তরুণ খেলোয়াড় কোথায়
আসন্ন চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ
যত বেশি খেলার আয়োজন হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ততই বাড়বে। বাড়বে খেলোয়াড়দের উৎকর্ষ প্রদর্শনের পাশাপাশি নিজেদের তুলে ধরার সুযোগ। বিষয়টি শুধু খেলার চত্বরকে আকর্ষণীয় ও আবেদনময় করে না, নির্দিষ্ট খেলার মানোন্নয়নে কার্যকরী ভূমিকা পালনে সহায়ক হয়। খেলার আয়োজন বেশি হলে সেখান থেকে ভালো খেলোয়াড়ের সন্ধান নিয়মিতভাবে মেলে।
আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে প্রচলিত সব খেলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো নিয়মিতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক আয়োজন সম্ভব হয় না। এর পেছনে যুক্তিসংগত কারণও আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো খেলার সংস্থাগুলোর আর্থিক টানাপড়েন, খেলার আয়োজনের জন্য মাঠ ও কাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা অপ্রতুল এবং সম্মিলিতভাবে ঐকমত্যে পৌঁছে নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে উদ্যোগ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ইতিবাচক মানসিকতার অভাব। ক্রীড়াঙ্গনের সংস্কৃতিতে একটি বিষয় স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে সেটি হলোÑ ‘খেলা তো চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে’। এই আত্মতৃপ্তি ক্রীড়াঙ্গনকে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
সাম্প্রতিক সময়ের জরিপে উঠে এসেছে, দেশে প্রত্যেকটি প্রচলিত জনপ্রিয় খেলার বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন ভীষণভাবে কমে গেছে। জরিপে লক্ষ করেছি, দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। অথচ দেশজুড়ে জেলা পর্যায়ে গত ১০ বছরে সব জেলায় কোনো বছর ফুটবল লিগের আয়োজন হয়েছে এমনটি হয়নি। অথচ এখন থেকে পাঁচ দশকেরও বেশি আগে প্রতিটি জেলা ও মহকুমা শহরে নিয়মিত ফুটবলের আয়োজন হতো। এখন আর হয় না। দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ক্রীড়াঙ্গন ঘিরে সচেতনতার পাশাপাশি চিন্তার পরিধি বেড়েছে। এর পরও দেশজুড়ে বিভিন্ন খেলার প্রতিযোগিতামূলক আয়োজন কমে গেছে। এতে করে জাতীয় পর্যায়ের কথা বাদ দিলাম, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জেলা এবং তৃণমূলের বিভিন্ন খেলা। জেলা ও তৃণমূল পর্যায়ে খেলার আয়োজনে ভাটার টান মানেই জাতীয় পর্যায়ের ক্রীড়াঙ্গনের ভিত দুর্বল এবং নড়বড়ে হতে বাধ্য। আমরা ভুলে যাচ্ছি আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের আসল ভিত কোথায়। আমাদের আস্থা আসবে কোথা থেকে।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সিনিয়র সহসভাপতি মো. ইমরুল হাসানের নেতৃত্বে বাফুফের নতুন পেশাদার লিগ কমিটি আগামী মৌসুমে পাঁচটি প্রতিযোগিতা আয়োজনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে। এর আগে বাফুফের পেশাদার লিগ কমিটি কখনও তিনটির বেশি প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে পারেনি। ঐক্যবদ্ধ মত পোষণ এবং কমিটমেন্ট যে কোনো উদ্যোগ গ্রহণে সবচেয়ে বড় সহায়ক এটি তার প্রমাণ। নতুন লিগ কমিটির লক্ষ্য হলো অনেক সময় ধরে ফুটবলকে মাঠে ধরে রাখা, আবার দর্শকদের ফুটবল মাঠে ফিরিয়ে আনা। জানা গেছে, সব প্রতিযোগিতায় পৃষ্ঠপোষক হতে সম্মত বসুন্ধরা গ্রুপ। খেলার আয়োজনে বাণিজ্যিক পৃষ্ঠপোষকতার বিকল্প নেই।
ইতোমধ্যে চ্যালেঞ্জ কাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এক ম্যাচের প্রতিযোগিতায় মোহামেডান স্পোর্টিংকে পরাজিত করে বসুন্ধরা কিংস চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। চলছে প্রিমিয়ার লিগ এবং ফেডারেশন কাপের খেলাÑ ফিকচার অনুযায়ী। পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তরে চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ (বিসিএল) মাঠে গড়াবে ৪ মার্চ সবচেয়ে বেশি দল (১০টি) নিয়ে। দলগুলো হলো রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন (বিআরটিসি) ফুটবল ক্লাব, ওয়ারী ক্লাব, রেঞ্জার্স এফসি, উত্তর বারিধারা, পিডব্লিউডি, ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, সিটি ক্লাব, শিটল ফ্রেন্ডস ও বাফুফের এলিট একাডেমি। শেষ দিকে এসে নোফেন স্পোর্টিং ক্লাব নিজেদের স্বার্থে সরে গেছে এবার আয়োজন থেকে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
ইতোপূর্বে এই লিগের খেলা হয়েছে মাত্র একটি ভেন্যুতে। এবার ঢাকার মধ্যে চারটি (মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজের মাঠ, বেরাইদের ফর্টিস এফসির মাঠ, বসুন্ধরা কিংসের অনুশীলন মাঠ ও উত্তরায় আর্মড ফোর্সেস ব্যাটালিয়ন খেলার মাঠ) এবং ঢাকার বাইরে গাজীপুরে শহীদ বরকত উল্লা স্টেডিয়াম। লিগ কমিটি চাইছে খেলাগুলো সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের খেলোয়াড়দের দলবদলের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। যেটি লক্ষণীয় হয়েছে, বিভিন্ন জেলা এবং ফুটবল একাডেমি থেকে এবার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নতুন খেলোয়াড়কে লিগে বিভিন্ন দলের হয়ে খেলতে দেখা যাবে। এটি ইতিবাচক। খেলোয়াড় তো জš§গ্রহণ করে নাÑ সৃষ্টি করা হয়। ক্লাবগুলো বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি, বিশেষ করে আর্থিকভাবে ভালো অবস্থায় না থাকা সত্ত্বেও দল গঠনের ক্ষেত্রে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে। ফুটবল পুরোপুরি দলীয় খেলা। এখানে একটি দল হয়ে খেলতে হয়। আর তাই ভারসাম্যময় দলই সবার কাম্য। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ দলই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। তরুণ খেলোয়াড় কোথায়? জেলায় জেলায় ফুটবল লিগ তো অনুষ্ঠিত হয়নি। চ্যাম্পিয়নশিপের লিগে তো অন্যতম বড় ভরসা জেলার সম্ভাবনাময় তরুণ ফুটবলাররা।
কিছুদিন আগে কলেজে দেখেছি সাবেক ফুটবলার ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে জেলা ফুটবল লিগ কমিটির সভায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, জেলা ফুটবল লিগের আয়োজন এখন থেকে বাধ্যতামূলক। জেলা ফুটবল সংস্থা এই লিগের আয়োজন করবে। প্রাথমিকভাবে মাগুরা, নড়াইল, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, মাদারীপুর, ফরিদপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, দিনাজপুর ও সুনামগঞ্জÑ এই ১২টি জেলায় লিগ শুরুর প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। চলতি মৌসুমে হয়তো দেশের সব জেলায় লিগ অনুষ্ঠিত হতে পারবে না, এর কারণ হলো কয়েকটি জেলা নিষ্ক্রিয় থাকায় বাফুফে এসব জেলার ফুটবল কমিটি ভেঙে দিয়েছে।
আসন্ন চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে এবার করপোরেট দল বিআরটিসিকে খেলতে দেখা যাবে। এ ধরনের করপোরেট এবং সার্ভিসেস দলের ফুটবলে খুব বেশি দরকার আছে। অনেক বছর পর একসময়ের ভালো ফুটবল দল বিআরটিসি আবার ফুটবলের দ্বিতীয় মর্যাদাবান আসরে এলো, এর জন্য দলটিকে স্বাগত। চ্যাম্পিয়নশিপ লিগকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করা তখনই সম্ভব হবে যখন ক্লাবগুলো চিন্তাভাবনার মাধ্যমে নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে আসবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
যা হোক আবার ফুটবলের কর্মসূচিতে ফিরে আসি। স্বাধীনতা কাপের খেলা অনুষ্ঠিত হবে শুধু স্থানীয় খেলোয়াড়দের নিয়ে। লিগ শেষ হওয়ার পর তো বিদেশি খেলোয়াড়রা থাকবেন নাÑ তখন ক্লাবগুলোর জন্য শুধু স্থানীয় খেলোয়াড়দের নিয়ে প্রতিযোগিতা স্বাধীনতা কাপ। অনেক বছর পর আবার সুপার কাপের খেলা মাঠে আসবে। প্রাইজ মানি এক কোটি টাকার সঙ্গে অন্য কিছুও সংযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে এবার।
ইকরামউজ্জমান : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক; সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!