নারী দিবসে নারী পেল কী?
সারাবিশে^ ৮ মার্চ নারী দিবস বেশ সমারোহে পালিত হয়। বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বহু বছর ধরে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নারী দিবস পালিত হয়। শুধু সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নয়, দেশের পোশাক বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলোও দিবসটিকে প্রাধান্য দিয়ে বেগুনি রঙের শাড়ি তৈরি ও বিক্রি করে, ফলে সেদিন উৎসবের আমেজ আসে। আমরা নারীরা নারী দিবসে বেগুনি রঙের শাড়ি পরাকে এই দিনে ইউনিফর্ম পরার মতো করে ফেলেছি যেন। অর্থাৎ নারী দিবস আমাদের দেশে শহুরে নারীদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। নিঃসন্দেহে শহরের শিক্ষিত নারীরা আজ পুরুষের চেয়ে কর্মক্ষেত্রে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। এ ক্ষেত্রে নারী মূলত কাজে লাগায় তার মেধা, পরিশ্রম ও কাজের প্রতি সততাকে। দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নারী কর্মীরা মেধার শীর্ষস্থানে আছেন।
নারী শীর্ষস্থানে থাকা বড় গৌরবের বিষয়। কারণ নারীর এই উত্থান এক দিনে হয়নি। অনেক সংগ্রাম, ত্যাগ, ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে নারী এসব পদে বসেছেন। প্রশ্ন হলোÑ ১. দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী যে নারী তাদের মধ্যে শহুরে নারীদের উত্থান কি সমগ্র বাংলাদেশের নারীদের উন্নত অবস্থানের চিত্র প্রকাশ করে? ২. উচ্চ পর্যায়ে অধিষ্ঠিত নারী কি ঘরে-বাইরে প্রাপ্য সম্মান পাচ্ছেন? ৩. নারী টপ পজিশনে থাকলেই কি তিনি ঘরে-বাইরে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছেন? ৪. টপ পজিশনের নারীর কি সব ক্ষেত্রে তার ন্যায্য মতামত ধরে রাখতে পারছেন? ৫. কর্মক্ষেত্রে উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত নারীকে ফেলে দেওয়ার কি অবিরাম চেষ্টা হচ্ছে না? ৬. নারীর উন্নতিতে কি অনেকের এখনও তির্যক কথা শুনতে হয় না?
ওপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর সবার জানা। নারী যত বড় পদেই থাকুন না কেন, আমাদের দেশে নারীকে হেয় করতে, তাদের মতামতকে অগ্রাহ্য করতে চান পুরুষরা। কিন্তু কেন? উত্তর খুব সহজ। পুরুষের পুরুষতান্ত্রিক মনমানসিকতা এ জন্য শতভাগ দায়ী। কিন্তু পুরুষ কি ভেবে দেখেন নাÑ নারীর জরায়ু থেকেই তো তাকে পৃথিবীতে আসতে হয়। তাহলে নারীকে অবজ্ঞা কেন? এর কারণ হলো সামাজিক। পুরুষ তো বোধ হওয়ার পর থেকেই দেখেন তার মা তার বাবার কথার বাণে জর্জরিত। বাংলাদেশে কয়টি পরিবারে মায়ের মতামতের দাম দেওয়া হয়? বাবার দ্বারা মাকে শারীরিক নির্যাতন তো এ সমাজে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। সুতরাং ঘরই ছেলের মাথায় ঢুকিয়ে দেয় নারীবিদ্বেষ।
নারীর প্রতি বিদ্বেষ দূর করার জন্য তাই টক শো, সেমিনার করে আজও লাভ হয়নি। তাই পুত্রসন্তানের মায়েরা এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে পারেন। অবাক লাগে যখন দেখি, একবিংশ শতাব্দীর মায়েরাও পুত্রকে নারীর প্রতি যখন সহমর্মী হতে না শিখিয়ে বরং উল্টো শিক্ষা দেন। এর কারণ মূলত নারীর মানসিক গঠন। যেহেতু তিনি তার বাবা-স্বামী দ্বারা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সেহেতু তিনিও হয়তো অবচেতন মনে চান তার পুত্র দ্বারা অন্য নারী একইভাবে নির্যাতিত হন। একইভাবে আমাদের স্কুল-কলেজেও শিক্ষার্থীদের নারীর প্রতি কীভাবে আচরণ করতে হবে, নারীর প্রতি যে কোনো বিদ্বেষ নিন্দনীয় এবং নারীকে যৌন হয়রানি যে শাস্তিযোগ্য অপরাধÑ তা বলা হয় না। শিক্ষার্থীরা বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে এসব জানতে পারে, কিন্তু ততদিনে নারীর প্রতি তাদের একপাক্ষিক ধারণা মাথায় গেঁথে যায়। আমাদের বুঝতে হবে, আজকালকার নারীরা পুরুষকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে না, তাদের ছাপিয়ে যেতে চায় নাÑ হতে চায় তাদের সহযোগী, সমকক্ষ। নারী চায় সম-অধিকার।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
২০২৫ সালের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হলো : অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়নÑ নারী ও কন্যার উন্নয়ন। বর্তমান সময়ের এই প্রতিপাদ্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ লক্ষ্যে পুরো সমাজকে তথা জনগণের ‘মাইন্ড সেটে’ বিষয়টি ঢোকাতে হবে। কন্যাসন্তানের মা-বাবাকে তার কন্যাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করলে শুধু হবে না, তাকে ছোট থেকে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। বলতে দ্বিধা নেই, নানা কারণেই আমাদের দেশের নারীরা তাদের অধিকার সম্পর্কে উদাসীন। মেধা থাকা সত্ত্বেও পারিপাশির্^কতা তাকে অধিকার আদায়ে বাধা দেয়। বাংলাদেশে কয়জন নারী তার অধিকার আদায়ে আদালতে যেতে চায় বলুন? নারী তার অধিকার চাইবে, এ বিষয়ে সমাজও কি প্রস্তুত? নারীর দরকার ক্ষমতায়ন। নারীর দরকার ডিসিশন প্রদান করার ক্ষমতা। নারীর দরকার কাজের স্বাধীনতা। নারীর দরকার কাজের পরিবেশ। নারীর দরকার চিন্তা করার মুক্ত পরিবেশ। শহুরে নারীদের শুধু নয়, দরকার গ্রামের অসংখ্য নারীর ক্ষমতায়ন। কোভিডের সময় নারীরা অনলাইনে বিজনেস করে ঘরে বসে অর্থ উপার্জন করেছেন, যা এককথায় ছিল নারীদের অসাধারণ উদ্যোগ। নারী চাইলে সব পারেÑ সে শহুরে ধনাঢ্য পরিবারের নারী হোক বা গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের নারী। নারীকে ঘরের মধ্যে বন্দি না করে তার মেধা অনুযায়ী কাজ দিয়ে তাকে ক্ষমতায়ন করতে হবে। নারীর মুক্তি মিলবে তার আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে।
আজকাল অনেক নারী ট্রেন, রিকশা বা অটোরিকশাও চালাচ্ছেন। এসব পেশায় নারীকে দেখতে অনেকের চোখ অভ্যস্ত ছিল না। ধীরে ধীরে আমাদের চোখ নারীর ভিন্ন ধরনের কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টিতে অভ্যস্ত হচ্ছে। নারী মা হতে পারে। যে নারী পৃথিবীতে মনুষ্য প্রজাতির ধারাবাহিকতা চলমান রাখছে, সে নাীর অসাধ্য কী? শুধু প্রয়োজন নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো। পরিবারের উচিত ঘরের নারীকে সম্মান দেওয়া। এতে তার ছেলেটিও অন্য নারীকে শ্রদ্ধা করতে শিখবে। পরিবারের উচিত কন্যাসন্তানকে সাহস জোগানো, আত্মনির্ভরশীল করে তোলা। সমাজ, রাষ্ট্রের তো এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব ব্যাপক। রাষ্ট্র পারে নারীকে বিকশিত করতে, প্রস্ফুটিত করতে; আবার অন্যদিকে পারে নারীর মেধাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে। নারীকে মাথায় রাখতে হবেÑ নারীর পথের কাঁটা কেউ উপড়ে ফেলবে না। নারীকেই তার কাজের মাধ্যমে ধৈর্য ধরে কাঁটা বিছানো পথকে মসৃণ করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। মনুষ্যসৃষ্ট ঝড়-যন্ত্রণাকে গায়ে লাগানো যাবে না একবিংশ শতাব্দীর নারীকে। তাকে থাকতে হবে লক্ষ্যে অবিচল। জীবন একটাই। তার নিজ জীবনকে সার্থক করতে হলে দৃঢ় মনোবলসহকারে এগিয়ে যেতে হবে। তা হলেই সে কাজে সফল হবে। নারী দিবসের গল্প কিন্তু তাই। আজ থেকে ১১৭ বছর আগে যে নারীর অধিকার রক্ষায়
এ দিবসের প্রচলন হয়েছিলÑ তা আজ সারাবিশে^র নারীরা এনজয় করছে। কিন্তু এ চলার পথ তো আরও দীর্ঘ, সেই সঙ্গে কণ্টকময় ভয় করলে চলবে না। এ যুগের নারীদের সব ভয়, শঙ্কা দূর করে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে এবং পরবর্তী প্রজন্মের নারীদের হাতে অধিকার প্রতিষ্ঠার মশাল তুলে দিতে হবে। একদিন সারাবিশে^ অবশ্যই নারীর সব চাওয়া-পাওয়া প্রতিষ্ঠিত হবে। তার জন্য আজকের কিছু মানুষের নারীর প্রতি ভ্রুকুটিকে পাত্তা দিলে চলবে কি? চলবে না। তখনই হবে ৮ মার্চ নারী দিবসের সার্থকতা। নারী দিবসে সব নারীকে শুভেচ্ছা।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
মৌলি আজাদ : লেখক ও প্রাবন্ধিক