পাসপোর্ট করতে লাগবে না পুলিশ ভেরিফিকেশন, কতটুকু যুক্তিসংগত?

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
পাসপোর্ট করতে লাগবে না পুলিশ ভেরিফিকেশন, কতটুকু যুক্তিসংগত?

বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকা অস্থায়ী সরকার সম্প্রতি পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিধান বাতিল করেছে। ফলে এখন থেকে পাসপোর্ট করার সময় পুলিশ ভেরিফিকেশন আর লাগবে না। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, পাসপোর্ট তো আমার নাগরিক অধিকারের একটা। আমি চোর না ডাকাত সেটা পুলিশ আলাদাভাবে বিচার করবে। একেবারে ঠিক কথা। আপনার কথার সূত্র ধরেই বলছিÑ এ জন্যই প্রয়োজন পুলিশ ভেরিফিকেশন।

একজন চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসী কিংবা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি নাগরিকত্বের ওপর নির্ভর করে পাসপোর্ট পাওয়ার অধিকার রাখে না। ইউরোপের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে তারা এখনও পুলিশ ভেরিফিকেশন করে। কারণ ওই ধরনের লোকের হাতে পাসপোর্ট গেলে সেই ব্যক্তি খুব সহজেই বিদেশে পলায়ন করতে পারবে। তবে ইউরোপে পুলিশ ভেরিফিকেশন করার পন্থা ভিন্ন।

সুইডেন পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া সুইডিশ পাসপোর্ট ইস্যু করে না। চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসী কিংবা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের পাসপোর্ট পাওয়ার অধিকার আটকে রাখা হয়। তবে তাদের আইডি কার্ড আছে। যেহেতু তাদের আইডি কার্ড আছে সে কারণে তারা দেশের অভ্যন্তরীণ সব কাজ এই কার্ড দিয়ে করতে পারে। পুলিশ মনে করে তাদের জন্য পাসপোর্ট প্রয়োজনীয় নয়।

এ ধরনের নাগরিকরা তখন দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য নানা কারণ কিংবা অজুহাত দেখিয়ে সুপারভাইজরি বোর্ডে পাসপোর্টের আদেশ পাওয়ার জন্য আবেদন করে। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে সুপারভাইজরি বোর্ড স্টকহোম নর্থ কমিটির একজন মেম্বার। আমরা তখন সব কিছু দেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি এই ব্যক্তির পাসপোর্ট পাওয়ার অধিকার আছে কি না। শক্ত কোনো কারণ ছাড়া তাদের পাসপোর্ট করার আদেশ সুপারভাইজরি বোর্ড কখনও অনুমোদন করে না।

এখানে কোনো নাগরিক অধিকারের প্রশ্ন আসে না, আসতে পারে না। সুপারভাইজরি বোর্ড অনুমোদন করলে ওই ব্যক্তি তখন পুলিশের বাধা থেকে মুক্তি লাভ করে। এখানে পুলিশ ভেরিফিকেশনের গুরুত্ব অত্যন্ত শক্ত। আমার জানামতে সুপারভাইজরি বোর্ড স্টকহোম নর্থ কমিটির কাছে পাসপোর্ট পাওয়ার অধিকারের জন্য বারবার আবেদন করে অনেকে নাকচ হয়েছে।

এসব কারণে বাংলাদেশ সরকারের এই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের জন্য অত্তন্ত স্পর্শকাতর বলে আমি মনে করি। কারণ এই পুলিশ ভেরিফিকেশনের মধ্য দিয়ে জানা যাবে আবেদনকারী আসলেই বাংলাদেশি নাগরিক কি না। জানা যাবে তিনি কোনো সন্ত্রাসী কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত কি না। জানা যাবে ব্যক্তি কোনো জালিয়াতি কিংবা কোনো মামলায় সাজাপ্রাপ্ত কি না। সবশেষে জানা যাবে তিনি জন্মগত সূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক কি না।

তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে পুলিশ কিংবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধান রিপোর্ট ছাড়া একজন ব্যক্তির নামে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ইস্যু করা কতটুকু যুক্তিসংগত? এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকার কি সব কিছু যাচাই করে দেখেছে? সারাবিশ্ব যখন সন্ত্রাসবাদ দমনে কঠিন কঠিন আইন গ্রহণ করছে ঠিক সেই সময় বাংলাদেশ হাঁটছে বিপরীত মুখে। কিন্তু কেন? কী আছে এই রহস্যমূলক সিদ্ধান্তের পেছনে? এর উত্তর নিশ্চয়ই বাংলাদেশের জনগণের জানার অধিকার আছে। কারণ বাংলাদেশের এই অস্থায়ী সরকার এ ধরনের সিদ্ধান্ত কেন এই মুহূর্তে নিয়েছে সে সম্পর্কে কোনো পরিষ্কার ব্যাখ্যা করেনি। শুধু বলা হয়েছেÑ এটা মানুষের নাগরিক অধিকার।

সুইডেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে আগের পাসপোর্ট কিংবা আইডি কার্ড দেখিয়ে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে হয়। শুধু তাই নয়, এ সময় আবেদনকারীর আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়। এখানেই শেষ নয়। যখন পাসপোর্ট করার জন্য পুলিশ অফিসে সময় বুক করা হয় তখন নিজের পারসোনাল নাম্বার লিখতে হয়। সব কিছু ইতিবাচক হলে আবেদনকারীর নামে পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়।

প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে এখানে পুলিশ ভেরিফিকেশন হলো কীভাবে? অবশই হয়েছে। আবেদনকারী যখন পুলিশের ওয়েবসাইটে নিজের পারসোনাল নাম্বার দিয়ে সময় বুক করবে সেখান থেকেই পুলিশের আবেদনকারীর প্রাথমিক রিপোর্ট পাওয়ার সুযোগ থাকে। পরবর্তী সময়ে আবেদনকারী যখন সময়মতো পুলিশ অফিসে আসবে তখন তার সঙ্গে থাকা আইডি কার্ড প্রমাণ করবে তিনি সেই একই ব্যক্তি। ওই সময় পুলিশ আবেদনকারীর আঙুলের ছাপ নেবে। সব কিছু পাওয়ার পর পুলিশ যাচাই করে দেখবে আবেদনকারী পাসপোর্ট পাওয়ার যোগ্যতা রাখে কি না। সব ঠিক থাকলে পুলিশ আবেদনকারীর পাসপোর্ট তৈরি করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাবে। তার অর্থ হলো আধুনিক ডিজিটাল সিস্টেমের মধ্য দিয়ে আবেদনকারীর পুলিশ ভেরিফিকেশন করা হয়েছে। পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া নয়। খুব বেশি কিউ না থাকলে ১৪ দিনের ভেতরেই পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়। এই হলো একটি গণতান্ত্রিক দেশের নিয়ম।

জানি না বাংলাদেশের ডিজিটাল সিস্টেম বর্তমানে কতটুকু উন্নতমানের। তবে মিডিয়ার মাধ্যমে যতটুকু জানা যায় নকল ভোটার আইডি, ভিন্ন পথে পাওয়া ন্যাশনাল আইডি কার্ডের সংবাদ। এমন পরিস্থিতিতে যদি সরকার পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া পাসপোর্ট ইস্যু করে তাহলে ভিন্ন দেশের নাগরিকদের হাতে বাংলাদেশি পাসপোর্ট হস্তগত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করবে বলে আমি মনে করি। আসছে নির্বাচনে ভিন্ন দেশের নাগরিকরা ভোট দেওয়ার সুযোগ পাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। শুধু তাই নয় বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে দেশ ও বিদেশে নানা ধরনের সন্ত্রাসী কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িত হওয়ার সুযোগ পাবে। তবে এ কথা ঠিক বাংলাদেশে পুলিশ ভেরিফিকেশনের কাজ করতে অনেক বিলম্ব হয়, যার কারণে অনেকে অবৈধ পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।

পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া বিশ্বের কোনো দেশে পাসপোর্ট ইস্যু করা হয় কি না তা আমার জানা নেই। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় নিয়ে যে পুলিশ ভেরিফিকেশন করার নিয়ম আছে তাকে আধুনিক ডিজিটাল সিস্টেমে আনলে সমস্যার সমাধান হবে বলে আমি মনে করি। পুলিশ ভেরিফিকেশন সিস্টেম পরিবর্তন করতে পারলে নাগরিকরা তখন খুব সহজেই পাসপোর্ট পাওয়ার সুযোগ পাবে, ঠিক যেভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা পেয়ে থাকে। আমি আশা করব, বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে নুতন করে চিন্তা করবে। যেখানে রাষ্ট্রের স্বার্থ জড়িত সে ক্ষেত্রে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত থেকে সরকারের সরে আসা উচিত বলে আমি মনে করি।


মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু : ইলেকটেড মেম্বার,

সুপারভাইজরি বোর্ড, স্টকহোম নর্থ