ট্রাম্প এবং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক পুনঃপর্যালোচনা
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বর্তমানে এক অস্থির পর্যায়ে প্রবেশ করেছে, যা কূটনৈতিক টানাপড়েন ও পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক বয়ানের দ্বারা চিহ্নিত। সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে শত্রুতামূলক মনোভাবের জন্য সমালোচনা করেছেন, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে আরও উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে, ঢাকা সরকারের বর্ণনা ও কথিত সন্ত্রাসবাদের স্বাভাবিকীকরণ নিয়ে জয়শঙ্কর উদ্বেগ প্রকাশ করছেন যে, শেখ হাসিনার বিদায়ের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির দিক পরিবর্তন সম্পর্কে নয়াদিল্লি ক্রমেই উদ্বিগ্ন। অন্যদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন এই দাবির বিরোধিতা করে পারস্পরিক সম্মান ও সমতার ভিত্তিতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে চলমান পানিবণ্টন, সীমান্ত নিরাপত্তা ও সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতিসংক্রান্ত বিরোধ দ্বিপাক্ষিক কূটনীতিকে জটিল করে তুলেছে। ঢাকার পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং ভারতের কৌশলগত পুনর্বিন্যাসের ফলে একটি অনিশ্চিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যা উভয় দেশের জন্য তাদের অগ্রাধিকার পুনর্মূল্যায়ন করা অপরিহার্য করে তুলেছে। যখন আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তখন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান দূরত্ব নতুন সংলাপ ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তাকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে, যাতে তাদের ঐতিহাসিকভাবে আন্তঃসংযুক্ত সম্পর্কের জটিলতাগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা যায়।
শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের নেতৃত্ব ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের প্রচলিত ভারসাম্যকে বজায় রেখেছিল, তবে তার বিদায়ের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ভারতের প্রতি বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে। এই রূপান্তর শুধু নয়াদিল্লির ওপর বাংলাদেশের প্রভাব হ্রাস করেনি, বরং দীর্ঘদিন ধরে জনমনে লালিত ভারতবিরোধী মনোভাবকে আরও উসকে দিয়েছে, যা পানিবণ্টন, সীমান্ত নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগসহ দীর্ঘস্থায়ী বিরোধগুলোর মাধ্যমে আরও তীব্র হয়েছে। উপরন্তু সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো একতরফা নীতির কারণে বাংলাদেশের অসন্তোষ বৃদ্ধি পেয়েছে। নয়াদিল্লি তার কর্মকাণ্ডকে জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থের ভিত্তিতে ন্যায্যতা দিতে চাইলেও ঢাকা এগুলোকে তার সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থের প্রতি উপেক্ষা হিসেবে দেখে।
এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প-মোদির মধ্যে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বৈঠক আরও একটি জটিল মাত্রা যুক্ত করেছে, যা ভারতের কৌশলগত উচ্চাকাক্সক্ষাকে জোরদার করেছে এবং ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বর্তমান গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, উভয় দেশের মধ্যে উত্তেজনা ব্যবস্থাপনা এবং একটি সহযোগিতামূলক কাঠামো গঠনের সক্ষমতা নির্ধারণ করবে দক্ষিণ এশিয়ার পরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ গতিপথ।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক বৈঠক বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের প্রতি নতুন করে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনকে তুলে ধরেছে। যদিও এই বৈঠকটি মূলত যুক্তরাষ্ট্র-ভারত কৌশলগত সহযোগিতার ওপর কেন্দ্রীভূত ছিল, এর প্রভাব দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গণ্ডির বাইরেও বিস্তৃত এবং বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, সীমান্ত উত্তেজনা এবং অর্থনৈতিক বিবেচনার কারণে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্কের গতিশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, যা ভারতের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির পরিবর্তনের ফলে আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
শেখ হাসিনা অপসারণের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ভারতের প্রধান মিত্র হিসেবে পরিচিত হাসিনার বিদায়ে দিল্লির জন্য একটি বড় ধাক্কা এসেছে, কারণ ভারত তার সরকারকে সমর্থন করেছিল, যদিও তার বিরুদ্ধে স্বৈরতন্ত্র ও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। নোবেল বিজয়ী এবং অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে। হাসিনার মতো নয়, যিনি দিল্লির ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন, ইউনূস দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে ‘পুনর্বিবেচনা’ করার ডাক দিয়েছেন, যা ভারতের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে, কারণ এটি ঢাকায় ভারতের প্রভাব কমার আশঙ্কা তৈরি করছে। এই পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে ভারতের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে অনেকে অভিযোগ করছেন যে, ভারত অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে এবং জলবণ্টন ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে ভুল পদক্ষেপ নিচ্ছে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
জলবণ্টন সমস্যা, বিশেষ করে তিস্তা নদী নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মতবিরোধ চলেছে। বহু বছর আলোচনার পরও একটি ন্যায়সঙ্গত চুক্তি সম্ভব হয়নি। কৃষি ও জীবিকার জন্য আন্তঃসীমান্ত নদীর ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে ভারতের একতরফা পানি ব্যবস্থাপনা নীতির সমালোচনা করে আসছে, যা বন্যা ও পানির ঘাটতিকে আরও তীব্রতর করে তোলে। ভারতের অরুণাচল প্রদেশসহ বিভিন্ন স্থানে বিশাল জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশের উদ্বেগ আরও বেড়েছে। যৌথ নদী কমিশন একটি কার্যকর সমাধান বের করতে ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সালিশির কথা বিবেচনা করছে, যা সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটাতে পারে।
সীমান্তসংক্রান্ত মতবিরোধ সম্পর্কের আরেকটি প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে ভারতের একতরফা কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়ে। বাংলাদেশ এই পদক্ষেপকে তার সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন এবং পূর্ববর্তী চুক্তির লঙ্ঘন হিসেবে দেখছে, যার মধ্যে ১৯৭৫ সালের সমঝোতা স্মারক উল্লেখযোগ্য, যা উভয় পক্ষের সম্মতি ছাড়া সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে এমন নির্মাণ নিষিদ্ধ করেছে। ভারত এটি নিরাপত্তা ও চোরাচালান প্রতিরোধের যুক্তিতে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু বাংলাদেশ মনে করে এটি ভারতের আক্রমণাত্মক ভূখণ্ড নীতির প্রতিফলন। সীমান্তে সংঘর্ষ ও সহিংসতা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এবং কূটনৈতিক সম্পর্কে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগ ভারতে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ভারতীয় ডানপন্থি গোষ্ঠী এবং গণমাধ্যম এই ঘটনাগুলোর জন্য বাংলাদেশ সরকারকে দায়ী করছে, যা ভারতীয় শহরগুলোতে বাংলাদেশি কূটনৈতিক মিশনের ওপর আক্রমণের দিকে নিয়ে গেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দাবি করছে যে, এই ঘটনা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত এবং শেখ হাসিনার অপসারণের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই বৈপরীত্যপূর্ণ বর্ণনা দুই দেশের মধ্যে জাতীয়তাবাদী উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছে এবং সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আরও জটিলতা তৈরি করেছে। ভারতের বিজেপি সরকার এই ইস্যুকে ব্যবহার করে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে, যা ঢাকায় আরও অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে।
অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কও উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ কয়েক বিলিয়ন ডলার হলেও সাম্প্রতিক বিরোধগুলো অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশ বিশেষভাবে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের নীতির বিরুদ্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও চলমান মতবিরোধের কারণে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও সরবরাহ শৃঙ্খল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। উভয় দেশের জন্যই অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে চলমান দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার পথে বাধা সৃষ্টি করছে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
ট্রাম্প-মোদি বৈঠক এই জটিল পরিস্থিতিতে আরেকটি মাত্রা যোগ করেছে, যা ভারতের বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষাকে তুলে ধরছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান কৌশলগত অংশীদারত্ব দিল্লির অবস্থানকে শক্তিশালী করলেও এটি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা তৈরি করেছে। যদি ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে কূটনৈতিকভাবে আরও সংবেদনশীল পন্থা অবলম্বন না করে, তা হলে বাংলাদেশ বিকল্প আঞ্চলিক অংশীদার খোঁজার দিকে ধাবিত হতে পারে, যা দিল্লির প্রভাব কমিয়ে দিতে পারে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির বৃহত্তর পরিবর্তনের প্রতিফলন, যেখানে ঐতিহাসিক মিত্রতাগুলো নতুন রাজনৈতিক ও কৌশলগত বাস্তবতার আলোকে পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে। ট্রাম্প-মোদি বৈঠক দেখিয়ে দিয়েছে যে, বিশ্ব কৌশলগত ভারসাম্য পরিবর্তিত হলেও আঞ্চলিক সম্পর্কই বিদেশ নীতির ভিত্তি তৈরি করে। ভারতের জন্য, বৈশ্বিক অবস্থান শক্তিশালী করার পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে স্থিতিশীল সম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শেখ হাসিনার বিদায় আগস্ট মাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন করেছে। এক সময় ভারত দ্বারা সমর্থিত হলেও দুর্নীতি ও স্বৈরাচারের অভিযোগের মুখে তিনি দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন। বাংলাদেশের বিরোধী দল এখন তার প্রত্যর্পণের দাবি জানাচ্ছে এবং তার শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলছে। ভারতের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ, জলবণ্টন সমস্যা এবং সীমান্ত নিয়ে অসন্তোষ বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব আরও তীব্র হয়েছে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে রাজনৈতিক পরিবর্তন ও অনিষ্পন্ন দ্বিপাক্ষিক বিরোধ পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। বাংলাদেশকে কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রেখেই তার স্বার্থ রক্ষা করতে হবে, আর ভারতকে বুঝতে হবে যে একটি স্থিতিশীল ও সহযোগিতামূলক প্রতিবেশী কতটা গুরুত্বপূর্ণ। স্বচ্ছতা, সংলাপ ও ন্যায্য চুক্তির মাধ্যমে বর্তমান উত্তেজনা দূর করে একটি টেকসই অংশীদারত্ব গড়ে তোলার জন্য উভয় দেশকেই কৌশলগতভাবে এগোতে হবে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
সাইমন মোহসিন : রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক