নারীকে কবে সম্মান করা শিখবে পুরুষ

প্রমিত হোসেন
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
নারীকে কবে সম্মান করা শিখবে পুরুষ

যেখানে কোনো বিষয়ে জড়িয়ে যায় মানবিকতা ও অমানবিকতার প্রশ্ন, তখন সেটা কোনো স্থানে সীমাবদ্ধ থাকে না; সে বিষয়টা হয়ে ওঠে সর্বজনীন, স্থানিকতার বাইরে সেটা মানবমনের বিশ^জনীন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার আওতায় পড়ে যায়। মানুষের আচরণগত প্রকৃতি একটি বৈশি^ক বিষয়, কোনো রাষ্ট্রীয় কাঠামো বা মানচিত্রের মধ্যে তা সীমিত নয়। এ কারণেই ইসরায়েলের জায়নবাদীরা যখন ফিলিস্তিনের শিশুদের অত্যন্ত হিংস্রতার সঙ্গে হত্যা করে, নিরস্ত্র নারী ও বৃদ্ধদের হত্যার পর গর্তে ফেলে মাটিচাপা দেয়, হামলা চালায় হাসপাতালে, বিদ্যালয়ে, আশ্রয় শিবিরে, ধর্মীয় স্থাপনায়Ñ তখন বিশে^র দিকে দিকে দেখা দেয় মানবিক প্রতিক্রিয়া; ইসরায়েলের জায়নবাদী ঘাতকদের পাশবিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় বিভিন্ন দেশের মানুষ, তাদের প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় সব মহাদেশে।

সম্প্রতি আদালতের একটি রায় নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে ভারতের বহু মানুষ। বিষয়টি ভারতের, তার ওপর আদালতের রায়, সুতরাং ভিনদেশের মানুষের এ নিয়ে কথা বলার এখতিয়ার নেই। রাষ্ট্র, আইন ইত্যাদি দিয়ে দেখলে হয়তো তাই। কিন্তু কিছু বিষয় আছে যা রাষ্ট্রের সীমানা মানে না, সেসব বিষয়ে আছে সর্বজনীনতা এবং সেজন্যই বৈশি^ক মানবসমাজে দেখা দেয় তার প্রতিক্রিয়া। ভালো বা মন্দ, ইতিবাচক বা নেতিবাচক, যুদ্ধ অথবা শান্তি- সব বিষয়েই রয়েছে বৈশি^ক মানবসমাজের অংশীদারত্ব। অধিকারও। সেজন্যই ফিওদর দস্তয়েভস্কি কিংবা গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস কিংবা নোয়াম চমস্কি কিংবা নাগিব মাহফুজ কিংবা হারুকি মুরাকামি কোনো রাষ্ট্রের নয়, সমগ্র মানবসমাজের সম্পদ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাই ধরা যাক। তিনি শুধু বাঙালির সম্পদÑ এমন দাবি করা আর গায়ের জোরে গোঁয়ার্তুমি করা একই ব্যাপার।

ভারতে যে ঘটনাটি নিয়ে আদালত রায় দিয়েছেন, সেটাও কি এক ধরনের আইনি গোঁয়ার্তুমি? ‘আইনের প্রতি শ্রদ্ধা’ রেখেই এ প্রশ্নটি করা যায়। কিন্তু প্রশ্ন আরও আছেÑ আইনের প্রতি শ্রদ্ধা বিষয়টা কী? কোন আইনের প্রতি শ্রদ্ধা? স্বাধীন বাংলাদেশে কিংবা স্বাধীন ভারতে যদি ইংরেজ ঔপনিবেশিকদের আমলে আরোপিত আইন এখনও বলবত থাকে, তাহলে মানুষ তা মেনে নেবে কেন? ওইসব আইনের প্রতি মানুষ ‘শ্রদ্ধা’ হারালে খুব কি অন্যায় হবে? ঔপনিবেশিক ‘প্রভুদের’ থেকে স্বাধীন হওয়ার অর্থ কী তাহলে? আইন তো মানুষই তৈরি করে। স্বাধীন দেশের আইনও হতে হবে সঙ্গতিপূর্ণ ও স্বাধীন। লজ্জার বিষয়, এখনও অনেক ফাঁক রয়ে গেছে। হয়তো ওইসব ফাঁকফোকরের মধ্যেই রয়ে গেছে আইনের ফাঁক!

ভারতে ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৭ সালে। ছত্তিশগড়ের এক ব্যক্তি, পেশায় গাড়িচালক, ১১ ডিসেম্বর রাতে স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সঙ্গে অস্বাভাবিক যৌনাচার করেন। তারপর কাজে বেরিয়ে যান। তার স্ত্রী তখন নিজের বোন ও অন্য আত্মীয়দের সাহায্য নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন, তার শারীরিক অবস্থা ছিল মারাত্মক। কয়েক ঘণ্টা পর হাসপাতালে তিনি মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দিয়ে বলেছিলেন, স্বামীর জোরপূর্বক অস্বাভাবিক যৌনাচারের ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

নিম্ন আদালত ২০১৯ সালে ওই ব্যক্তিকে অপরাধী বলে সাব্যস্ত করেন। তার বিরুদ্ধে ‘অনিচ্ছাকৃত হত্যা’র অভিযোগ আনা হয়েছিল। নিম্ন আদালত ওই ব্যক্তিকে দশ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেন। ওই জবানবন্দি ও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে এ রায় দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু গত সপ্তাহে ৪০ বছর বয়সী গাড়িচালক ব্যক্তিটি খালাস পেয়ে গেছেন। ছত্তিশগড় হাইকোর্ট তাকে খালাস দিয়েছেন এই বলে যে, স্ত্রীর সঙ্গে জোর করে অস্বাভাবিক যৌনতা অপরাধ নয়। হাইকোর্টের বিচারপতি নরেন্দ্রকুমার ব্যাস গত সোমবার রায়ে উল্লেখ করেছেন, ভারতে বৈবাহিক ধর্ষণ অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় না। ফলে স্ত্রীর অসম্মতিতে যৌন সম্পর্ক স্থাপন অথবা স্ত্রীর অসম্মতিতে অস্বাভাবিক যৌনতার অভিযোগে কোনো স্বামীকে অপরাধী সাব্যস্ত করা যায় না।

এবার স্থিরমস্তিষ্কে চিন্তা করুন। চিন্তা করে দেখুন। প্রশ্নের পর প্রশ্ন কি আপনাকে কুরে কুরে খাবে না? ধর্ষণ তো ধর্ষণ, তার বৈবাহিক-অবৈবাহিক কী? স্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই, থাকবে না? স্ত্রী কি মানুষ নয়? আইন কি তবে শ্রেণি-পেশা-লিঙ্গ নির্বিশেষে সব মানুষকে সমান মর্যাদা এবং অধিকার দেয় না? আইনে তাহলে স্ত্রীরা হচ্ছে স্বামীদের হাতের পুতুল, অনাচার-অযাচারের বস্তু, দাসী-বাঁদী? স্বামীরা অমানুষিক যা-খুশি তাই করতে পারে স্ত্রীদের সঙ্গে?

স্বভাবতই ভারতের বহু মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছেন হাইকোর্টের রায়ে। সুকৃতি চৌহান তাদেরই একজন। তিনি নিজেও আইনজীবী, জেন্ডার অধিকারকর্মী। বিবিসিকে সুকৃতি বলেছেন, আইনের চোখে রায় ঠিক হতে পারে, কিন্তু নৈতিকতার দিক থেকে তা জঘন্য। ‘এ রায় আমাদের আইনব্যবস্থার অন্ধকার দিকটি ফুটিয়ে তুলেছে’, উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘এ রায় আমাদের ভিতর ভিতর নাড়িয়ে দিয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব আইন পরিবর্তন হওয়া দরকার।’

ছত্তিশগড়েরই আরেক আইনজীবী প্রিয়ঙ্কা শুক্লা। তিনি বলেছেন, ‘এ ধরনের রায় এমন বার্তা পাঠায় যে, তুমি স্বামী বলে যা খুশি করার অধিকার তোমার আছে। এমনকি তুমি খুন করেও পার পেয়ে যাবে।’

নারীর ওপর পুরুষের অত্যাচার নতুন নয়। এমনকি সভ্য হিসেবে বড়াই করা দেশগুলোতেও এ হার অনেক বেশি। তথ্য বলছে, ৩০টি দেশে বৈবাহিক ধর্ষণ অপরাধ নয়। এসব দেশের তালিকায় ভারত তো আছেই, আরও আছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সৌদি আরব ইত্যাদি। ১৮৬০ সালে ভারতীয় দণ্ডবিধিতে ধারাটি চালু হয়েছিল (তখন ভারত ছিল পরাধীন, ব্রিটিশ উপনিবেশ)। ব্রিটিশ সরকার স্বয়ং ধারাটি বাতিল করে দিয়েছে ১৯৯১ সালে। কিন্তু ভারতের সাম্প্রতিক তৈরি করা ন্যায়সংহিতায় ধারাটি একইরকম রাখা হয়েছে। দেশটির সরকারি সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ৩২ শতাংশ বিবাহিত নারী তাদের স্বামীদের হাতে শারীরিক, যৌন ও মানসিক সহিংসতা এবং ৮২ শতাংশ যৌন হিংস্রতার শিকার হন।

বিষয়টা অত্যন্ত স্পর্শকাতর। ভাবলেশহীন থাকার সুযোগ নেই। মানুষের বিশ^সমাজে এ ধরনের অন্যায় আর এ ধরনের আইন কখনই শুভ নয়। এতে সমানাধিকার অপদস্থ হয়, মানুষের সত্তা বিপর্যস্ত হয়, মানবিকতা ভূলুণ্ঠিত হয়। এটি ভারতের ঘটনা বলে ছেড়ে দেওয়া যায় না। এ ধরনের অনেক ঘটনা, নারীর ওপর অত্যাচার ও নির্মমতার ঘটনা এই বাংলাদেশেও ঘটে। আমেরিকা-ইউরোপেও ঘটে। নারীকে মানুষ বলে গণ্য না করার অভ্যাস এবং পুরুষের সেবাদাসী বা অধস্তন হিসেবে দেখার প্রবণতা এর অন্যতম হেতু। পুরুষের দখলে অর্থনীতি, রাজনীতি, রাষ্ট্র, এমনকি ধর্মও। সুতরাং পুরুষ মনে করে, সে নারীর প্রভু আর নারী তার দাস। এমনকি সে আরও মনে করে, নারীর জন্মই হয়েছে পুরুষের সেবা করার জন্য। এই অপভাবনায় আটকা রয়েছে পুরুষ। সে যতদিন এ থেকে মুক্ত হতে না পারবে, স্বাধীন মানুষ হয়ে উঠতে না পারবে, ততদিন তার কবল থেকে মুক্তি পাবে না নারী। মায়ের জাত হিসেবে নারী সেদিন সম্মান পাবে যেদিন সব অপচিন্তা থেকে মুক্তি পাবে পুরুষ।


প্রমিত হোসেন : গল্পকার, ঔপন্যাসিক। বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদক। আমাদের সময়-এর সহযোগী সম্পাদক