এবারের মুদ্রানীতি ও দেশীয় কর্মসংস্থান

রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
এবারের মুদ্রানীতি ও দেশীয় কর্মসংস্থান


জুন পর্যন্ত মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাষ্য অনুসারেই এই মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য হলো মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি নিয়ে তেমন কোনো চিন্তা বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান পরিস্থিতিতে নেই। গভর্নর বলেছেন, এবারের মুদ্রানীতির ভঙ্গি হবে প্রকৃত সংকোচনমূলক। অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ৭-৮% নামিয়ে আনতে চায়। এতে যদি দেশের জিডিপি বৃদ্ধি কমে যায় তাতে তেমন আপত্তি তাদের নেই।

প্রথমে আমরা দেখি মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা নীতি সুদের হারে বা রিপো রেটে কোনো পরিবর্তন করেনি। অর্থাৎ আগের মতোই নীতি সুদের হার ১০%ই আছে। এই সিদ্ধান্ত দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারকে এই বার্তা দিতে চাইছে যে, অন্তত জুন পর্যন্ত সুদের হার বাড়ানোর ইচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেই। তাই ঋণের সুদের হারও বাড়বে না বলে ধারণা করা যায়।

এই মুদ্রানীতিতে সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমানোর সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। সরকারও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিকে সমর্থন দিচ্ছে এবং তাই ব্যাংক থেকে সরকারের লোন নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি থেকে কমিয়ে ৯৯ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি আগের মুদ্রানীতির মতো ঠিক করা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। যদিও গত ডিসেম্বরের হিসাবে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর নীতি গ্রহণের মূল কারণ হলো জিডিপিতে বেসরকারি বিনিয়োগের অবদান সবচেয়ে বেশি অথচ কয়েক বছর ধরেই জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগের অনুপাত ২৩-২৪ শতাংশে আটকে আছে। সরকার চাইছে বেসরকারি খাতে যেন বিনিয়োগ বাড়ে এবং এর ফলে দেশে কর্মসংস্থান বাড়বে।

অথচ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় খাত, শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির বেশ বড় রকম পতন হয়েছে। ২০২২-২৩-এ জিডিপির হিসাবে প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ যা কমে ২০২৩-২৪-এ দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৫১ শতাংশে। এর প্রভাবে গত বছর জিডিপিও কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ২২ শতাংশ। বর্তমানে ঘোষিত মুদ্রানীতি জিডিপির এই নিম্নমুখী যাত্রাকে অব্যাহত রাখবে।

এই মুদ্রানীতি মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য কিছুটা সময়োপযোগী কিন্তু বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানের জন্য মোটেই সহায়ক নয়। সরকারের ঋণের পরিমাণ কমে যাওয়ার অর্থ সরকারের ব্যয় করার সক্ষমতা কমে যাওয়া, সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকা- কমে যাওয়া। বাংলাদেশে সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকা- কর্মসংস্থানের ওপর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে বেশ বড় প্রভাব রাখে। সরকার যে শুধু উন্নয়ন কাজের জন্য চাকরি তৈরি করে তা নয়। বরং সরকারের এই কর্মকা- দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে আত্মবিশ্বাসের জোগান দেয় যা বেসরকারি বিনিয়োগকে অনেকাংশে প্রভাবিত করে। সরকারের খরচ কমানোর এই নীতি দেশের বেসরকারি বিনিয়োগের আত্মবিশ্বাসের জন্য একটা ধাক্কা।

অবশ্যই সংকোচনমূলক অর্থনীতি মুদ্রাস্ফীতি কমানোর একটা অস্ত্র। কিন্তু এটি অনেকটা দুদিকে ধার দেওয়া তলোয়ারের মতো, যা তলোয়ার ধরা হাতকেও রক্তাক্ত করে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সুফল পেতে সময় লাগবে এবং এটি পেতে যত দেরি হবে ততই দেশের অর্থনীতি রিসিশনের দিকে ধাবিত হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ করছে। তাদের নেওয়া বেশ কিছু নীতির সুফলও আমরা দেখছি। ব্যাংক খাতের দুর্নীতির পরিমাণ কমেছে কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা আমাদের লক্ষ্য থেকে বেশ দূরে আছি।

ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা দুর্বল, সরকারের ব?্যাপারে জনগণ দ্বিধান্বিত- এর মাঝে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বাজারব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়িয়ে দেবে। দেশে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য মুদ্রানীতিতে ব্যবসার ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা যুক্ত করা যেত।

শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদাহরণ পৃথিবীতে বিরল। এখানে মুদ্রানীতির সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। তার মাঝে খেলাপি ঋণ উদ্ধার, সব ধরনের দ্রব্যের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্যকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা অন্যতম। সরকার তার পক্ষের কাজগুলো ঠিকমতো করলেই এই মুদ্রানীতি ফলপ্রসূ হবে, না হলে আমাদের বিনিয়োগ কমার সঙ্গে সঙ্গে বেকারত্ব বাড়বে।

এবারের মুদ্রানীতিতে গত দুই মাসে মুদ্রাস্ফীতি কমাতে নিজেদের সফলতা হিসেবে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা সেটা নয়। গত দুই মাসে মূলত সবজির ব?্যাপক সরবরাহের কারণে দাম কমার প্রভাব পড়েছে মুদ্রাস্ফীতিতে। সামনের মাসগুলোতে যখন সবজির সরবরাহ কমে যাবে, আমাদের আমদানি বাড়বে তখনই আবার টাকার অবমূল্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে যদি মুদ্রাস্ফীতি না বাড়ে তাহলেই নীতিগুলো সফল হয়েছে বলে বলা যাবে।

সার্বিক দিক দিয়ে বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য এই মুহূর্তে হওয়া দরকার আইনশৃঙ্খলার অবস্থার উন্নয়ন এবং ব্যবসা সহজিকরণের মাধ্যমে অর্থনীতির গতি ফেরানো। একমাত্র গতিশীল অর্থনীতিই পারে দেশকে দ্রুত স্থিতিশীল করতে। আর সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি কোনোভাবেই অর্থনীতিকে গতিশীল করার জন্য সহায়ক নয়। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে আমরা আর বেকার বাড়াতে চাই না। এটি শুধু অর্থনীতি নয়, দেশের জন্যও বিপজ্জনক। আমরা আশা করি সরকারও ব্যাপারটা এভাবেই দেখবে এবং তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেবে।


রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী : সহযোগী অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ফিনটেক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি