বহুমেরুত্বের উত্থান : বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
২০২৫ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের অধীনে সবাইকে স্বাগতম। এ যেন এক নতুন শীতল যুদ্ধের যুগের সূচনা, যেখানে বিশ্বরাজনীতি ও ক্ষমতার ভারসাম্য এক নতুন ধাপে প্রবেশ করেছে। একসময় যে শীতল যুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পরিচালিত হতো, তা এখন অতীতের স্মৃতি। বর্তমান সময়ে আমরা এক নতুন ‘বৃহৎ শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ যুগে প্রবেশ করেছি, যেখানে শুধু সুপারপাওয়ার নয়, বরং মাঝারি ও ক্ষুদ্র শক্তিশালী দেশগুলোও কেন্দ্রবিন্দুতে আসার চেষ্টা করছে। এই ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা শুধু পৃথিবীতেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি এখন চাঁদ, মহাশূন্য এবং বায়ুম-লের বাইরেও বিস্তৃত।
বর্তমান বিশ্বের বহুমেরু বাস্তবতা বিশ্বব্যবস্থার গতিশীল পরিবর্তন আমাদের উদ্বেগ সৃষ্টি করলেও এটি নতুন নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমরা একটি দ্বিমেরু ব্যবস্থা দেখেছিলাম, যেখানে আমেরিকার নেতৃত্বে পুঁজিবাদী বিশ্ব এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট ব্লক মুখোমুখি ছিল। এরপর ১৯৯০-এর দশকে ‘একমেরু দশক’ শুরু হয়, যখন আমেরিকার শক্তি ছিল প্রায় অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু ২০২৫ সালে এসে আমরা আবার সেই বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থার দিকে ফিরে যাচ্ছি, যা মানব ইতিহাসের বেশির ভাগ সময় ছিল।
মধ্যপ্রাচ্যের নতুন চিত্র
ইরান মধ্যপ্রাচ্যে তার ভবিষ্যৎ গঠনের নতুন পথে হাঁটছে। পারমাণবিক কর্মসূচি পরিচালনাকারী দেশটি তার প্রভাব বাড়াতে শিয়া ‘করিডোর’ তৈরি করছে, যা বাগদাদ, দামেস্ক ও বৈরুতের মধ্য দিয়ে ভূমধ্যসাগরে পৌঁছাবে। তবে এই অঞ্চলের আরেক শক্তিশালী খেলোয়াড় সৌদি আরব, দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকলেও, জ্বালানির চাহিদা কমে যাওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি স্বাধীনতা অর্জনের কারণে তার কৌশলগত গুরুত্ব কমছে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে একটি ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হচ্ছে, যা ইরান তার কৌশলগত লক্ষ্য পূরণের জন্য ব্যবহার করছে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
আফ্রিকা ও জল নিয়ে প্রতিযোগিতা
তেল নয়, বরং ‘জল’ এখন আফ্রিকায় অস্থিরতার কারণ। ইথিওপিয়া তার বৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে ‘আফ্রিকার জলস্তম্ভ’ হিসেবে মিশরের ওপর একটি কৌশলগত সুবিধা অর্জন করেছে। ভবিষ্যতে অঞ্চলটি ‘জলযুদ্ধের’ কেন্দ্রস্থল হতে পারে। তবে একই সঙ্গে এটি প্রযুক্তির শক্তি এবং জলসম্পদের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নের একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে।
ইউরোপের ভূ-রাজনৈতিক সংকট
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
যুক্তরাজ্য, যা তার সাম্রাজ্য হারিয়েছে, এখন ব্রেক্সিট-পরবর্তী ভূমিকায় একটি মধ্যম শক্তি হিসেবে নতুন কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপন করছে। তবে অভ্যন্তরীণভাবে এটি একটি স্বাধীন স্কটল্যান্ডের হুমকির মুখোমুখি। অন্যদিকে স্পেন তার নিজস্ব অঞ্চল কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের চাপে রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাকে প্রত্যাখ্যান করে, তবে এই অঞ্চলে রাশিয়া ও চীনের প্রভাব বিস্তারের ঝুঁকি থেকে যাবে। রাশিয়া ও চীন এই সংকটের সুযোগ নিয়ে তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিগত অগ্রাধিকার ইউরোপে রাশিয়ার প্রভাব কমানো হলেও, এটি কতটা কার্যকর হচ্ছে তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের ভূমিকায় নতুন মাত্রা
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের বর্তমান কৌশলগত লক্ষ্য হলো, বহুমেরু বিশ্বের প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বজায় রাখা। ট্রাম্প সরকারের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস করছে। মধ্যপ্রাচ্যে সরাসরি হস্তক্ষেপ কমিয়ে চীন ও রাশিয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবিলা করতে যুক্তরাষ্ট্র এখন মহাশূন্য, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সাইবার যুদ্ধক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
বিশ্ব এখন একটি নতুন যুগে প্রবেশ করছে, যেখানে ভূ-রাজনৈতিক শক্তির পুনর্বিন্যাস ও বহুমুখী প্রতিযোগিতা আমাদের ভবিষ্যতের রূপরেখা নির্ধারণ করবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে এই প্রতিযোগিতার মোকাবিলা করবে, তা বিশ্বরাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে।
একেএম সায়েদাদ হোসেন : নির্বাহী পরিচালক, এনআইজিএস (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব গ্লোবাল স্টাডিজ)