বিরাট মানুষের এক চিলতে স্মৃতি

মারুফ কামাল খান
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বিরাট মানুষের এক চিলতে স্মৃতি

‘দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা নেই’ যে দেশের অতি পুরনো প্রবাদ, সে দেশে কর্মমুখর জীবন-সফর সেরে মৃত্যুর পর্দার আড়ালে চলে গেলেন আব্দুল্লাহ ্আল নোমান। মঙ্গলবার ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ। ঘুমিয়ে ছিলাম। সকালে ঘুম ভাঙল নূরুল আজিম হিরোর ফোনে। হিরো আমার পরম স্নেহভাজন এবং নোমান ভাইয়ের একান্ত সচিব। শুধু একান্ত সচিব বললে ভুল হবে, তাকে নোমান ভাইয়ের পরিবারের সদস্য বললেই ঠিক বলা হয়। আমি ‘হ্যালো’ বলতেই অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো হিরোর কান্নাভেজা কণ্ঠস্বর : ‘নোমান ভাই আর নেই।’

এ খবর আমার কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। আমি ভাষা হারিয়ে ফেললাম। ভাবলেশহীন হয়ে পড়লাম। কিছুই বলতে পারলাম না। আমার প্রতিটি তন্ত্রীতে তখন কেবলই প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল একটি বাক্য ‘নোমান ভাই আর নেই।’ মঙ্গলবারেই নোমান ভাইয়ের চট্টগ্রাম যাওয়ার কথা ছিল। বিকেলে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপি আয়োজিত জনসভায় নির্ধারিত প্রধান বক্তা ছিলেন তিনি। সেই প্রিয় নগরীতে তিনি আর জীবিত ফিরতে পারলেন না। সেখানে ফিরল নোমান ভাইয়ের মরদেহ।

নোমান ভাইয়ের সঙ্গে আমার সর্বশেষ চাক্ষুষ দেখা হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। তিনি তখন রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে আমিও হাসপাতালে গিয়েছিলাম অসুস্থ নোমান ভাইকে দেখতে। এরপর হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের করা শতাধিক মিথ্যা মামলার আসামি হই আমি। ফেরারি অবস্থায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমার স্বাভাবিক সব কর্মকা- ও সবার সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। টিকে ছিল শুধু ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্কে অতি সীমিত কিছু যোগাযোগ।

এরপর ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য আমি যখন আমেরিকায় যাই তখন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ডাক্তার-কাম-জনপ্রিয় সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট রুমি আহমেদ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি আমাকে আরকানসাসের লিটলরকে কর্মরত ডাক্তার সাদিকুল হক পলাশের ফোন নম্বর দেন। পলাশ হচ্ছেন নোমান ভাইয়ের জামাতা। আমি পলাশকে ফোন করি। এরপর শুরু হয় আমার চিকিৎসার ব্যাপারে তার সাধ্যাতীত সহযোগিতা। রেডিয়েশন নেওয়ার জন্য আমাকে লিটলরক শহরে প্রায় মাস তিনেক কাটাতে হয়। তখন নোমান ভাইয়ের অতি স্নেহভাজন রাজনৈতিক সহকর্মী জয়নাল আবেদিন এসে আমার সঙ্গে প্রায় দু’মাস কাটান। ওই সময়ে পলাশের আন্তরিক সহযোগিতা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। পলাশ ও নোমান ভাইয়ের কন্যা ডাক্তার তাজিন তাদের বাচ্চাদের নিয়ে নিয়মিত আসত আমার তদারক করতে। ওরা আসত একগাদা খাবার নিয়ে। মাঝে মাঝে রেস্তোরাঁ ও বাসায় নিয়ে গিয়েও খাওয়াত। চিকিৎসার তদারকি তো ছিলই। আমি লিটলরকে আছি, নূরুল আজিম হিরোর কাছ থেকে এ কথা জেনে নোমান ভাই প্রায়ই তার কন্যা ও জামাতা তাজিন ও পলাশকে তাগিদ দিতেন যেন আমার তদারকি ও সেবাযতেœ কোনো ঘাটতি না হয়। এই ভালোবাসা ও আন্তরিকতার ঋণ কি কোনো কিছুতে শোধ করা যায়?

জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে এসে দল গঠন করলে শুরু থেকেই মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর অনুসারীদের বড় অংশ বিএনপির মূল কাঠামো রচনা করে। আব্দুল্লাহ্ আল নোমান ছিলেন তাদেরই একজন। ছাত্রজীবনেই তিনি ভাসানীর অনুসারী হিসেবে ছাত্র ইউনয়নে সক্রিয় হন। এরপর শ্রমিক আন্দোলনের পথ বেয়ে মূলধারার রাজনীতিতে যুক্ত হন। পাকিস্তান আমলেই অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতায় তিনি দ্রুত মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) প্রথম কাতারের নেতৃত্বে উঠে আসেন। মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে গণমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আব্দুল্লাহ্ আল নোমান অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বিএনপির গঠন পর্বে এই দলের সঙ্গে ভাসানী ন্যাপ ‘মার্জ’ হয়ে যায়। আর তখন বিএনপির অন্যতম নেতা হিসেবে আব্দুল্লাহ্ আল নোমানের রাজনৈতিক জীবনের নতুন পর্বের সূত্রপাত ঘটে।

এরশাদের স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনে আব্দুল্লাহ্ আল নোমান অতি সাহসী ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনিই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আপসহীন ভূমিকার কারণে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ‘দেশনেত্রী’ অভিধায় ভূষিত করেন। বিএনপির মনোনয়নে একাধিকবার তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হন। তবে আমার ধারণা, নিজের শহর চাটগাঁর স্থানীয় রাজনীতির প্রতি প্রবল আকর্ষণের কারণে জাতীয় রাজনীতির প্রতিযোগিতায় তিনি পিছিয়ে পড়েন। আমি মনে করি, বিএনপির দলীয় বিন্যাসে নোমান ভাইয়ের অবস্থান আরও অনেক উঁচুতে থাকা উচিত ছিল। সেদিক থেকে তিনি বঞ্চিত ও অবমূল্যায়িত হয়েছেন। কিন্তু এ নিয়ে তার কোনো অনুযোগ ছিল না। রাজনৈতিক, দলীয় ও সাংগঠনিক তৎপরতায় তিনি সব সময় ছিলেন নিরলস ভূমিকায়। তিনি পদ-পদবি দিয়ে নিজেকে কখনও আলোকিত করতে চাননি। বরং তিনি তার ভূমিকার মাধ্যমে এমন অবস্থানে নিজেকে উন্নীত করেছিলেন যে, আব্দুল্লাহ্ আল নোমান নামটিই বিএনপির জন্য সম্পদে পরিণত হয়েছিল। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় তার উপযুক্ত পরামর্শ থেকে বঞ্চিত হয়ে দলই যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

চট্টগ্রামে বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত এক অতি পুরনো সাংগঠনিক ব্যাধি। এ নিয়ে আমি একবার একটি লেখা লিখেছিলাম ‘অলির কথা শুনে নোমান হাসে’ শিরোনামে। সেই লেখা পড়ে নোমান ভাই আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘দল ও আদর্শের প্রতি কার কতটা কমিটমেন্ট তা আগামীতে প্রমাণিত হবে।’ সত্যিই তা প্রমাণিত হয়েছে। নোমান ভাইয়ের বিরোধী অতি মূল্যায়িত নেতারা তাদের আদর্শবাদিতার প্রমাণ দিতে পারেননি শেষতক। কিন্তু নোমান ভাই নানাভাবে অবহেলিত হয়েও একজন সাচ্চা জাতীয়তাবাদী নেতার পরিচয়েই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। সেই বিরাট মানুষটির সঙ্গে আমার নিজেরই আছে অজস্র স্মৃতি। কিন্তু আজ সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আজ তাই সামান্য এক চিলতে স্মৃতি এ লেখায় তুলে ধরে তার প্রতি জানাচ্ছি অতল শ্রদ্ধা।

রাজনীতি ছিল নোমান ভাইয়ের ধ্যানজ্ঞান। পার্থিব সম্পদের লালসা তাকে কখনও বিচ্যুত করতে পারেনি। ঔদার্য, সাহস, দেশপ্রেম, আদর্শনিষ্ঠা, সাংগঠনিক দক্ষতা, সহকর্মীদের প্রতি মমত্ববোধ ও সদাচরণ তাকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। যাদের শ্রম, ঘাম, মেধা ও অবদানে বিএনপির অত্যুচ্চ অট্টালিকা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, নোমান ভাই তাদেরই একজন। সেই মানুষগুলো একে একে জগৎ-সংসারের সফর শেষে বিদায় নিচ্ছেন। তাদের শূন্যস্থান কারা পূরণ করবেন তার ওপরই নির্ভর করছে এ দলের ভবিষ্যৎ। আব্দুল্লাহ্ আল নোমানের জীবনাদর্শ পরিপূর্ণভাবে অনুসরণের মাধ্যমেই কেবল তার শূন্যতা পূরণ এবং তার স্মৃতির প্রতি উপযুক্ত শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব বলে আমি মনে করি।


মারুফ কামাল খান : সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক