পর্যটন বিকাশে সেনাবাহিনীর অবদান
বাংলার পাহাড়ি অঞ্চলের অনাবিষ্কৃত সৌন্দর্য
বাংলাদেশের প্রকৃতি যেন এক কবিতার মায়াজাল। গ্রামবাংলার মাঠ-ঘাট, নদীর বাঁক আর সবুজের শোভা আমাদের মুগ্ধ করে। পাহাড়-মেঘের খেলা আর সমুদ্রের বিশালতা এই সৌন্দর্যকে আরও অনন্য করে তোলে। ঋতুর পালাবদলে প্রকৃতি প্রতিবার নিজেকে নতুন রূপে প্রকাশ করে। এই নৈসর্গিক শোভা আমাদের সংস্কৃতি ও জীবনের গভীর অনুপ্রেরণার উৎস। এই প্রকৃতি নিয়ে যখনই আলোচনা ওঠে, তখনই মনে পড়ে যায় কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্্দীন এবং সুফিয়া কামালের মতো মহান কবিদের কালজয়ী উক্তিমালা। যে বাংলার রূপ আমরা শহরের ইট-কাঠের দেয়ালের আড়ালে বসে উপলব্ধি করতে পারি না, সেই রূপ হয়তো পাব গ্রামের পথঘাটে, নদীর বাঁকে, কিংবা পাহাড়ঘেরা অবাক সব অঞ্চলে। আমাদের চারপাশে ছড়ানো এমন সবুজ মায়াবী সৌন্দর্য এতদিন অনেকেই দেখেননি কেবল যোগাযোগ ও অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতার কারণে। তবে সাম্প্রতিককালে পর্যটনশিল্পের বিকাশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে. বিশেষত পাহাড়ি এলাকাগুলোতে।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, বিশেষত পাহাড়ি অঞ্চলে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করার মাধ্যমে পর্যটন সম্ভাবনা উন্মোচনে গুরুত্ব¡পূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সুন্দরবন, কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের নিরাপত্তা এবং উন্নয়নে সেনাবাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য। পর্যটনবান্ধব অবকাঠামো তৈরির পাশাপাশি সেনাবাহিনী দেশের ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলো সংরক্ষণেও উদ্যোগ নিয়েছে। বান্দরবানের নীলগিরি বা রাঙামাটির সাজেক পর্যটন এলাকা বিকাশের পেছনে সেনাবাহিনীর অসামান্য প্রচেষ্টা রয়েছে। পাহাড়ি জনপদে রাস্তাঘাট নির্মাণ ও উন্নত নিরাপত্তাব্যবস্থা পর্যটকদের সহজ যাতায়াত ও ভ্রমণকে সুরক্ষিত করেছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য সেনাবাহিনী পর্যটনশিল্পকে উৎসাহিত করে চলেছে। দেশের পর্যটন খাতের সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর উদ্যোগ আরও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ার প্রতিশ্রুতি বহন করে।
বাংলার প্রকৃতি, মাটি, নদী, ফুল আর পাহাড় নিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। তার প্রকৃতি সংক্রান্ত কাব্যধারা যেন বহুকাল ধরে আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। তার কবিতায় মাটির গন্ধ, কাদামাখা পথ, নদীর ঘোলা জল, সব মিলিয়ে যে এক রঙিন চিত্রপট তৈরি হয়, তা শহরে বসে কল্পনায় আনা কঠিন। আর জীবনানন্দ দাশ তো অবলীলায় লিখে গেছেন, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়!’ এই ফিরে আসার আহ্বান যেন প্রতিটি বাঙালিকে টানে অতল গভীরে। জসীমউদ্্দীনের কবিতায়ও একইভাবে ধরা দেয় গ্রামবাংলার সহজ-সরল রূপ। ‘ভোরে সদ্য-জাগা ফুলে ফুলে/শিশিরের জল গড়ায়’, এমন লাইন পড়লে মনে হয়, প্রকৃতি যেন ধুয়ে-মুছে পরিপাটি হয়ে আমাদের আহ্বান করছে। বাংলার মাটি, নদী ও ঋতুর বৈচিত্র্য নিয়ে তার অনেক কবিতায় চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়। ‘কুমারী মাটির ফুল’ প্রকৃতি নিয়ে তার গভীর অনুভূতি প্রকাশ করে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, এ সৌন্দর্যকে ঠিকমতো উপলব্ধি করতে কিংবা তার সান্নিধ্যে যেতে পারা সব সময় সম্ভব হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পথ, কোথাও প্রচণ্ড ঢালু পাহাড়ি রাস্তা, কোথাও অপ্রশস্ত বাঁক, কোথাও সেতুর অভাব, কোথাও বা নিরাপত্তা নিয়ে সংশয়, এসব কারণে বাংলাদেশি পর্যটকরা বছরের পর বছর নিজেদের দেশের শ্যামল প্রকৃতিকে এড়িয়ে চলেছেন। অনেকে বিদেশ ভ্রমণকে সহজ মনে করেছেন, অথচ নিজের দেশের আনাচ-কানাচে কী মায়াময় সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে, তা হয়তো তারা জানেনই না।
বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আন্তরিক উদ্যোগ ও কাজের ফলে পার্বত্য অঞ্চল ও প্রত্যন্ত বেশ কিছু স্থানে গড়ে উঠেছে টেকসই অবকাঠামো। উন্নত রাস্তা, সেতু, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, এসব মিলিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখন অনেকেই স্বচ্ছন্দে বেরিয়ে পড়েন পাহাড়ের কোলে বা সীমান্তবর্তী এলাকায়। এই যে সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, সেখানে একসময় হয়তো শুধু লাবনী পয়েন্ট আর সুগন্ধা পয়েন্ট নিয়েই আলোচনা হতো। এখন মেরিন ড্রাইভ ধরে ইনানী যাওয়া, সেখান থেকে আরও দক্ষিণে দরিয়ানগর ঘুরে আসা, সবই ঢের সহজ। আর সৈকত লাগোয়া বিলাসবহুল রিসোর্টগুলোতেও এখন অনায়াসে পর্যটকরা রাত কাটাতে পারেন, পরিবার নিয়ে নিশ্চিন্তে ছুটি উপভোগ করতে পারেন। সেনাবাহিনীর সুশৃঙ্খল উপস্থিতি নিরাপত্তা নিয়ে অতীতে যে সন্দেহ ও সংশয় ছিল, তা এখন অনেকটাই দূর করে দিয়েছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু সৈকত অঞ্চলে নয়, বরং পার্বত্য এলাকায়ও সড়কপথ তৈরি করেছে। খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি এবং বান্দরবানের মতো জেলাগুলোতেও একসময় হেঁটে বা নৌপথে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হতো। এখন পিচঢালা রাস্তা, কোথাও কোথাও সুদৃশ্য বাঁধ বা ব্রিজ, আবার কোনো কোনো অঞ্চলে আধুনিক পর্যটন কমপ্লেক্সÑ সব মিলিয়ে এক নতুন বাংলার সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে দেশবাসীর। সাজেক ভ্যালি এখন ‘মেঘের রাজ্য’ নামে সুপরিচিত; উচ্চ পাহাড়ের কোলে সারি সারি রিসোর্ট, সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা ও আকর্ষণীয় বিনোদনমূলক আয়োজন পর্যটকদের মানসিকভাবে স্বস্তি দিচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার স্থানীয় আদিবাসী বাসিন্দারাও পর্যটনকে ঘিরে জীবিকার নতুন পথ পেয়েছেন। কেউ রিসোর্টে কাজ করছেন, কেউ স্থানীয় হস্তশিল্প বা খাবারের ব্যবসা করছেন।
পাহাড়ি দুর্গম এলাকায় রিসোর্ট নির্মাণ, সেখানে পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিত করা এবং পর্যটকদের নিরাপত্তা প্রদানÑ এসবই একটি বড় দায়িত্ব¡ এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। সেনাবাহিনীর এই উদ্যোগের ফলেই সাজেক, নীলগিরি, নীলাচল বা কাপ্তাই লেকের আশপাশে এখন বৈচিত্র্যময় পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। যেখানে প্রথমে বেসরকারি উদ্যোগ ঝুঁকি নিতে পারেনি, সেনাবাহিনীর অগ্রণী ভূমিকার মাধ্যমে সেই এলাকাগুলো পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। বর্তমানে সেই অবকাঠামোর ভিত্তিতে বেসরকারি উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছেন, ছোট-বড় রিসোর্ট-কটেজ তৈরি করছেন, যা পর্যটনশিল্পের বিকাশের পাশাপাশি স্থানীয় অর্থনীতিকেও সমৃদ্ধ করছে। সেনাবাহিনীর এই উদ্যোগকে শুধু পর্যটন উন্নয়ন নয়, বরং জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবেও দেখা উচিত।
যখন জীবনানন্দ তার কবিতায় ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, পদ্মাÑ এ দেশের তিন প্রধান নদীকে আশ্রয় করে বাংলার রূপ তুলে এনেছেন, কিংবা জসীমউদ্্দীনের সেই সরল অথচ হৃদয়স্পর্শী উক্তি ‘শ্বেতপুরী গ্রামে আমার জন্ম, মাঠে মাঠে বাঁশি বাজাই’, তখন তারা আসলে এসব প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গে গোটা দেশের আত্মিক সংযোগের কথাই বোঝাতে চেয়েছেন। সেনাবাহিনীর গড়ে তোলা অবকাঠামো এখন দেশের নানা প্রান্তের মানুষকে সুযোগ করে দিচ্ছে সেই আত্মিক সংযোগের স্বাদ নিতে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
সেনাবাহিনীর উদ্যোগ শুধু স্থাপনা নির্মাণে সীমাবদ্ধ নয়, এটি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বহুমুখী ভূমিকা পালন করছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং কৃষির উন্নয়নে তাদের অবদান নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। বান্দরবানের থানচি, রুমা, আলীকদম এবং রাঙামাটির অনেক এলাকায় স্কুল প্রতিষ্ঠা, মেডিক্যাল ক্যাম্প আয়োজন এবং দুর্গম স্থানে প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের মতো গুরুত্ব¡পূর্ণ কাজগুলোতে সেনাবাহিনী সব সময়ই পাশে থেকেছে।
পর্যটনশিল্পের বিকাশের ফলে এই অঞ্চলগুলোর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও জোরদার হয়েছে। স্থানীয় দোকানপাট, ফলমূলের বাজার এবং হস্তশিল্পের ক্রয়-বিক্রয় নতুন উদ্যমে প্রাণ পেয়েছে। এর মাধ্যমে শুধু স্থানীয় মানুষের আয় বাড়ার পাশাপাশি তাদের জীবনে উন্নয়নের নতুন দ্বারও উন্মুক্ত হয়েছে। সেনাবাহিনীর এমন উদ্যোগ এলাকাভিত্তিক উন্নয়নের পাশাপাশি পুরো জাতির জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে।
কিছু এলাকায় পাহাড় কেটে নিরাপদ সড়ক নির্মাণ করতে হয়েছে, আবার কোথাও নদীর ওপর সেতু তৈরি করে সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। এসব কাজ দুর্গম অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থাকে সহজ করেছে, যা একদিকে পর্যটনের গতি বাড়িয়েছে এবং অন্যদিকে স্থানীয় অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। এখন রাবার বাগান, আদা, কফির ক্ষেত কিংবা পাহাড়ি ফলের চাষ থেকে শুরু করে সবকিছুর বাজারমূল্য বেড়েছে, কারণ পণ্য পরিবহন আগের চেয়ে অনেক দ্রুত হয়েছে। এ কাজগুলো সফল করতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। তাদের দায়িত্বশীল উদ্যোগে দুর্গম পাহাড়ি এলাকাগুলোও আজ পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।
যারা একবার পাহাড়ের রূপ দেখেছেন, তারা জানেন সকালে পাহাড়ের গায়ে সূর্যের আলো পড়ার দৃশ্য কতটা মোহনীয়। সূর্যের সোনালি আভায় সবুজ পাহাড় যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। কখনও পাহাড় ঘন মেঘের চাদরে ঢেকে যায়, চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে ধূসর নীরবতা। আর নীলগিরি বা কেওক্রাডংয়ের চূড়া থেকে সবুজ ও নীলের অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখলে মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের সেই অমর উক্তিÑ ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর!’ এভাবে পর্যটন উন্নয়নের মাধ্যমে সেনাবাহিনী শুধু যোগাযোগের সহজীকরণ করেনি, বরং জাতীয় অর্থনীতিতেও অবদান রেখে চলেছে।
উত্তরের সমতল থেকে অনেকেই মনে করেন, পাহাড়ে যাওয়া মানেই কষ্ট আর ঝুঁকি। তবে এখন সেই ধারণা বদলে গেছে। সেনাবাহিনীর উদ্যোগে পাহাড়ি এলাকায় নিরাপদ ও গাড়ি চলার উপযোগী রাস্তা, সুপরিকল্পিত পথনির্দেশনা এবং মেডিক্যাল সহায়তার মতো ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। ফলে এখন যে কেউ পরিবারসহ উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথে নির্বিঘ্নে ভ্রমণ করতে পারেন। শুধু আরামদায়ক পর্যটনই নয়, অনেকেই এখন অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের দিকে ঝুঁকছেন। পাহাড়ি এলাকায় ট্রেকিং, রক ক্লাইম্বিং, বোটিং বা কায়াকিংয়ের মতো অ্যাডভেঞ্চারধর্মী কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এসব উদ্যোগ সফল করতে সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা ও সার্বিক সহায়তা দারুণ ভূমিকা রাখছে।
সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠা বেশির ভাগ রিসোর্ট ইকো-ফ্রেন্ডলি নীতিমালা মেনে তৈরি হচ্ছে। পরিবেশ সংরক্ষণে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও সবুজায়ন কর্মসূচিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও সেনাবাহিনী স্থানীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও কারুশিল্প সংরক্ষণের বিষয়ে বিশেষভাবে যত্নশীল। পাহাড়ি এলাকার সৌন্দর্য বিকাশের পাশাপাশি পর্যটনশিল্পকে সমৃদ্ধ করতে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে তাদের এ অবদান নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য।
আমাদের মনে রাখতে হবে, পর্যটন শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগের মাধ্যম নয়, এটি একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক খাতও। পৃথিবীর বহু দেশ এখন পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে যদিও বর্তমান সময়ে পর্যটন খাতের ব্যাপক প্রসার হচ্ছে, তবু আমাদের এখনও অনেক পথ বাকি আছে। প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যে ভরা পার্বত্য চট্টগ্রাম বা দেশের অন্যান্য প্রতিবেশগতভাবে সংবেদনশীল অঞ্চলকে সঠিক পরিকল্পনা, নিয়ন্ত্রিত পর্যটন ও পরিবেশবান্ধব চিন্তা দিয়ে এগিয়ে নিতে পারলে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ বিশ্বমানের পর্যটন গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
জসীমউদ্্দীনের কবিতায় গ্রামবাংলার সহজ-সরল রূপ যে আন্তরিক আবেদনে ধরা দেয়, পাহাড়ে গিয়েও আমরা তারই আলাদা রূপ দেখতে পাই। পাহাড়ি জনপদের মানুষজন, তাদের নতুন স্বপ্ন আর পুরনো ঐতিহ্য; সবই এক অপূর্ব সম্মিলন। রাঙামাটিতে কাপ্তাই লেকের শান্ত জলরাশি, বান্দরবানের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা সাঙ্গু নদী, খাগড়াছড়ির জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা ঝরনাÑ এমন আরও শত-সহস্র রূপকথার টুকরো ছড়িয়ে আছে পার্বত্য অঞ্চলজুড়ে। বর্তমানে সেনাবাহিনীর কল্যাণে এসব সৌন্দর্য দৃষ্টিসুখ কিংবা কল্পনার বাইরে নয়। গাড়িতে চড়েই সাজেক ভ্যালির মেঘ দেখা যায়, নীলগিরির চূড়ায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের মাহাত্ম্য অনুভব করা যায়।
যেখানে সময় ছিল থেমে থাকা, যেখানে পর্যটনের অবকাঠামো ছিল অকল্পনীয়, সেখানে এখন সেনাবাহিনীর হাত ধরে এক নতুন ভোরের আলো ফুটছে। স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, গানে-নাচে মাতিয়ে তুলছে পর্যটকদের, আবার সেই পর্যটকরাই তাদের হাতের কারুকার্য, খাদ্যপণ্য কিনে নিয়ে যাচ্ছেন শহরে। চলমান এই আদান-প্রদান কেবল অর্থনৈতিক ঝরনাধারা বাড়াচ্ছে না, বরং সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনও ঘটাচ্ছে।
বলা বাহুল্য, উন্নয়নের এই যাত্রায় প্রতিবন্ধকতাও কম নয়। রাস্তা তৈরিতে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ভারসাম্য কোথাও কোথাও ব্যাহত হচ্ছে, পর্যটনের চাপে পরিবেশদূষণের ঝুঁকি বেড়েছে, স্থানীয় কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা, জনসচেতনতা এবং পরিবেশবান্ধব নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব। সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে পরিবেশ সুরক্ষা, জলাভূমি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। পর্যটকদেরও উচিত হবে স্থানীয় রীতিনীতি ও পরিবেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ভ্রমণ করা।
আসলে প্রকৃতির সৌন্দর্য আস্বাদন করতে গিয়ে আমরা যেন ভুলে না যাই, এই পাহাড়, নদী, বনভূমিÑ এসব শুধু ছবির মতো নয়, এগুলো আমাদের টিকে থাকার অবলম্বনও। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছিলেন, ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা, বিশ্বের গভীর শান্তি’। প্রকৃতির এই গভীর শান্তি আমাদের মনে ও মননে জাগ্রত করার মধ্যেই আছে বেঁচে থাকার আদি আনন্দ। জীবনানন্দ বলেছেন, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর!’ এই লাইন আমাদের মনে অনুরণন তোলে যে, জন্মভূমির সৌন্দর্য আসলে অনির্বচনীয়, তার সমান কিছু হয় না। আর জসীমউদ্্দীনের গ্রামীণ কর্ষণ ও স্বপ্নের কবিতাগুলোতে আমরা খুঁজে পাই আবহমান বাংলার দেহ-মন।
সেই মাতৃভূমির রূপকে আরও নিবিড়ভাবে ছুঁয়ে দেখতে, নতুন করে দেখতে, আমাদের দরকার পরিকল্পিত পর্যটন, পরিবেশ-সচেতনতা, আর স্বচ্ছতাপূর্ণ ব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিবাচক ভূমিকা এই তিনটির মেলবন্ধনে যে প্রবাহ তৈরি করেছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। তাদের পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করার ফলে আজ আমরা অহংকার করে বলতে পারি, দেশের আনাচ-কানাচে যে অপার সৌন্দর্য এতদিন ছিল অগোচরে, এখন তা দৃশ্যমান।
আমরা যারা শহরকেন্দ্রিক জীবনে বন্দি, তাদের জন্য অবসর কিংবা ছুটির দিন মানে শপিং মল বা সিনেমা হলে কিছুক্ষণের আনন্দ ছিল। কিন্তু এখন যদি ছুটির দিন মানে সাজেকের মেঘে হারিয়ে যাওয়া, বান্দরবানের পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরনায় গা ভিজিয়ে ফেরা, কিংবা কক্সবাজারের সাগরপারে প্রিয়জনের সঙ্গে সন্ধ্যার সূর্যাস্ত দেখা হয়, তাহলে জীবন মানেই যেন নতুনভাবে রঙিন হয়ে ওঠে। ঠিক এই আনন্দটাই তো মানুষ খোঁজে, যা প্রকৃতি আর ভ্রমণের মাধ্যমে আসে।
ফলে সামগ্রিকভাবে বলা যায়, দুর্গম পথ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যটনের অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেবল একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, বরং দেশপ্রেমী অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। রাস্তাঘাট, ব্রিজ, রিসোর্টÑ এসব কিছুর সমন্বয়ে তারা আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরছে এক অন্য বাংলাদেশ। সে বাংলাদেশে পাহাড়ের চূড়ায় মেঘ এসে বসে থাকে, গাছের পাতায় শিশিরের বিন্দু ঝিলমিল করে, নদীর বুকে নৌকা ভেসে বেড়ায় আপন ছন্দে, আর সাগরের লোনা হাওয়ায় মন উদাস হয়।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
আশা করা যায়, আগামী দিনগুলোতে এই উন্নয়নকর্ম আরও পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাবে, যেখানে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে এবং প্রকৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা নিয়ে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প আরও সমৃদ্ধ হবে। ‘আমার সোনার বাংলাদেশ, এ দেশকে আমরা সবাই ভালোবাসি’, এটি শুধু কথার কথাই নয়, এটি আমাদের মাটি, জল, পাহাড়, বনভূমি আর মানুষের প্রতি এক গভীর মমতা ও দায়িত্বের অঙ্গীকার। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিরলস প্রচেষ্টায় সেই অঙ্গীকার প্রতিফলিত হচ্ছে প্রতিদিন। তাদের উদ্যোগে আজ আমরা গর্বের সঙ্গে দেখি সবুজের সমারোহে, মেঘে ঢাকা পাহাড়ে এবং নদী-সমুদ্রের অপূর্ব রূপে সজ্জিত একটি সুন্দর বাংলাদেশ। সেনাবাহিনীর আন্তরিক ও দায়িত্বশীল কর্মকাণ্ড শুধু পর্যটনশিল্পকেই নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতিকেও নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। আমরা এই মহান কাজের জন্য সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানাই এবং আশা করি তাদের এই পথচলা হবে আরও সাফল্যমণ্ডিত।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতি রইল শুভকামনা, সবুজে ঢাকা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই দেশকে আরও উন্নত, সমৃদ্ধ ও প্রিয় করে তোলার জন্য!
কর্নেল মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম : সেনা কর্মকর্তা