনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চিন্তার চেয়ে সমাজ ভাবনাকে প্রাধান্য দিতে হবে ও সামাজিক কাঠামোর ত্রুটি সারাতে হবে। এজাতীয় যে কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় অভিযোগ পাওয়া মাত্রই পুলিশ প্রশাসনকে ত্বরিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। আমরা আশাবাদী মানুষ। আমরা স্বপ্ন দেখি, আমাদের উদ্যমী তারুণ্য ও সমাজের সচেতন নাগরিকদের সম্মিলিত উদ্যোগে সমাজের এজাতীয় বর্বরতা ও নিপীড়নের হবে অবসান।
সফিক চৌধুরী : বিতার্কিক ও কলাম লেখক