অপরাধ দমনে ডেভিল হান্টের কার্যকারিতা
অপারেশন ডেভিল হান্ট নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার উদ্ধৃতি দিয়ে এই ক্ষুদ্র নিবন্ধের উপস্থাপনা। ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ দেশের আইনশৃঙ্খলার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে এক মতবিনিময় সভায় তিনি দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, ‘অপারেশন ডেভিল হান্টের অভিযানে রাঘববোয়াল-চুনোপুঁটি কেউ ছাড় পাবে না। যারা শয়তান, তারাই ডেভিল হান্টে ধরা পড়বে। কারও বিরুদ্ধে কোনো মিথ্যা মামলা হলে সে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে। কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যেন মিথ্যা মামলায় হয়রানির শিকার না হয়, সে বিষয় নিয়েও কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।’
তিনি আরও বলেন, ‘রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সহনীয় থাকবে, কারণ ছোলা-খেজুরের সরবরাহ ভালো। দেশে সারের কোনো সংকট নেই, কিছু ডিলার শয়তানি করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তা ছাড়া তিনি যতদিন শয়তানরা থাকবে, ততদিন এই অভিযান চলবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। বর্তমানে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে এবং তা ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নতির অবকাশ রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্যসূত্রে জানা যায়, রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-রাহাজানি-হত্যাসহ জমি-দোকান-সম্পদ দখল প্রভৃতি অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের নগর-শহর-প্রান্তিক জনপদে বহুমাত্রিক অপরাধ বেপরোয়া রূপ পরিগ্রহ করেছে। চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য নগর-শহরেও ফ্লাইওভার ও বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের যানবাহন ছিনতাই অহরহ সংঘটিত হচ্ছে। জনশ্রুতিমতে, গ্রামগঞ্জেও চুরি-ডাকাতির ভয়ে জনগণ খুব আতঙ্কিত। যৎসামান্য ধনসম্পদ রক্ষার্থে তারা যারপরনাই কাতরতায় ভুগছে। আইনশৃঙ্খলার ক্রমাবনতি ও অপরাধ বৃদ্ধিতে জনজীবনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিগূঢ় অনুভূত। বিশেষ করে দরিদ্র-নিম্নআয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় নানামুখী সংকট পরিলক্ষিত। সামান্য তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে অহরহ সড়ক অবরোধ দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সুযোগে শিল্পাঞ্চলগুলো বিশেষ করে গার্মেন্টশিল্পে অরাজকতা আস্থার চরম সংকট তৈরি করেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শুরু থেকেই পোশাক কারখানা অধ্যুষিত এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষের কারণে অসংখ্য কারখানার উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বহু কারখানা ভাঙচুরের পাশাপাশি দেওয়া হয় আগুন। ফলে কঠিন হুমকির মুখোমুখি দেশের পোশাক খাত।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এলেও পুলিশ বাহিনীসহ অন্যান্য সংস্থার কার্যকারিতা পর্যাপ্ত বলা যাচ্ছে না। এমন সব দুর্বলতার সুযোগে দেশবিরোধী চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রকারীরা বিভিন্নভাবে সরকারকে বিব্রত করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাজধানী ঢাকাসহ প্রতিটি বিভাগীয় শহর-জেলা-উপজেলার কিছু কিছু এলাকা রীতিমতো অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। ডাকাতি-গণছিনতাই-লুট-খুন-মাদক ব্যবসাসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যা ওইসব জায়গায় সংঘটিত হচ্ছে না। ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ সংবাদপত্রে প্রকাশিত পুলিশ সদর দপ্তরের ওয়েবসাইটের অপরাধ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত খুনের ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ৭৫৯টি। ওই সময়ে ডাকাতি সংঘটিত হয়েছে ৪১৯টি, ছিনতাই বা দস্যুতা ১ হাজার ২৫৩টি এবং চুরির ঘটনা ঘটেছে ৭ হাজার ৯২৬টি। পক্ষান্তরে ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত খুন ৩ হাজার ২৩টি, ডাকাতি ৩১৯টি, ছিনতাই ১ হাজার ২২৭টি, নারী ও শিশু নির্যাতন ১৮ হাজার ৯৪১, চুরি ৯ হাজার ৪৭৫টি। উল্লেখ্য, পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায় ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে কিছু কিছু অপরাধ বেড়েছে। অপরাধ
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
বিশ্লেষকদের মতে, বিগত অনেক বছরের চেয়ে ২০২৪ সালে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বেশি। আর এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা, জুলাই বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা। প্রাসঙ্গিকতায় সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা গণমাধ্যমে বলেন, ‘যে ঘটনাগুলো ঘটে গেছে সেগুলোকে তদন্ত করে অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। অস্ত্র লুট হওয়ার ঘটনাটি উদ্বেগের বিষয়। জননিরাপত্তা রক্ষায় এসব অস্ত্র উদ্ধারে জোর দিতে এবং অভিযান চলমান রাখতে হবে। এগুলো অপরাধীদের হাতে থাকা রাষ্ট্রের জন্য হুমকি-ক্ষতি। লুট হওয়া অস্ত্র আইনশৃঙ্খলার জন্য বড় হুমকি। সেটি দুষ্কৃতকারীরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ও বিভিন্ন অপরাধে ব্যবহার করতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেক বড় একটা ঝামেলার মধ্য দিয়ে গেছে, তাদের সেটি কাটিয়ে অপরাধ দমনে আরও কঠোর হতে হবে।’
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নানামুখী উদ্যোগ প্রশংসনীয়। ইতোমধ্যে পুলিশ-র্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন অতিশয় দৃশ্যমান। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে মাঠে নামানো হয়েছে সেনাবাহিনীকে। দেশের চলমান পরিস্থিতিতে জনসাধারণের জানমাল ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর সার্বিক নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। পাশাপাশি সংস্থাটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড রোধ ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে দেশব্যাপী নিরপেক্ষতা-পেশাদারত্বের সঙ্গে যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনায় নিয়োজিত। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাকারী, গুরুত্বপূর্ণ হত্যা মামলার আসামিসহ অন্যান্য মামলার আসামিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণে দেশব্যাপী শুরু হয়েছিল বিশেষ অভিযান। ওই অভিযানে অপরাধপ্রবণ এলাকা অর্থাৎ ক্রাইম জোনে কম্বিং অপারেশন (চিরুনি অভিযান) পরিচালিত হয়েছে। বসানো হয়েছে পুলিশের স্থায়ী তল্লাশি চৌকি বা চেকপোস্টের পাশাপাশি অস্থায়ী চেকপোস্ট। পুলিশি টহল জোরদারের সঙ্গে বাড়ানো হয়েছে টহল দল ও গোয়েন্দা নজরদারি। অভিযানে শীর্ষ সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি, কিশোর গ্যাং হোতা গ্রেপ্তারসহ উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ, মাদকদ্রব্য, আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র।
অতিসম্প্রতি সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়িঘর-স্থাপনাসহ নানামুখী হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ, চাঁদাবাজি, নাশকতা, সরকারবিরোধী উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডে যে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে একযোগে পরিচালিত হচ্ছে অপারেশন ডেভিল হান্ট। বিশেষ এই অভিযান পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব, পুলিশ ও পুলিশের গোয়েন্দা শাখা ডিবি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উল্লেখ্য অভিযান সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, সম্প্রতি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন মতে, বিগত সরকারের সন্ত্রাসীরা দেশকে অকার্যকরের উদ্দেশ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নষ্ট করতে নানাবিধ ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছে। তারা ষড়যন্ত্র করে দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইছে। এর মধ্যে তাদের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেশে কয়েকটি সন্ত্রাসী কার্যক্রম সংঘটিত হয়েছে। তাই দেশের সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে এ অপারেশন শুরু করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
অপারেশনের লক্ষ্যগুলোর মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে দেশে সন্ত্রাসীরা কীভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে তা শনাক্ত করা। দেশব্যাপী অভিযান পরিচালনা করে সন্ত্রাসীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে আইনের আওতায় নিয়ে আসা। পাশাপাশি গোয়েন্দাদের মাধ্যমে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে। পরবর্তীকালে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে দমন এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণই অপারেশন ডেভিল হান্টের অন্যতম লক্ষ্য। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুসারে, অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরু হওয়ার পর থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি বিকাল পর্যন্ত সারাদেশে মোট ৭ হাজার ৩১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একই সময়ে এই অভিযানের বাইরে বিভিন্ন মামলায় ১ হাজার ১৮৯ জনকে গ্রেপ্তার এবং বেশকিছু অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
সার্বিক পর্যালোচনায় এটি সুস্পষ্ট যে, গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিত হলেও অধিকাংশ অপরাধী এখনও প্রকাশ্যে তাদের অপতৎপরতা চালু রেখেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অপরাধীদের দমানো না গেলে অপরাধের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। এই মুহূর্তে অপরাধ মোকাবিলায় পুলিশের সক্রিয়তা আবশ্যক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলাও অত্যন্ত জরুরি। এলাকাভিত্তিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা না গেলে এসব দুর্বৃত্তায়ন রোধ করা দুরূহ ব্যাপার বটে। মসজিদ-মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত নীতি-নৈতিকতা ও মনুষ্যত্বের বক্তব্য প্রচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্য অনুসারে এটি অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে, যাতে কোনোভাবেই নির্দোষ-নিরপরাধ সাধারণ মানুষ কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হয়। ব্যক্তিস্বার্থে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কর্মকাণ্ডে ফাঁসিয়ে দিয়ে গ্রেপ্তার অবশ্যই অগ্রহণযোগ্য। রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তি দৃশ্যমান-প্রমাণসাপেক্ষে অপরাধ সংঘটিত না করলে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তির আওতায় আনা চরম জুলুম-নির্যাতনের পর্যায়ে পড়বে। মোদ্দা কথা সামগ্রিক বিষয় আমলে নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিশেষ করে তরুণ-যুবকদের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে অপরাধ দমনের নানা উদ্যোগ গ্রহণ সময়ের জোরালো দাবি।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী