অসম্ভবের সম্ভবপর দেশ বলে কথা
১৯৮৮ সালের বন্যা-পরবর্তী শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের ফলে বুড়িগঙ্গার শাখা নদীটিকে বিনাশ বা হত্যা করা হয়েছে। গাবতলী থেকে বাবুবাজারের দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু পর্যন্ত বেড়িবাঁধ নির্মাণে বুড়িগঙ্গার শাখা নদীটি ওই অঞ্চলের পয়ঃনিষ্কাশন, বৃষ্টির পানি নির্গতের পথ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বাঁধ নির্মাণের পরপরই বেড়িবাঁধের উত্তর ও দক্ষিণের শাখা নদীর বিস্তীর্ণ জায়গায় মাটি ভরাট করে অবৈধ দখল এবং স্থাপনা নির্মাণের হিড়িক পড়ে যায়। ফলে সেখানে গড়ে উঠেছে বিশাল জনবসতি, ব্যক্তিগত শিল্প-কারখানা, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল এবং লালবাগ থানার নতুন ভবন, বিজিবির মার্কেটসহ অজস্র স্থাপনা। নদী কীভাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়ে পড়ে তার নজরকাড়া দৃষ্টান্ত বুড়িগঙ্গার শাখা নদীটি বিলীন হয়ে যাওয়া। অথচ এক সময় এই নদীর বুক চিড়ে শ্যামবাজার, বাদামতলী, সদরঘাট, চকবাজার, সোয়ারীঘাট থেকে পণ্যবাহী নৌকা চলাচল করত মিরপুর, গাবতলী, সাভার ও মানিকগঞ্জ পর্যন্ত। এখন তো ডিঙি নৌকা চলার পথও রুদ্ধ। কেবল কয়েক গজের সরু খালটি টিকে আছে অঞ্চলগুলোর ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে। নদীনির্ভর যাতায়াতের পুরো ব্যবস্থাটিরও পরিসমাপ্তি ঘটেছে।
অথচ এক সময়ে এই শাখা নদীটিকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে অবস্থিত আড়ত, পাইকারি বাজারের পণ্য পরিবহন হতো। বর্ষাকালে নদীটির প্রস্থ হয়ে যেত প্রায় দুই কিলোমিটার। সাঁতারকাটা, নৌভ্রমণ, নৌকাবাইচ ইত্যাদি ছিল জনজীবনের অনুষঙ্গ। অথচ বেড়িবাঁধ নির্মাণের পর সবই সোনালি অতীতে পরিণত। বর্তমানে শাখা নদীটি ময়লা, আবর্জনা, বৃষ্টির পানি বহনের বড় আয়তনের এক ড্রেন ভিন্ন অন্যকিছু নয়।
বুড়িগঙ্গা নদীর বুকে কামরাঙ্গীরচর ছিল এক বিস্ময়ের দ্বীপ, যার দক্ষিণে আদি বুড়িগঙ্গা আর উত্তরে বুড়িগঙ্গার শাখা নদী। এই শাখা নদীটি বর্ষা মৌসুমে আয়তনে আদি বুড়িগঙ্গা নদীর সমান হয়ে যেত। কামরাঙ্গীরচরের উত্তরের শাখা নদীটি নৌকায় পেরিয়ে পুরান ঢাকায় আসা-যাওয়ার একমাত্র ব্যবস্থা ছিল। আজকে যার কোনো অস্তিত্ব নেই। বেড়িবাঁধের দক্ষিণের সংকীর্ণ ছোট খালটির পর থেকে মাটি ভরাট করে শাখা নদীটি কামরাঙ্গীরচর পর্যন্ত অবিচ্ছেদ্য জনপদে পরিণত।
প্রতি শীত মৌসুমে শাখা নদীটির বুকে চর জেগে উঠত। পুরান ঢাকার নদীর তীর থেকে নৌকাযোগে বিশাল সেই চরে স্থানীয় কিশোর-যুবকরা খেলাধুলা করত। কামরাঙ্গীরচরের কৃষকরা জেগে ওঠা চরে পাট-ধানসহ রবিশস্য চাষাবাদ করত। বর্ষা মৌসুম না-আসা পর্যন্ত চরটি ফসল উৎপাদনে এবং খেলাধুলার মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এ যেন এক হারানো পৃথিবীর হারানো সময়ের স্মৃতি। সামরিক শাসক এরশাদের শাসনামলে নির্মিত এই বেড়িবাঁধ এবং ঢাকা শহরের অভ্যন্তরে অজস্র বুড়িগঙ্গার সংযোগ খাল ভরাট করে কালভার্টে রূপান্তরের ফলে ভারী বর্ষণে ঢাকা শহরের অনেক অঞ্চল পানিতে ডুবে যায়। প্রতি বর্ষা মৌসুমে আমরা তার কুফল ভোগ করছি।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
লালবাগ, হাজারীবাগ, রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুর, চকবাজার অঞ্চলের প্রতিটি গলিপথের দক্ষিণে শাখা নদীটির তীরে পাকা সরকারি সিঁড়িঘাট ছিল। আজ তার কোনো অস্তিত্বই নেই। সিঁড়িঘাট থেকে বেড়িবাঁধের উত্তরের সীমানা পর্যন্ত বেদখল হয়ে সেখানে বসতিসহ আড়ত, বাজার, কারখানা এমনকি হালে ছয়তলাবিশিষ্ট লালবাগ থানা এবং বিজিবি [সাবেক বিডিআর] কর্তৃক মার্কেট পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে। ক্ষমতাধরদের দৌরাত্ম্যের যেন সীমা-পরিসীমা নেই। বেড়িবাঁধের দক্ষিণের সরু পয়ঃনিষ্কাশনের ড্রেনটি পেরিয়ে দুই কিলোমিটারের শাখা নদীর বুকে মাটি ভরাট করে গড়ে উঠেছে শিল্প-কারখানা, পেট্রোল পাম্প, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালসহ বিশাল জনবসতি। আদি কামরাঙ্গীরচর পর্যন্ত বিস্তৃত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনাসহ জনবসতিসমূহ সম্পূর্ণ ব্যক্তিমালিকানাধীন।
আদি কামরাঙ্গীরচরের মানুষের জীবনযাপন ছিল সম্পূর্ণ গ্রামীণ। গাছগাছালিসমৃদ্ধ গ্রামীণ এই জনপদটি ছিল পুরান ঢাকাসংলগ্ন এক প্রান্তিক গ্রাম, কামরাঙ্গীরচরের মানুষের জীবিকা ছিল হাঁস, মুরগি, গবাদি পশুপালন, খেয়া পারাপারের পেশা, গরু পুষে দুধ বিক্রি, স্থানীয় বাজারগুলোতে তাদের উৎপাদিত শাকসবজি, তরকারি ইত্যাদি বেচাবিক্রি। সেই গ্রামীণ জনপদটি সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। বেড়িবাঁধের উত্তরের তীরবর্তী জমি যেমন অবৈধ দখলদারদের অধীনে চলে গেছে, তেমনি দক্ষিণে নদী ভরাট করে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ঘটেছে। শহীদনগর, ইসলামবাগ নামক অঞ্চলগুলো পর্যন্ত শাখা নদীটি ভরাট করে গড়ে উঠেছে।
অতীতে অজস্রবার নদী উদ্ধারে বিআইডব্লিউটিএ উদ্ধার তৎপরতা চালালেও সেটা যেমন তামাশাপূর্ণ ছিল, তেমনি উৎকোচ গ্রহণের অছিলায় ভিন্ন নদীর খাস জমি উদ্ধারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ ছিল না। কয়েক মাস আগে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পাওয়ার পর বেড়িবাঁধের দক্ষিণে ভারী যন্ত্র নিয়ে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছিল। ভাঙা হয়েছে ছয়তলাবিশিষ্ট ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা। নদী উদ্ধারকারী কর্তৃপক্ষ জানিয়ে গিয়েছিল সব অবৈধ স্থাপনা জমি উদ্ধারকাজ শুরু করবে। অতীতের অভিজ্ঞতায় স্থাপনার মালিকরা তাতে ভ্রƒক্ষেপ করেনি। যথারীতি উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়। ভাঙা হয়েছে অনেক স্থাপনা। অনেকে তাদের দলিল-দস্তাবেজ নিয়ে উপস্থিত হলেও, তাদের নিস্তার ঘটেনি। বেড়িবাঁধ নির্মিত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। অথচ ৩৪ বছরের পূর্বেকার দলিল-দস্তাবেজ অনেকে দেখালেও উদ্ধার তৎপরতায় যুক্তরা সেটা উপেক্ষা করে। গত ৩৪ বছরে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন সংস্থার অসাধু চক্রের সাহায্যে দখলদাররা দলিল-দস্তাবেজ, খাজনা প্রদান থেকে আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। এমনকি ডিআইটি থেকে নকশা পর্যন্ত অনুমোদন করে নিতে পেরেছে। রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি এতটাই সম্প্রসারিত যে, নদী দখলকারীরা সব ধরনের বৈধতার প্রমাণাদি এর আগেই সংগ্রহ করেছে। তবে উচ্ছেদ অভিযানে কিন্তু বৃহৎ শিল্পের মালিকরা উৎকোচ প্রদানে তাদের ভারী যন্ত্রপাতি সরানোর জন্য সময় নিতে পেরেছে। যেটি বসতবাড়ির মালিকদের দেওয়া হয়নি। কিছু দিন আগে নির্মিত ছয়তলাবিশিষ্ট লালবাগ থানার পাশের ভবনটি ভাঙা হলেও থানাটি অক্ষত রয়েছে। অক্ষত রয়েছে বিজেপির মার্কেটও। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান কর্তৃক দখল করা অবৈধ স্থাপনা অক্ষুণ্ন রেখে ওই উচ্ছেদ অভিযান সঙ্গত কারণেই সফল হবে বলে মনে হয় না। অপরদিকে বেড়িবাঁধের দক্ষিণে শিল্প-কারখানা, পেট্রোল পাম্প, হাসপাতালসহ বিত্তবান ক্ষমতাশালীদের দখলকৃত অবৈধ জমি ও স্থাপনাসমূহ উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হবে বলেও ভরসা করা যাচ্ছে না। নিজেদের শিল্প-কারখানা রক্ষায় নিজ খরচে কারখানার সম্মুখে মসজিদ নির্মাণ করে তারা অভিনব পন্থা অবলম্বন করেছে। বেড়িবাঁধের উত্তর-দক্ষিণ উভয় দিকে পাকা মসজিদ নির্মাণের পেছনে অবৈধ অবকাঠামো এবং শিল্প-কারখানা বাঁচানোর অসৎ উদ্দেশ্য শেষ রক্ষা হয় কিনা সেটাও দেখার বিষয। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও ময়লা-আবর্জনা স্তূপের অনেকগুলো আধাপাকা স্থাপনা বেড়িবাঁধের উত্তরে নির্মাণ করেছে। বেসরকারি মালিকানার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সংস্থার বিশাল জায়গাজুড়ে অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ অভিযানের অন্তর্গত বলে উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া দায়িত্বশীলরা বলেছেন বটে, তবে আমাদের সামগ্রিক অভিজ্ঞতার আলোকে বিবেচনা করলে আশ্বস্ত হওয়ার কিন্তু উপায় নেই।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
বেড়িবাঁধ নির্মিত হওয়ার পরই গাবতলী থেকে দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু পর্যন্ত সড়ক নির্মিত হয়েছিল। ওই সড়কপথ প্রশস্ত করতেই বাঁধের উত্তর দিকে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়ে এসেছে। উচ্ছেদ অভিযান তিন দিন স্থায়ী হওয়ার পর আচানক বন্ধ হয়ে যায়। জানা যায়, অবৈধ দখলদারদের স্থাপনা সরানোর জন্য সময় দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে কী হয় সেটা নিকট-ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
আমরা অভিযানকে নিশ্চয় স্বাগত জানাব। চাইব নদী-উদ্ধার শতভাগ বাস্তবায়ন হোক। পাশাপাশি বৈধ জমির মালিকরা যাতে আক্রান্ত না হয় সেটাও চাইব। তবে অসম্ভবের সম্ভবপর বাংলাদেশে যে সর্বক্ষেত্রে সবই সম্ভব এবং অসম্ভব, সেটাও অস্বীকার করি কীভাবে! বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় সংস্থার অবৈধ স্থাপনা এবং বিত্তশালী, ক্ষমতাশালীদের ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনা যদি অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়; তা হলে তো নদী উদ্ধার অভিযান অনিবার্যরূপে তামাশায় পরিণত হওয়াই স্বাভাবিক। উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ রয়েছে, আবার শুরু হবে কিনা! কিংবা আদৌ হবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলে পড়লেও অবাক হবো না। কেননা অসম্ভবের এই সম্ভবপর দেশে সবই যেমন সম্ভব, তেমনি অসম্ভবও।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে বুড়িগঙ্গার শাখা নদীটি দখলমুক্ত করার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালিত হোকÑ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের কাছে সেটাই প্রত্যাশা করব।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত