একাত্তরের যুদ্ধে ভিতর-বাহির
একাত্তরের যুদ্ধে ঘরে-বাইরে বহু ধরনের শত্রু কর্মরত ছিল। পাকিস্তানিরা ছিল, রাজাকাররা ছিল, ছিল অবাঙালিরা। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে গেছেন এমন বাঙালিরাও বাঙালিদের হাতেই বিপদে পড়েছেন। প্রাণ হারানোর ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। বিদ্রোহী বেতারকর্মীরা শঙ্কার ভেতর থাকতেন পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসরদের বিশ্বাসযোগ্য আক্রমণের; তাদের একজনের অবয়বে বাঙালিত্বের ছাপ না থাকায় ভীষণ বিপদ ঘটেছিল। অন্যরা ছুটে এসে রক্ষা করেছেন, নইলে তিনি শহীদ হতেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার একেবারে প্রাথমিক স্তরে অত্যন্ত সাহসী ও সাহায্যকারী ভূমিকা পালন করেছিলেন মাহমুদ হোসেন। থাকতেন তিনি ইউরোপে, গানবাজনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, দেশপ্রেমিক অনুপ্রেরণায় চট্টগ্রামে চলে এসেছিলেন শিল্প-কারখানা গড়বেন বলে।
একাত্তরে ব্যবসা ভুলে যুক্ত হয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে তার যাতায়াত ছিল, সেই সূত্রে বেলাল মোহাম্মদদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। ছাব্বিশে মার্চ রাতে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের ঘোষণা শুনে স্থির থাকতে পারেননি, রাত ১০টায় চট্টগ্রাম বেতার ভবনে গিয়ে পিস্তলের মুখে প্রকৌশলীদের সহায়তা করতে বাধ্য করে ইংরেজি ভাষায় একটি বক্তব্য প্রচার করেন, তাতে বিশ্ববাসীকে ‘হ্যালো ম্যানকাইন্ড’ বলে সম্বোধন করে বাংলাদেশে কী ঘটছে তা জানিয়ে, বিশ্ববাসীর সাহায্য প্রার্থনা করা হয়। তার আরও আকাক্সক্ষা ছিল ভারতে গিয়ে পূর্বপরিচিতদের কাজে লাগিয়ে অস্ত্র নিয়ে আসবেন। সীমান্ত পার হতে গিয়ে ধরা পড়েন। না, পাকিস্তানিদের হাতে নয়; বাঙালিদের হাতেই। অবয়বের ত্রুটি এবং পকেটে বিদেশি মুদ্রা থাকার কারণে দুজন সহযোদ্ধাসহ প্রাণ হারান। তিনজনের লাশই নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
বিরোধ ছিল বাঙালিদের নিজেদের মধ্যেও। কলকাতায় থাকা অবস্থায় বেলাল মোহাম্মদ ভারতীয়দের মুখেই শুনেছেন যে, নেতারা সবাই যে মুজিবভক্ত নয় সেটা ভারতীয়রা বিলক্ষণ জানে। পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী এক মুসলমান ভদ্রলোক বেলাল মোহাম্মদকে জানিয়েছেন যে, আওয়ামী লীগের বড় এক নেতা নিজের জীবনী লেখানো নিয়ে বিশেষ রকমের তৎপর হয়ে পড়েছিলেন। ছোট ছোট ঘটনা, কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ। কলকাতার অবাঙালি মুসলমানরা জয় বাংলার লোকদের মোটেই পছন্দ করত না, তাদের কারও কারও আত্মীয়স্বজন ছিল পূর্ববঙ্গে; সুযোগ পেলেই তারা নানা অভিযোগ তুলে কটুকথা বলত। সাতচল্লিশের পরে যারা পূর্ববঙ্গ থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে সেই হিন্দু বাঙালিরাও ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করতে ছাড়ত না। এসব বিরূপতা উপেক্ষা করে বেতারকর্মীদের কাজ করতে হয়েছে। আগরতলায় থাকতে তৎাদের চলাফেরা ছিল সীমিত; তারা হিন্দু নাম গ্রহণ করেছিলেন। একসময় তাদের জন্য রান্নাবান্না করতেন যে মাসিমা, তিনি ছিলেন পূর্ববঙ্গ থেকে সাতচল্লিশে বিতাড়িত হিন্দু শরণার্থী। খাওয়ার সময় তার কাছে এক গ্লাস পানি চাইতে গিয়ে একজন বেতারকর্মী বিপদে পড়েছিলেন, সহকর্মীর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের সহায়তায় কোনোমতে মান-ইজ্জত বাঁচিয়েছেন।
ওদিকে যে লড়াইটার ভিত্তি ছিল ভাষাভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ, তার প্রচার-প্রচারণায় এবং ইশতেহারে আল্লাহর ওপর ভরসার কথা যে থাকত না এমন নয়। খুবই থাকত। কোনো কোনো ইশতেহার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পড়ে শোনানোও হয়েছে। উল্লেখ আছে বেলাল মোহাম্মদের বইয়ে। যেমন, আগরতলা থেকে এপ্রিল-মে মাসে প্রচারিত একটি ইশতেহার শুরু করা হয়েছিল এভাবে, ‘খোদা তায়ালার ইচ্ছায়, আমরা শেষ পর্যন্ত জয়ী হবই।’ ইশতেহারের ভেতরে বলা হয়েছে, ‘যতই দিন যাবে আমাদের মুক্তিবাহিনী ততই শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং অধিক সংখ্যায় পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করবে। আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে আমরা পাকিস্তানিদের পরাজিত করবই।’ পাকিস্তানি হানাদাররাও কিন্তু নিজেদের আল্লাওয়ালা বলে বড়াই করত। পরবর্তী একটি ইশতেহারেও একই ধরনের আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে, বলা হয়েছে যে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায় হচ্ছে, ‘পরম করুণাময় আল্লাহতালার সাহায্য, বাংলাদেশের জনসাধারণের মনোবল, মুক্তিলাভের দৃঢ় সংকল্প, শত্রু সংহারে অবিচল প্রতিজ্ঞা।’ শেষ করা হয়েছে এভাবে, ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার ওপর বিশ্বাস রেখে ন্যায়ের সংগ্রামে অবিচল থাকুন। স্মরণ করুন, আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন : অতীতের চাইতে ভবিষ্যৎ নিশ্চয়ই সুখকর। বিশ্বাস রাখুন : আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটবর্তী’। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানসূচির দিকে তাকালে দেখব সেখানে কোরআন ও তার অনুবাদ পাঠ ছিল প্রাত্যহিক অনুষ্ঠান; শনিবার ছাড়া প্রতিদিন প্রচারিত হতো ‘ইসলামের দৃষ্টিতে’ নামের একটি কথিকা এবং সপ্তাহে এক দিন করে থাকত গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিটক থেকে পাঠ।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
কলকাতায় গিয়ে বেলাল মোহাম্মদের বিশেষ আগ্রহ ছিল কমরেড মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে দেখা করার। মুজফ্ফর আহমদ তার এলাকারই লোক, সম্পর্কে আত্মীয়ও বটে, তবে তার মনে পড়েছে যে ছেলেবেলায় লোকে বলত যে মুজফ্ফর আহমদ একজন নাস্তিক। তিনি এটাও স্মরণ করেছেন যে ১৯৬৫-এর যুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে পুঁথিপাঠের ধরনে তিনি নিজের লেখা ভারতবিরোধী ‘খবর’ প্রচার করতেন। শুরুটা করতেন এভাবে, ‘আহা আল্লা-নবী কর মদদ/এখন খবর বলি, বেলাল মোহাম্মদ।’ তার সেই পুঁথিপাঠ অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।
ধর্মের সঙ্গে প্রচারকার্যকে মিশিয়ে ফেলাটা ১৯৬৫-তে স্বাভাবিক ছিল; ১৯৭১-এ যে সেই রীতি পরিত্যক্ত হয়েছিল তা বলা যাবে না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিদিনের অনুষ্ঠান শুরু করা হতো শ্রোতাদের সালাম জানিয়ে, শেষ করা হতো খোদা হাফেজ বলে। এ নিয়ে ভারতীয় পরামর্শক আরএন আচারিয়া মৃদু আপত্তি জানিয়েছিলেন। দেশ যখন স্বাধীন হলো তখন প্রথম কয়েকদিন ঢাকা থেকে প্রচারিত বেতারে ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করার রীতি একেবারেই বাদ দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু পরে আবার তা ফেরত এসেছে, যথারীতি।
একাত্তরের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কবি আবদুস সালাম ব্যাকুলভাবে ছুটে গিয়েছিলেন বেতারকর্মীদের খোঁজে, উদ্দেশ্য বেতারে ভাষণ পাঠ করা। ভাষণটিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল সোডার বোতল, মরিচের গুঁড়া, বিজলি বাতির বাল্ব, এ ধরনের ঘরোয়া অস্ত্র যার কাছে যা আছে তা নিয়ে শত্রু সেনাকে আক্রমণ করার। বিশেষ ভরসা হিসেবে তিনি উদ্ধৃত করেছেন কোরআনের বাণী।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
যে কেউ বলবেন যে একাত্তরের যুদ্ধের অনেক বৈশিষ্ট্যের ভেতর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল দুটি; স্বতঃস্ফূর্ততা এবং দুঃসাহসিকতা। এ দুটি গুণই দেখতে পাওয়া যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যারা গড়ে তুলেছিলেন সেই তরুণদের ভেতরে। তরুণরা দুঃসাহসী হয়, হতে পারে; তাদের ভেতর স্বতঃস্ফূর্ততাও থাকে। কিন্তু যে দশজন তরুণ একত্র হয়েছিলেন বেতারকেন্দ্রটি গড়ে তুলতে, তাদের স্বতঃস্ফূর্ততা ও দুঃসাহসের উৎস ছিল অভিন্ন, সেটা হলো দেশপ্রেম।
উদ্যোগটা প্রথমে নিয়েছিলেন তিনজন। পরস্পরের পরিচিত বন্ধুই বলা চলে, বেতারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনজনই; চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে। একাত্তরের ২৬ মার্চের বিধ্বস্ত ও ভয়ংকর সকালবেলায় তারা ভাবছিলেন কী করা যায়। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রকে ব্যবহার করে স্বাধীনতার কথা প্রচার করা যায় কিনাÑ এ চিন্তা তাদের মাথায় এসেছিল। কিন্তু কেন্দ্রটি শহরের একেবারে ভেতরে। পাকিস্তানি হানাদাররা সহজেই আক্রমণ করতে পারবে, এই বিবেচনা থেকে শহরের বাইরে কালুরঘাটে গিয়ে সেখানকার ট্রান্সমিটারটি ব্যবহার করবেন বলে ঠিক করেন। কাজটি মোটেই সহজ ছিল না। ছিল অত্যন্ত কঠিন ও ভয়ংকর দুঃসাহসিক। কী ঘটতে যাচ্ছে তা জানা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ তখন শুরুই হয়নি। কোথাও বিদ্রোহের কোনো ঘটনা ঘটেছিল বলে জানা ছিল না। সবটাই ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন ও বিভ্রান্তিকর। এরই ভেতর তারা নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, বেতারকেন্দ্র চালু করবেন। অন্য কয়েকজন এসে যোগ দিয়েছিলেন; কর্মীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল দশ। তবে তারা যে রাষ্ট্রদ্রোহের কাজ করতে যাচ্ছেন সেটা তারা জানতেন।
কী প্রচার করবেন সে বিষয়ে মোটেই পরিষ্কার ছিলেন না তারা। সবটাই ছিল অগোছালো। আসলে আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের গোটা ব্যাপারটাই ছিল অত্যন্ত অগোছালো। পূর্বপরিকল্পনা ছিল না, প্রস্তুতিও ছিল না। প্রতিরোধ যা ঘটেছে তার সবটাই স্বতঃস্ফূর্ত ও পরস্পরবিচ্ছিন্ন। লোকে ব্যারিকেড তৈরি করেছে, অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছে, ক্যান্টনমেন্ট কাছে থাকলে সেদিকে ছুটে গেছে, গ্রামের মানুষ শহরত্যাগী মানুষদের সাহায্য করেছে; এবং কেউই ভেবে পায়নি ঠিক কী করতে হবে। ব্যর্থতা ছিল নেতৃত্বের। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছ থেকে কোনো প্রকার কর্তব্যনির্দেশ ছিল না। স্থানীয় নেতারা ছিলেন বিভ্রান্ত, তারা অনেক কিছু করবেন ভেবেছেন; কিন্তু কীভাবে করবেন, কোনটা আগে কোনটা পরে, কাকে দিয়ে কোন কাজ হবেÑ এসব ঠিক করতে পারেননি। ৭ মার্চের পর থেকে বেতারের কর্মীরা ‘রেডিও পাকিস্তান’ নামটি ফেলে দিয়ে স্থানীয় বেতারকেন্দ্র বলে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছিলেন। নির্দেশ পেলে তারা হয়তো আরও এগোতেন; কিন্তু নির্দেশ আসেনি।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়